সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

সেই শবনম এখন কেমন আছেন

সেই শবনম এখন কেমন আছেন

বরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনম। ৪০ বছরের বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবন তার। ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তার বলা কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

রূপনগরের রাজকন্যা হয়ে এলেন শবনম

‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি, ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’...কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম এই গানে ঠোঁট মিলিয়ে এদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। দর্শক মনে শিহরণ জাগান। এটি ছিল তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘হারানো দিন’ এর গান। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৬১ সালে পরিচালনা করেন ছবিটি। প্রথম ছবিই সুপার হিট। তারপর শুধুই দর্শকমন জয় করে এগিয়ে যাওয়া। নব্বই দশক পর্যন্ত পাকিস্তান আর বাংলাদেশে প্রায় ১৮৫টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি কিনা পাকিস্তান চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা নিগার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ১২ বার। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলিয়ে অসংখ্য নানা সম্মাননায় সমৃদ্ধ হয় তার অর্জনের ঝুলি।

 

যেভাবে ঝর্ণা বসাক হলেন শবনম

ঝর্ণা বসাক ১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন ঢাকায়। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ক্যাপ্টেন এহতেশামের চান্দা ছবিতে ১৯৬২ সালে অভিনয় করেন শবনম। এই নির্মাতাই ‘হারানো দিন’ ছবিতে তাকে শবনম নামটি দেন। শবনম নামের অর্থ হলো- ফুলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়া। চান্দা ছবিটিও দর্শক বিপুলভাবে গ্রহণ করলে অভিনেত্রী শবনমের শুরু হয় রুপালি পর্দায় শুধুই সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠা। ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর শবনম বিয়ে করেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষকে। ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন রবীণ ঘোষ। একমাত্র পুত্র রনি ঘোষকে নিয়ে ঢাকার বারিধারার ডিওএইসএসে সময় কাটছে এখন এই কিংবদন্তির। শবনমের একমাত্র বড় বোন নন্দিতা দাস কলকাতার সিমলা রোডে বাস করেন। মাঝে মধ্যে বোনের কাছে বেড়াতে যান তিনি। এই অভিনেত্রীর বাবা ননী বসাক ছিলেন একজন স্বনামধন্য স্কাউট প্রশিক্ষক ও ফুটবল রেফারি।

 

১৯৬৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবাসী

১৯৬৮ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। ১৯৮৮ সালে শবনম ঢাকা ও লাহোরের চলচ্চিত্রে একসঙ্গে অভিনয় করতে থাকেন। প্রায় ৪০ বছরের অভিনয় জীবনে ১৮৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। আশির দশকে ঢাকায় এসে অভিনয় করেন শর্ত, সন্ধি, সহধর্মিণী, যোগাযোগ, আমার সংসার, চোর, জুলি ছবিতে। নব্বই দশকের শেষভাগে ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

১৯৯৯ সালে সর্বশেষ কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ছবিটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং শবনম এ প্রজন্মের দর্শকদের কাছেও সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে শবনম বলেন, ‘আমার ভাগ্য ভালো যে, আমার অভিনীত প্রথম ও শেষ ছবি ছিল আমার ক্যারিয়ারের সেরা ছবি।’

 

যেভাবে সময় কাটছে এখন 

‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রের পর শবনমকে আর ক্যামেরার সামনে দেখা যায়নি। তার কথায় ‘কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে এমন ব্যসিক চরিত্র পাইনি বলেই অভিনয় থেকে দূরে সরেছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে উচ্চাসন দিয়েছেন সেখানে বসে গতানুগতিক চরিত্রে তো আর অভিনয় করতে পারি না। সময় কীভাবে কাটে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বই পড়ি, গান শুনি, টেলিভিশন দেখি, ঘরের কাজকর্ম করি। নিজের যতœ নিই। এভাবেই দিন কেটে যায়।’ তিনি জানান, ‘সুচন্দা, ববিতা ও চম্পার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় কথা হয়। বলা চলে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়মিত হয়। অন্যদের মধ্যে নির্দিষ্ট নাম বলতে পারব না। তবে দেখা হলে সবাই আপনের মতো আচরণ করে।’ জীবনের এ পর্যায়ে এসে কোনো না পাওয়া কিংবা চাওয়ার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিনয় জীবনে অনেক পেয়েছি। তেমন কিছু চাওয়ার নেই। তবে যতদিন বাঁচি যেন সুস্থ থাকি এটাই প্রত্যাশা করি। এ জীবনে কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো ব্যথা নেই। অনেক পেয়েছি।’ তবে অভিনয়ের প্রতি এখনো আগ্রহ আছে। তিনি বলেন, ‘অভিনয়ই তো আমার পেশা। শিখেছি তো অভিনয়। অভিনয় করার ইচ্ছা আছে। তবে অভিনয় করতে না পারলে কোনো কষ্ট থাকবে না।’

 

চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে যা বললেন

শবনম বললেন, চলচ্চিত্র বলতে বুঝি এহতেশাম, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, রহমান, এ জব্বার খান, নাদিম, রহমান, সুচন্দা, কবরী, ববিতা, রাজ্জাক, আলমগীর মানে প্রথম দিকে যাঁরা চলচ্চিত্রে এসেছিলেন, তাঁদের নাম। এখন তো তাঁদের কেউ সম্মান করে না। এখন যারা আছেন তারা উল্লিখিতদের মধ্যে কজনকে চিনেন? এখন যারা কাজ করছেন তারা দর্শকদের কতটা সমৃদ্ধ কাজ দিতে পারছেন? একমাত্র শাকিব খান ছাড়া আর কারও নাম তো এখন আর শোনা যায় না। নতুনরা পুরনোদের সম্পর্কে জানারও চেষ্টা করে না, এ বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। রবীণ ঘোষ বেঁচে থাকতে এবং মারা যাওয়ার পরেও তার কোনো মূল্যায়ন হলো না, এ কথা ভাবতেই খুব দুঃখ লাগে। দীর্ঘদিন আগে একবার এফডিসির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরে গোপনে ঢুকলাম। সাউন্ড রুমের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। এফডিসির বেহাল এই অবস্থা মানতে পারিনি। যে এফডিসি আমাদের এত কিছু দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, কত মানুষের রুটিরুজি এখান থেকে, সেই এফডিসির এই হাল সত্যিই কষ্টের।  ‘আম্মাজান’ ছবির শুটিংয়ের পর এফডিসি বা চলচ্চিত্রের কোনো অনুষ্ঠানে যাইনি। অনেক ব্যাপার আছে, প্রাণখুলে সেসব বলতে পারছি না। পারব না। আর বলে লাভও হবে না। আমার মুখ পুরোপুরি বন্ধ। একদিন শুনবেন, আমি মরে গেছি। তখন এফডিসির লোকজন অস্থির হয়ে উঠবে সেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি তো আমার ছেলেকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমার মরদেহ যেন কোনোভাবেই এফডিসিতে না যায়। আমার স্বামী, প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ সাহেবও বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মরদেহও যেন সেখানে নেওয়া না হয়, তাই নেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, মরে গেলে ফুলের মালা দেবে, হয়ে গেল, তাই না? এই সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। কাউকে আমার মরদেহ নিয়ে মায়াকান্না কাঁদার সুযোগ দেব না। আমি যেভাবে নিজের বাসায় চুপচাপ আছি, সেভাবেই ভালো আছি। শান্তিতে আছি। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চাই না। আমি শিল্পী। আমি আমার মতো আছি। খুব ভালো আছি। আমার পরিবার, শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ভালোই আছি। বাসায় থাকি। টেলিভিশন দেখি। গান শুনি। রান্না করি। ছেলে ঢাকায় এলে ওর জন্য রান্না করি। কখনো কখনো নিজের জন্য রান্না করি। জীবন তো চলেই যায়। নিজের পুরনো ছবিগুলো দেখি। রবিনের গান অনেক শুনি। আলাউদ্দীন আলী, খান আতাউর রহমানের গানও শুনি। স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। কাউকে বিরক্ত করছি না। চলচ্চিত্রে আমাদের সময়কার সেই সোনালি দিনের কথা মনে করে এখন শুধু দুঃখ পাই আর নীরবে কাঁদি। এই কান্নার শেষ কখন হবে জানি না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর