শনিবার, ১৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

যেভাবে বলিউড বাদশাহ শাহরুখ

যেভাবে বলিউড বাদশাহ শাহরুখ

অভিনয় জগতের ঈশ্বর শাহরুখ খান। কেউ তাকে ডাকে কিং খান, আবার কেউ বলিউড বাদশাহ বলে অভিহিত করে। যে নামেই তাকে অভিহিত করুক না কেন, তিনি নিজের সীমানাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। আজ তার সাফল্য আকাশ ছুঁয়েছে। ‘চিরতরুণ’ এই ভার্সেটাইল অভিনেতাকে নিয়ে আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন- পান্থ আফজাল

 

পকেটে টাকা নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। অভিনেতা হওয়ার আশায় দিল্লি থেকে কয়েক শ মাইল পেরিয়ে স্বপ্ননগরী মুম্বাইতে এসেছিল ছেলেটা, কিন্তু বলার মতো কোনো কাজও নেই হাতে। বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা যা নিয়ে এসেছিল, সব তখন শেষ। হতাশ সেই ছেলেটা একদিন মুম্বাইয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিল, ‘এই শহরটা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, আমাকে শেষ করে দিয়েছে একদম! একদিন আমি এই শহরটাকে দেখে নেবো, এই শহরের রাজা হবো আমি!’ এবং তিনি হয়েছেনও তাই। আরোহণ করেছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে।

 

পাঠান মুসলিম পরিবারে জন্ম

দিল্লির তালভার নার্সিং হোমে জন্মের পর কোনো এক নার্স নাকি বলেছিল ‘শিশুটি বড় হয়ে অনেক বিখ্যাত হবে।’ আর সেই শিশুটিই আজকের শাহরুখ খান। ১৯৬৫ সালের ২ নভেম্বর দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন আজকের কিং খান। বাবা ছিলেন পাঠান মুসলিম পরিবার বংশোদ্ভূত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী তাজ মোহাম্মদ খান। মা লতিফ ফাতিমা ছিলেন একজন সরকারি প্রকৌশলী ইফতেখার আহমেদের মেয়ে। খানের মতে, তার দাদা ছিলেন প্রকৃতভাবে একজন আফগানিস্তান নাগরিক।

 

দিল্লির রাজিন্দর নগরের এফ-৪৪২

খানের শৈশব কেটেছে দিল্লির রাজিন্দর নগরে। নিজের জীবনীতে সেই বাড়ির নম্বরটিও লিখেছেন তিনি, এফ-৪৪২। শাহরুখ খানের বাবা ভারত ভাগের আগে বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ারের কিসসা কাহানি বাজার থেকে দিল্লিতে চলে আসেন। তার মায়ের বাড়ি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। শেহনাজ লালারুখ নামে শাহরুখ খানের এক বড় বোন রয়েছে।

মায়ের অনুপ্রেরণাই সঙ্গী

বলিউড বাদশা ভীষণ মা-ভক্ত। বাবার মৃত্যুর পর তার মা ব্যবসাকে আবার নতুন করে গড়ে তোলেন। শাহরুখ বলেন, আজকের এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে তার মায়ের অনুপ্রেরণা। কিং খান বিশ্বাস করেন যে, তার মা তাকে সারাক্ষণ দেখে রাখছেন।

 

হিন্দু রীতিতে বিয়ে

বলিউডের সফল দম্পতি শাহরুখ-গৌরী। খান চলচ্চিত্র জীবন শুরু করার আগেই বিয়ে করেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর লুকিয়ে প্রেম করে দিল্লির সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে গৌরী শিবারকে ভালোবেসে বিয়ে করেন শাহরুখ খান। হিন্দু রীতিতেই গৌরীর গলায় মালা পরিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের ২৫ অক্টোবর। দুই ছেলে আরিয়ান, আবরাম ও মেয়ে সুহানাকে নিয়ে শাহরুখ-গৌরী খানের সুখের সংসার। মজার বিষয় হলো, গৌরীর পায়ের সৌন্দর্য দেখে প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন শাহরুখ। সে ঘোর নাকি এখনো কাটাতে পারেননি তিনি।

 

শাহরুখ-গৌরীর ভালোবাসার উপহার

শাহরুখ-গৌরী দম্পতির প্রথম সন্তান আরিয়ান খান। তাদের কন্যা সুহানা খান এবং সর্বশেষ আব্রাম খান। খান ইসলাম ধর্ম পালন করলেও তিনি তার স্ত্রীর ধর্ম হিন্দুকেও সম্মান করেন। তার সন্তানেরাও দুটি ধর্মই পালন করে।

 

রাস্তার বেঞ্চে ঘুমানো সেই ছেলেটি

মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেও যে পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে সফলতা অর্জন করা যায়Ñ সেটা কিং খান দেখিয়েছেন। একটা সময় তার কাছে না ছিল টাকা, না ছিল থাকার জায়গা। সেই জেদ নিয়েই তিনি বলেছিলেন এই মুম্বাই শহরকে তিনি জয় করে নেবেন। তিনি সত্যিই জয় করতে পেরেছিলেন। শুধু এই মুম্বাই শহরটিকে নয়, শহরের আনাচে-কানাচে কোটি কোটি লোকের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। 

 

অভিনয় জীবন শুরু...

একটি টিভি ধারাবাহিকে কাজ করার সুবাদে কিং খান অভিনয়জীবনে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে ‘দিল দরিয়া’ নামক এই সিরিয়ালে চুক্তিবদ্ধ হলেও কাজ শুরু হতে বিলম্ব হওয়ায় পরবর্তী বছরে ‘ফৌজি’ নামক টিভি সিরিয়ালে অভিনয় শুরু করেন। এই নাটকে তিনি ‘অভিমান্যু রায়’ নামের এক আর্মি ক্যাডেট চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন। পরে তিনি কাজ করেন ‘সার্কাস’ নামের আরেকটি ধারাবাহিকে। সার্কাসের পরেই তিনি ‘উমিদ’ নামে আরেকটি ধারাবাহিকে পার্শ্বচরিত্রে কাজ করেন। তিনি দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকেও প্রশিক্ষণ নেন।

 

রঙিন পর্দায় অভিষেক

১৯৯২ সালে দিব্যা ভারতীর বিপরীতে ‘দিওয়ানা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বড়পর্দায় যাত্রা শুরু হয় খানের। ছবিটি ব্যবসাসফল হয় এবং তিনি বলিউডে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। একই বছরে তিনি আরও কিছু চলচ্চিত্র যেমন চমৎকার, বিতর্কিত আর্ট ফিল্ম মায়া মেমসাহেবে অভিনয় করেন। ১৯৯৩ সালে বাজিগর ও ডর ছবিতে খলচরিত্রে অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পেয়ে যান শাহরুখ খান। ১৯৯৫ ছিল শাহরুখ খানের জন্য তো বটেই, পাশাপাশি বলিউডের নতুন ইতিহাস গড়ার একটি বছর। মুক্তি পায় শাহরুখ-কাজল জুটির ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’। এটি বক্স অফিসের আগের সব রেকর্ড ভাঙে, যার সব কৃতিত্ব পান শাহরুখ খান। ছবিটি ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি আয় করা ছবি হওয়ার গৌরব লাভ করে। ‘মারাঠা মন্দির’ নামক সিনেমা হলে ছবিটি চলেছিল টানা ১০০০ সপ্তাহ। বলা হয়ে থাকে, আদিত্য চোপড়া পরিচালিত এই ছবিটিই আসলে শাহরুখ খানকে ‘রোমান্টিক হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ছবিটি মোট ১৯টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছিল। এই চলচ্চিত্রটিই শাহরুখ খানকে ‘কিং অব রোমান্স’ উপাধিতে পরিচিত করে তোলে।

 

‘বলিউড কিং’ উপাধি

‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’র ব্যাপক সাফল্যের পর তিনি একে একে উপহার দিতে থাকেন বক্স অফিস কাঁপানো রোমান্টিক ঘরানার সব চলচ্চিত্র। এরপর ‘ডন’ সিরিজ এর প্রথম মুভি পাওয়ার পর শাহরুখ খান ‘বলিউড কিং’ উপাধি পান। লন্ডনের মাদাম তুসো জাদুঘরে কিং খানের মূর্তি রয়েছে।

 

প্রযোজক শাহরুখ

শাহরুখ খান বিভিন্ন ছবি প্রযোজনাতেও হাত দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি নির্মাতা আজিজ মির্জা ও অভিনেত্রী জুহি চাওলার সঙ্গে ড্রিমজ আনলিমিটেড নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্ট’। এদিকে নেটফ্লিক্সে আসবে তার প্রযোজিত নতুন ওয়েব সিরিজ ‘বেতাল’। বর্তমানে এর প্রচারে রয়েছেন কিং খান। ২৪ মে থেকে নেটফ্লিক্সে দেখা যাবে।

 

বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে

রোমান্টিক নায়ক হিসেবে খ্যাত হলেও শাহরুখ খান অভিনীত চরিত্রগুলোতে দেখা যায় বিভিন্ন চরিত্রের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। ডর কিংবা বাজিগরে দেখা যায় নির্দয় এক শাহরুখ খানকে। অন্যদিকে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’তে চমৎকার এক রোমান্টিক যুবক। আবার কাল হো না হো কিংবা দেবদাসে এক ব্যর্থ প্রেমিকের উপাখ্যান দেখা যায়। কিন্তু অ্যাকশন হিরো হিসেবেও শাহরুখ নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ডন সিরিজ, যাব তাক হেয় জান, শক্তি-দ্য পাওয়ার, ম্যায় হু না’তে দেখা মেলে অ্যাকশন হিরো শাহরুখের। কমেডি চরিত্রেও তিনি অনবদ্য। ডুপলিকেট, জোশ, ফ্যান, জিরো ছবি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

 

তার দুই বাদশাহী প্রাসাদ

বান্দ্রার ব্যান্ডস্ট্যান্ডের প্রায় শেষ প্রান্তে বলিউডের কিং খানের বাড়ি, নাম মান্নাত। প্রায় ২০০ কোটির প্রাসাদ মান্নাত। শাহরুখের দ্বিতীয় বাড়ির নাম ভলভো-বি৯ আর ভ্যান। বাড়ির আদলে এটি হলো গাড়ি। ফিল্মি দুনিয়ায় বলা হয় ভ্যানিটি ভ্যান।

 

ক্ষমতাশীল এস আর কে

বিশ্বের ৫০ ক্ষমতাশীল ব্যক্তির তালিকায় রয়েছেন এস আর কে। এ ছাড়াও ওয়েলথ-এক্স সংস্থার বিচারে বিশ্বের সব থেকে ধনী হলিউড, বলিউড তারকার তালিকায় শাহরুখ খান একসময় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। তার অভিনীত হে রাম, দেবদাস এবং পহেলি ভারত থেকে অস্কার এ পাঠানো হয়েছিল। তিনি ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয়দের কাতারে বিগ বি’র পরবর্তী স্থান এর শক্ত দাবিদার।

 

মানব দরদি কিং খান

বিপদে পড়ে কেউ খানের কাছে এসে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। বাবার নামে অ্যাসিড আক্রান্ত নারীদের সাহায্যের জন্য খুলেছেন ‘মীর ফাউন্ডেশন’। প্রতিবন্ধী, বন্যাদুর্গতদের পাশে সব সময় থেকেছেন বলিউডের নাম্বার ওয়ান খান। করোনা মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রাণ তহবিলে আড়াই কোটি রুপি দান করেন। পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ হাজার কিটও দিয়েছেন। কোয়ারেন্টাইন সেন্টার গড়তে চারতলা অফিস দিয়ে দেন শাহরুখ-গৌরী।

সেরা জুটি শাহরুখ-কাজল

বলিউডের অন্যতম সেরা জুটি হিসেবে স্বীকৃত শাহরুখ-কাজল জুটি। কাজলের সঙ্গে অভিনীত ‘বাজিগর’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘করন অর্জুন’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ও ‘কাভি খুশি কাভি গাম’ ব্যবসা-সফল হয়। কাজলের সঙ্গে তার অভিনীত দিলওয়ালে মুভিটি বলিউডে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

 

পুরস্কার ও সম্মাননা

খান চৌদ্দবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, পদ্মশ্রী পুরস্কার, সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিতসহ আইফা, রাজীব গান্ধী, বেস্ট ইন্ডিয়ান সিটিজেন ইত্যাদি সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে মরক্কোর ‘এল’ এতোইলি ডি’অর’ সম্মাননা, ফ্রান্স সরকারের ‘লিজিয়ান অফ হনার’, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেলোশিপ। একমাত্র ভারতীয় নায়ক হিসেবে হন দক্ষিণ কোরিয়ার ‘শুভেচ্ছাদূত’।

 

অনুপ্রেরণায় ইরফান

ইরফান খানের মৃত্যুতে মর্মাহত শাহরুখ খান। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইরফান খানের সঙ্গে নিজের সাদাকালো ছবি পোস্ট করে আবেগে ভাসেন কিং খান। শাহরুখ লিখেছেন, ‘আমার বন্ধু, আমার অনুপ্রেরণা, আমার সময়কার অন্যতম সেরা অভিনেতা। আল্লাহ আপনার আত্মাকে শান্তি দিক ইরফান ভাই।’

সর্বশেষ খবর