বুধবার, ২০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

সুচিত্রা কেন অন্তর্ধানে ছিলেন

 সুচিত্রা কেন অন্তর্ধানে ছিলেন

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ১৯৫২ সালে রুপালি পর্দায় এলেন, জয় করলেন। এই বিজয়ের ধারা ২৬ বছর গড়িয়ে ১৯৭৮ সালে এসে থামল। ওই বছরই মহানায়িকা নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে নিলেন। কিন্তু কেন এই অন্তর্ধান তার, সেই রহস্য তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যে কারণে অন্তর্ধান...

‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো...’ সত্যি, সুচিত্রা সেনের পথ শেষ হয়নি। নশ্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেলেও বিশ্বজুড়ে কোটি দর্শক ভক্তের হৃদয়ে এখনো অবিনশ্বর হয়ে আছেন তিনি। সেই ভুবন মোহিনী হাসি, মায়াভরা চেহারা আর অভিনয় দক্ষতা এখনো আবালবৃদ্ধবনিতার ঘুম হরণ করে চলেছে। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে সেলুলয়েডের রুপালি জগতে তার পদচারণা শুরু। যদিও তার এই প্রথম ছবিটি আলোর মুখ দেখেনি। তার পরে শুধু ইতিহাস। এই ইতিহাসের সমাপ্তি ১৯৭৮ সালে। এই বছর এ মহানায়িকা নিজেকে জগৎসংসার থেকে আড়াল করে নিলেন। চলে গেলেন অন্তর্ধানে। কিন্তু কেন? এ বিষয়ে এই মহানায়িকা কখনো মুখ না খুললেও তাকে নিয়ে যারা গবেষণায় ব্রত ছিলেন তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিক লেখক শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন সাধনাতেই ব্রতী ছিলেন। সাধনার কারণে অন্তর্ধানে চলে যাওয়ায় সে সময়ে তাকে কম ব্যঙ্গ, কটু কথা, অপমানজনক মন্তব্য শুনতে হয়নি। কেউ বলেছে নিজের বাজার পড়ে যাচ্ছে জেনে নির্বাসন, কেউ বলেছে শ্বেতী হয়ে গেছে, কেউ আবার রটিয়েছে ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে তার, তাই স্বেচ্ছা নির্বাসন। কেউবা বলেছে, বিগত যৌবনা নায়িকা হয়ে গেলে সরে যেতেই হয়। কিন্তু এসব কোনো কিছুই টলাতে পারেনি সুচিত্রার সাধনা। তিনি নিজের চিত্তে অবিচল থেকেছেন। তার নির্বাসন ব্রতর প্রথম শর্ত লোভ, মোহ ত্যাগ করা, নিজেকে ইহজগতের মোহ থেকে মুক্ত করার দীক্ষামন্ত্র সুচিত্রাকে দিয়েছিলেন ভরত মহারাজ। শোনা যায়, ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবি ফ্লপ করার পরে সুচিত্রা ছুটে গিয়েছিলেন ভরত মহারাজের কাছে। ‘প্রণয় পাশা’র গল্পটা ভালো ছিল, কিন্তু ছবিটা চলল না বলে ভেঙে পড়েছিলেন সুচিত্রা। ছুটে যান বেলুড় মঠে গুরু ভরত মহারাজের কাছে। ভরত মহারাজ বলে দেনÑ ‘মা, লোভ কোরো না’। ওই মন্ত্রই যেন সুচিত্রা নিজের শেষ জীবন অবধি চলার পথে পাথেয় করে নেন। সমস্ত লোভ ত্যাগ করার জন্য ঘরে বন্দী করে ফেলেন নিজেকে। এই ঘটনার দুই বছর পরে ১৯৮০ সালে সাংবাদিকদের ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতে মহানায়ক উত্তম কুমারের বাড়িতে একবারই গিয়েছিলেন সুচিত্রা। উত্তম কুমারের নিথর দেহে মালা পরাতে। আত্ম গৃহবন্দী সুচিত্রা সেনের কাছে যেতে পারতেন শুধু মেয়ে মুনমুন আর দুই নাতনি নয়না। অন্তরাল হওয়ার বুদ্ধি সুচিত্রাকে দেন কানন দেবীও। শেখান, বাজে ছবি করে যেন অর্জিত সুনাম না নষ্ট করেন সুচিত্রা। এই সময়ে যখন নির্বাচন কমিশন ভোটার কার্ডে ছবি তোলা বাধ্যতামূলক করল, সুচিত্রা সেনও গেলেন ছবি তুলতে। সে খবরও আগের রাতে রটে গেল খবরের কাগজের অফিসগুলোয়। কিন্তু ফ্রেমবন্দী করা সম্ভব হয়নি তাকে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের সামনের রাস্তায় ভিড় জমাই সার হয়েছিল। তবে ভোট দিতে যাওয়ার সময়ে সমস্যা হয়। ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজেই সেন পরিবারের ভোট দেওয়ার বুথ। বিভিন্ন কাগজের সাংবাদিকরা আগের দিন রাত থেকে সেখানে ঘাঁটি গেড়ে লুকিয়ে থাকলেন। কেউ আবার ছদ্মবেশে থাকলেন গোপনচারিণীকে ফ্রেমবন্দী করতে। সুচিত্রা তার চেনা প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়ি থেকে নামতেই শাটার পড়ল কয়েক হাজার। সাদা চিকনের চুড়িদার পরে সুচিত্রা ধরা পড়ে গেলেন দুই দশক পরে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তিনি। এলো চুল, চোখে চশমা, চিকনের সাদা চুড়িদার হাত গোটানো কী অসম্ভব স্মার্ট সেই ৬৫ পেরোনো বৃদ্ধা। যেন একেবারেই সিনেম্যাটিক ব্যাপার, একটা সিনেমার প্লট। শোনা যায়, তার পরিবারের লোকজনের কাছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও তার অবাধ যাতায়াত ছিল। কারও বান্ধবী সুচিত্রা, কারও সুচিত্রা পিসি, কারও মা, আম্মা, কারও সুচিত্রা মাসি তিনি। তিনি ‘মেশো কিন্তু মিশে যেওনা’-তে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই যাদের সঙ্গে মিশতেন, সেখানেও একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে রাখতেন। এ জন্যই শেষ জীবন পর্যন্ত থাকতে পেরেছিলেন অন্তরালে। ২০০৫ সালে তাকে ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ দেওয়ার কথা উঠলেও তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করতে চাকচিক্যের দুনিয়ায় পা ফেলতে চাননি। তিনি পুরস্কারটি ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং স্পষ্টতই পুরস্কারটি তিনি আর পাননি। না কোনো অবসাদ, না কোনো রোগ, না কোনো বিকার। কেবল অবসর। সুচিত্রা নিজের সেরা সময়টা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তাই হয়তো সংবাদমাধ্যমগুলোর কৌতূহল কখনো কমেনি তাকে ঘিরে। সুচিত্রার এই অন্তরাল যাপন তো শুধু রহস্য নয়, এত এত হিট গান, সুপার ডুপার হিট ছবি, এত রূপের ছটাকেও বাঁচিয়ে রাখা। যেদিন সুচিত্রা রুপালি পর্দা থেকে সরে গেলেন, সেদিন থেকেই তার নতুন লড়াই শুরু হয়েছিল। তার সমসাময়িক নায়ক-নায়িকারা ভাবতেও পারেন না এমনটা। কিন্তু সেই কঠিন কাজটা সুচিত্রা করে দেখিয়েছেন। তাই তো তিনি বাঙালির গ্রেটা গার্বো। গ্রেটা গার্বো আর সুচিত্রা দুজনের জীবননাট্য অনেকটাই এক। শরীরে সময়ের পদধ্বনি টের পাচ্ছিলেন তারা। তাই নিজেকে সরিয়ে নিলেন লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের বাইরে জীবন যৌবনে গ্রেটা গার্বো অনেক একাকিনী ছিলেন। সুচিত্রা সে অর্থে অতটা একা ছিলেন না। শোনা যায়, সুচিত্রা সেন ছিলেন এমনিতেই ‘ভেরি প্রাইভেট পার্সন’। যখন ফিল্মে কাজ করতেন, তখনো তাকে সামনাসামনি কমজনই দেখতে পেতেন, শুটিংয়ের বাইরে, নিজের কাজের বাইরে পার্টিও করতেন না তিনি। এড়িয়ে চলতেন মিডিয়া।

 

বন্দী জীবনে যা করতেন...

সবার একটা বড় কৌতূহল ছিল, বন্দী জীবনে ঠিক কী করতেন সুচিত্রা? সুচিত্রা সেন যে সারা দিন পুজো করতেন ঠাকুরঘরে, এটা একটা মিথ। এমনটা মোটেই নয়, এ কথা বলেছেন তার কন্যা মুনমুন সেনই। সুচিত্রার নিজের শোয়ার ঘরের পাশেই ছিল ঠাকুরঘর। ঠাকুর রামকৃষ্ণ, মা সারদা, বিবেকানন্দর ছবি। স্নান সেরে পুজোয় বসতেন তিনি। ঠাকুরকে দেওয়া জিলিপি ছিল রামকৃষ্ণদেবের প্রিয়। পুজো বলতে ধ্যান, আর ঠাকুরের সিংহাসন ফুল দিয়ে সাজানো। কিন্তু তার মানে এই নয় সারা দিন ঠাকুরঘরে পড়ে থাকতেন। বরং সুচিত্রার সময় কাটত ধর্মপুস্তক পড়ে। রীতিমতো ধর্মীয় সাহিত্য নিয়ে চর্চা করতেন। তার বাড়িতে আসতেন বেলুড় মঠের মহারাজরাও। চলত আধ্যাত্মিক আলোচনা। একবার দক্ষিণেশ্বরে ভিড়ের মধ্যেই ঘোমটা দিয়ে ভবতারিণী দর্শনে মন্দিরে চলে গিয়েছিলেন। প্রণাম করেন হাঁটু গেড়ে। ততক্ষণে লোক জড়ো হয়ে গেছে। কোনোমতে বেরিয়ে আসেন। বেলুড় যখন বন্ধ থাকত রাতের বেলা জনসাধারণের জন্য, তার বলা থাকত আগে থেকেই। রামকৃষ্ণর মন্দিরে গিয়ে একমনে ধ্যান করতেন, তার পরে ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসতেন। ভরত মহারাজ মারা গেলেন যখন সাদা ঢাকাইতে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে, সানগ্লাস পরে, মেয়ে মুনমুনকে নিয়ে সুচিত্রা নিজে গিয়েছিলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

রিয়া-রাইমা স্কুল থেকে ফিরে সোজা চলে যেত দিদিমা সুচিত্রার কাছে। তখন মুনমুন ছবি করছে টলিউডসহ সাউথেও। রাইমা-রিয়া তাই সুচিত্রাকেই মা বলে ডাকত। মুনমুনকে মাম কি মাম্মি। নাতনিদের নিয়ে সুচিত্রা বিকালে যেতেন লাভার্স লেনের ক্লাবে। সঙ্গে থাকতেন কখনো সাংবাদিক বন্ধু। নাতনিদের স্কেচ পেন কিনতে নিয়ে যেতেন থিয়েটার রোড এসি মার্কেটে। লম্বা কালো চুড়িদার বা শাড়ি, কিন্তু মুখ ঢাকা বড় গোগো সানগ্লাস সঙ্গে রুমাল। মানুষের ছেঁকে ধরা এড়াতেই তার এই পন্থা। বহু উকিল বন্ধু, ডাক্তার বন্ধুর বাড়ি যেতেন যখন তখন তাদের সঙ্গে মুখ না ঢেকেই গল্প করতেন। একবার তো তৎকালীন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করে নিজের বাড়িতে খাওয়ান সুচিত্রা। এভাবেই নিজের জগতে নিজের পছন্দের লোকদের মাঝে আনন্দ করেই জীবন কাটিয়েছেন সুচিত্রা। যেমন একবার মুনমুনের বান্ধবী হওয়ার সূত্রে অভিনেত্রী আলপনা গোস্বামীকে সুচিত্রা নিজহাতে ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে খাওয়ান। রোজই প্রায় বেশি রাতের দিকে পরিচারিকাকে নিয়ে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড় অবধি হেঁটে বেড়াতেন। বলতেন, আমি এ পাড়ার মেমসাহেব। শোনা যায়, অনেক ফ্যানও দাঁড়িয়ে থাকত, কেউ যদি দেখতে পায়। বালিগঞ্জ ধাবা থেকে তড়কা রুটিও কিনেছেন কখনো কখনো। যত দিন পেরেছেন হাঁটতে বেরোতেন। তবে শেষ দশ বছর আর বেরোননি। ফ্ল্যাটের আবাসিকরাও কেউ কখনো দেখেননি তাকে। সুচিত্রার পাশের ফ্ল্যাটই মুনমুনের। মুনমুনের বাড়িতে বন্ধুরা এলেও সুচিত্রার সাম্রাজ্য ঠিক পাশে থেকেও যেন রহস্যে মোড়া। তবে সুচিত্রার ছোটবেলার কয়েকজন বান্ধবী সুচিত্রার বাড়িতে যেতেন। এ ছাড়া বড়দি, সেজো বোন, ছোট বোন, ভগ্নিপতি, তাঁদের ছেলেমেয়ে, সবার খুব আপন ছিলেন সুচিত্রা। নিজের জন্মদিন তাদের নিয়ে কাটাতেন। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী তাকে দেখতে হসপিটালে গেলেও দেখা করেন সুচিত্রা একবার। বাড়িতে থাকা পরিচারিকাদের লেখাপড়া শেখাতেন সুচিত্রা। দুজন যমজ যুবক ছিলেন, তার দেখাশোনা করার জন্য। তাঁরা মা বলে ডাকতেন সুচিত্রাকে। পাখিদের জল-ছোলা খাওয়ানো ছিল সুচিত্রার একটি প্রিয় কাজ। কত কাক, পায়রা, পাখি রোজ এসে বসত সুচিত্রার বারান্দায়। নিজে হাতে খাওয়াতেন তাদের। নিজের কাজ নিজেই করতেন যতদিন পেরেছেন। টুকটাক চিকিৎসাও করে নিতেন ঘরোয়া টোটকায়। মৃত্যুর পরেও যাতে আড়াল বজায় থাকে, তাই তাঁর শেষযাত্রা যাতে সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অনুরোধও করেছিলেন সুচিত্রা। তাঁর ইচ্ছে মেনেই, শেষযাত্রাতেও কফিনে মুড়ে বের করা হয় সুচিত্রার দেহ। ইচ্ছানুসারে চুল্লিতে নয়, চন্দনকাঠের দাহতে সুচিত্রার দেহ পোড়া ধোঁয়া মিশে যায় আকাশে। ১৯৭৮ থেকে ২০১৪ সাল, না-দেখা, ও  না-জানা কৌতূহল নিয়েই তিনি থেকে যান বাঙালির জনমানসে।

সর্বশেষ খবর