শনিবার, ৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

কাপুর পরিবারের সাতকাহন...

কাপুর পরিবারের সাতকাহন...

কাপুর পরিবার মানে বলিউডের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম। উনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে পৃথ্বীরাজ কাপুরের মাধ্যমে বর্তমান পর্যন্ত বলিউড ইন্ডাস্ট্রি শাসন করে যাচ্ছে কাপুর পরিবার। বলিউডে কাপুর পরিবারের চালচিত্র তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

পৃথ্বীরাজ কাপুরের হাত ধরে যাত্রা

পাঞ্জাব প্রদেশের এক হিন্দু পরিবার থেকে কাপুর পরিবারের শুরু। পরিবারের প্রধান দেওয়ান বশেশ্বরনাথ সিং কাপুর ছিলেন পুলিশ অফিসার। তার দুই সন্তান পৃথ্বীরাজ কাপুর ও ত্রিলোক কাপুর। বলিউডে কাপুর পরিবারের রাজত্ব শুরু পৃথ্বীরাজ কাপুরের হাত ধরে। ফুফুর কাছ থেকে টাকা ধার করে তিনি এসেছিলেন বোম্বে শহরে। তিনি একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক এবং চলচ্চিত্রের লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তার অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন হিন্দি চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগে। ১৯২৪ সালে প্রথম সিনেমা ‘দো ধারি তলোয়ার’-এ তিনি এক্সট্রা অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। মোট নয়টি নির্বাক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর তিনি সবাক চলচ্চিত্রে নাম লেখান। ১৯২৯ সালে ‘সিনেমা গার্ল’ ছবিতে প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন পৃথ্বীরাজ কাপুর। তার অভিনীত বিখ্যাত ছবির মধ্যে রয়েছে মুঘল-ই-আজম, বিদ্যাপতি, সিকান্দার-ই-আজম, দ্রৌপদি, আওয়ারা প্রভৃতি। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৪৪ সালে পৃথ্বী থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতীয় থিয়েটার এবং হিন্দি সিনেমা শিল্পের অগ্রদূত বলা হয়  পৃথ্বীরাজ কাপুরকে। তার ভাই ত্রিলোক কাপুরও অভিনয় করতেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পৃথ্বীরাজ কাপুরকে ভারত সরকার ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭১ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রদান করে। ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করা এই তারকা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭২ সালে। পৃথ্বীরাজ কাপুর বিয়ে করেন রামসারনি মেহরাকে। এই দম্পতির তিন সন্তান। রাজ কাপুর, শমসের রাজ (শাম্মী কাপুর) ও বলবীর রাজ (শশী কাপুর)। তার তিন সন্তানই বলিউডের কিংবদন্তি। আবার বংশপরম্পরায় সবার সন্তানরাই বলিউডে ধরে রেখেছেন পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য।

 

রাজ কাপুর

প্রকৃত নাম রণবীর রাজ কাপুর। জন্ম ১৪ ডিসেম্বর, ১৯২৪ সালে। পেশোয়ারে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা, নির্মাতা। তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেরা পথপ্রদর্শকরূপে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ইনকিলাব’ চলচ্চিত্রে মাত্র দশ বছর বয়সে প্রথম অভিনয় তার। ১৯৪৭ সালে ‘নীল কমল’ চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয় করে প্রতিষ্ঠা পান। ১৯৪৮ সালে চব্বিশ বছরের যুবক রাজ কাপুর নিজস্ব স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত করেন আর. কে. ফিল্মস নামে। ১৯৪৯ সালে ‘বারসাত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার। এই ছবিতে অভিনয়ও করেন তিনি। আর. কে. ব্যানারের অধীনে ১৯৫১ সালে আওয়ারা, ১৯৫৫ সালে শ্রী ৪২০, ১৯৫৬ সালে চোরি চোরি ও জাগতে রাহো এবং ১৯৬০ সালে জিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়-এর মতো সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। এছাড়া তার নির্মিত মেরা নাম জোকার, সত্যম শিবম সুন্দরম, প্রেম রোগ, সঙ্গম, ববি, রাম তেরি গঙ্গা মাইলি, হেনা প্রভৃতি ছবি এখনো বলিউডে ইতিহাস হয়ে আছে। তিনবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও এগারোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন তিনি। রাজ কাপুরের সম্মানার্থে ও তার নামানুসারে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারের নাম রাখা হয়। আওয়ারায় তার অনবদ্য অভিনয়শৈলীর কারণে টাইম সাময়িকী সর্বকালের সেরা দশ অভিনয়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত করে। ১৯৫৬ সালে তার নির্মিত মুক্তিপ্রাপ্ত জাগতে রাহো চলচ্চিত্রটি কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ক্রিস্টাল গ্লোব পুরস্কার লাভ করে। ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পে তাকে ক্লার্ক গেবল নামে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৬৫ ও ১৯৭৯ সালে যথাক্রমে চতুর্থ ও একাদশ মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারকম-লীর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। শিল্পকলায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ভারতের চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান তিনি। মৃত্যুর পর ২০০১ সালে স্টারডাস্টের মিলেনিয়ামের সেরা পরিচালক মনোনীত হন। ২০০২ সালে স্টার স্ক্রিন কর্তৃক মিলেনিয়ামের শোম্যানরূপে বিবেচিত হন। ১৪ ডিসেম্বর, ২০০১ তারিখে ভারতীয় ডাকবিভাগ তার সম্মানার্থে মুখম-লকে ঘিরে ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ২০১৪ সালে গুগল তার ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে স্মারক তুলে ধরে।

রাজ কাপুর বিখ্যাত কমেডি অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে অভিনয়ের আদর্শ হিসেবে মানতেন এবং নিজের প্রায় প্রতি ছবিতেই তার এই মহান আদর্শ অভিনেতার ছায়া ধরে হাঁটতেন। ১৯৮৮ সালে ৬৩ বছর বয়সে হাঁপানি সংক্রান্ত জটিলতায় তার দেহাবসান ঘটে। ১৯৮৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার গ্রহণের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঞ্চে পড়ে যান এবং একমাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৯৮৮ সালে মারা যান। ১৯৪৬ সালে কৃষ্ণা মালহোত্রাকে বিয়ে করেন। রাজ কাপুরের তিনি পুত্র হলেন অভিনেতা নির্মাতা রণধীর কাপুর, ঋষি কাপুর ও রাজীব কাপুর।

 

শাম্মী কাপুর

শাম্মী কাপুরের আসল নাম শমসের রাজ। অভিনেতা হিসেবে তার বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব আর চলন-বলন দেখতেই দর্শকরা সিনেমা হলে ভিড় জমাতেন। তার নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট ছিল। বলা হয়ে থাকে শাম্মী কাপুরই ভারতের প্রথম কোনো অভিনেতা যিনি তার নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলেন। শাম্মী কাপুর জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালে। তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ছিল ‘জীবন জ্যোতি’। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তার বাজার মাত করা সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘জংলি’, ‘প্রেমকাহানি’, ‘কলেজ গার্ল’, ‘চায়না টাউন’, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’, ‘কাশ্মীর কি কলি’। কেন্দ্রীয় চরিত্রে শাম্মী কাপুরের শেষ সিনেমা ১৯৭১ সালের ‘আন্দাজ’। তবে এরপরও তিনি পার্শ¦চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন। তিনি বিয়ে করেন গীতা বালিকে। তার ছেলে আদিত্য রাজ কাপুর।

 

শশী কাপুর

শশী কাপুরের পুরো নাম বলবীর রাজ কাপুর। অভিনয় জীবন শুরু করেন মাত্র ৪ বছর বয়সে। তিনি ১৭৫টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এছাড়া অনেক জনপ্রিয় ছবির প্রযোজক তিনি। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে- ‘সিলসিলা’, ‘জুনুন’, ‘কালযুগ’, ‘বিজেতা’, ‘উৎসব’। শশী কাপুর ২০১১ সালে পদ্মভূষণ ও ২০১৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। জনপ্রিয় এই অভিনেতা ১৯৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ২০১৭ সালে। তার রয়েছে তিন সন্তান। কুনাল কাপুর, করণ কাপুর ও সঞ্জনা কাপুর।

 

রণধীর কাপুর

রাজ কাপুরের বড় ছেলে রণধীর কাপুর। সত্তরের দশকে তিনি বেশকিছু জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘জিত’, ‘লাফাঙ্গে’, ‘কাসমে ভাদে’, ‘আখরি ডাকু’, ‘পুকার’ ইত্যাদি। তার জন্ম ১৯৪৭ সালে। বিয়ে করেন অভিনেত্রী ববিতা শিবদাসানীকে।

এই দম্পতির দুই সন্তানও বলিউড দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা হলেন কারিশমা কাপুর ও কারিনা কাপুর। কারিনা কাপুর এখনো তরুণদের হার্টথ্রব হয়ে আছেন।

 

ঋষি কাপুর

অভিননেতা, পরিচালক ও প্রযোজক। ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ৯২টি রোমান্টিক চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার। তিনি বিয়ে করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী নিতু সিংকে। এই দম্পতির রয়েছে দুই সন্তান রণবীর কাপুর ও ঋদ্ধিমা কাপুর সোহানি।

 

রাজীব কাপুর

রাজীব কাপুরও ছিলেন অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। তার অভিনীত সফল ছবির মধ্যে অন্যতম ‘রাম তেরি গঙ্গা মাইলি’। রাজ কাপুরের দুই সন্তান ঋতু নন্দ, রিমা কাপুর। রিমা কাপুরের বলিউডের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কারিশমা কাপুর, কারিনা কাপুর, রণরীব কাপুর তিনজনই বলিউডে কাপুর পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম। তিনজনই তুমুল জনপ্রিয়।

 

কারিশমা কাপুর

রণধীর কাপুর ও ববিতার প্রথম সন্তান কারিশমা কাপুর জনপ্রিয় অভিনেত্রী। কারিশমা কাপুরের ডাকনাম বোবো। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ‘প্রেম কয়েদি’ সিনেমার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তিনি বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ‘রাজা হিন্দুস্তানি’, ‘আনাড়ি’, ‘আন্দাজ আপনা আপনা’, ‘বিবি নাম্বার ওয়ান’ তার অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তিনি পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও।

 

কারিনা কাপুর

কারিনা কাপুর খান হলেন রণধীর কাপুর ও ববিতার দ্বিতীয় সন্তান। দুইবার জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী এই অভিনেত্রী বিয়ে করেছেন অভিনেতা সাইফ আলী খানকে। এই দম্পতির রয়েছে এক সন্তান, নাম তৈমুর। ২০০০ সালে ‘রিফিউজি’ চলচ্চিত্র দিয়ে তার বড় পর্দায় অভিষেক হয়। ঐতিহাসিক নাট্যধর্মী ‘অশোক’ এবং মেলোড্রামাধর্মী ব্লকব্লাস্টার ‘কাভি খুশি কাভি গম’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন।

 

রণবীর কাপুর

রণবীর কাপুর হলেন ঋষি কাপুর ও নিতু  সিং দম্পতির ছেলে। বলিউডের জনপ্রিয় এই অভিনেতা কারিশমা ও কারিনার চাচাতো ভাই। ২০০৭ সালে ‘সাওয়ারিয়া’ সিনেমা দিয়ে তার চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। এই ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ নবাগত পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১১ সালে রকস্টার ছবির মাধ্যমে আকাশচুম্বী খ্যাতি অর্জন করেন।

 

অনিল কাপুর

অনেকের ধারণা অনিল কাপুর বিখ্যাত পৃথ্বীরাজ কাপুর পরিবারেই সদস্য। তবে সত্যিটা হচ্ছে অনিল কাপুরের বাবা সুরিন্দর কাপুর ছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুরের কাজিন। সুরিন্দর কাপুরের তিন ছেলে বনি কাপুর, অনিল কাপুর এবং সঞ্জয় কাপুর। বনি কাপুরের ছেলে বলিউড তারকা অর্জুন কাপুর। অনিল কাপুরের মেয়ে বলিউডের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী সোনম কাপুর। এই পরিবার পৃথ্বীরাজ পরিবারের সদস্যভুক্ত নয়। কাপুরদের সঙ্গে তাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা রয়েছে। বলিউডে অনেক রথী-মহারথী এসেছেন। হারিয়েও গেছেন কালের গর্ভে। কিন্তু কাপুর পরিবারের মতো এত বিস্তৃত অবদান রাখতে পারেনি কেউ। দীর্ঘদিন ধরে বলিউডকে শাসন করে যাচ্ছে কাপুর পরিবার। যুগে যুগে এই পরিবার এ জগতের হাল ধরেছেন এবং নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর