সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

আজাদ রহমান : চিরদিনের আত্মগোপন

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

আজাদ রহমান : চিরদিনের আত্মগোপন

সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান দৃশ্যমান জগতে নয় গ্রহ-নক্ষত্রের ওপারে চলে গেছেন। এখন মহাশূন্যে অপার্থিব সুরের অনুসন্ধান করবেন। অনন্ত জীবনের গান গাইবেন। নৈঃশব্দের বেদিতে সুরের সৌন্দর্য পান করবেন। আমি কাছে না গেলে কোনো দিন বুঝতে পারতাম না আজাদ ভাই কী মহৎ অন্তরের অধিকারী, কী তার গভীর জীবন-তৃষ্ণা। তিনি সংগীত জীবনের লক্ষ্যগুলোকে কীভাবে পরিণত করেছেন সংগীতের ঝরনায়। কীভাবে অবিরত তিনি সুরের তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত থেকে সংগীতের সুধা পান করেছেন। কীভাবে আত্মার ভিতর সুরের গোপনীয়তাকে অন্বেষণ করেছেন। কী অবিশ্বাস্য ভালোবাসায় উচ্চাঙ্গ সংগীত ও খেয়াল নিয়ে স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন, সে স্বপ্ন আজীবন ফেরিও করে গেছেন। তিনি একাধারে সুরকার, গীতিকার, শিল্পী ও সংগীত পরিচালক, বাংলা খেয়ালের পথিকৃৎ। জন্ম আমার ধন্য হলো মাগোÑ এই একটি গানে প্রমাণ করেছেন তার ভিতরে সুরের কত বৃহত্তর সমুদ্র বিরাজমান। যে গান বাংলার মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আত্মার গভীরতায় পৌঁছে গেছে। সুরের কী অসাধারণ অন্বেষণ, বিজ্ঞতার কী উচ্চমাত্রার পরিচয়। এই একটি গান আজাদ রহমানকে অভিনন্দন, প্রশংসা, খ্যাতির ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। একটি গান তার সংগীত জমিনকে প্লাবিত করে দিয়েছে। একটি গান তার জীবনের চারপাশে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে। লোভ-মোহ-অহমিকা জীবনের মৌলিক সত্তা থেকে আজাদ রহমানকে কোনো দিন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তিনি সব ধরনের আচ্ছাদনের আড়ম্বর থেকে মুক্ত। তিনি সর্বদাই তার কর্মের মর্যাদায় উজ্জ্বল। তিনি সংগীতের উদ্ভব গঠন ও ইতিহাস নিয়ে গভীরতর চর্চা করেছেন। আজাদ রহমান সংগীতের দায়বদ্ধতা সঙ্গে নিয়েই অবিরাম পথ হেঁটেছেন। সংগীতের সেই পথটি তিনি অনুসরণ করেছেন যার শুরু আছে শেষ নেই। সংগীত-কেন্দ্রিক বহু অনুষ্ঠানে আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তিনি স্বল্পবাক কিন্তু অসাধারণ বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। প্রবলভাবে মনকে আলোড়িত করতেন, অনুপ্রাণিত করতেন, সুরের শুদ্ধতা সম্পর্কে তীক্ষèভাবে সচেতন করতেন, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস জোগাতেন। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা জীবন ও জগতের নানাবিধ সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্য সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই গভীর ও সচেতন। আকাক্সক্ষা লক্ষ্য ও গন্তব্য নিয়ে ছিলেন আত্মমগ্ন। তিনি মানুষ হিসেবে তীব্র আত্মসচেতন, অতীব পরিমার্জিত ও প্রগাঢ় ছিলেন।

আজাদ রহমানের সুরে আমার অন্তত একটি গান করার গোপন ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিনের। তিনি সম্মতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার নিম্নমানের অহমিকা ও অদূরদর্শিতার কারণে আমার অন্তরাত্মার গোপনীয়তা আর কোনো দিন পূর্ণ হবে না। এখন আমার অনেক অনুশোচনা হচ্ছে। আজাদ রহমানের সুরে আমার একটা গান থাকলে তা আমার গানের আকাশে রংধনু  হয়ে থাকত। ভালোবাসার মূল্য কত, ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, মনেরও রঙে রাঙাবো, ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়Ñ এমন অসংখ্য গানের অধিনায়ক আজাদ রহমান। তিনি সংগীতের উচ্চতম জায়গায় অবস্থান নিয়ে ছিলেন।

সারা জীবন ভ্রমণ করেছেন সংগীতের গভীরতায়। তিনি  আমাদের  অহংকার। কিন্তু সেই আজাদ রহমানকে চিরদিনের মতো, চিরকালের জন্য, চির জনমের বিদায় দিতে যেতে পারলাম না করোনার সর্বগ্রাসী ভয়ে। এ কেমন বেঁচে থাকা, এ কেমন দহনকাল। আমার পরম আপনজন চলে যাবেন চিরতরে আর আমি ঘরে বসে থাকব এটা কোন জনমের পাপের প্রতিদান। এ বেঁচে থাকা লজ্জাজনক। এ কেমন অভিশপ্ত প্রকৃতি। আজাদ ভাই, সেলিনা আপা ক্ষমা করবেন জানাজায় যাইনি বলে। করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে জানাজায় না গেলে অনন্ত জীবনের অধিকারী হওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর