বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

দুই ছবিতে অঞ্জু ঘোষের রেকর্ড

দুই ছবিতে অঞ্জু ঘোষের রেকর্ড

১৯৫৬ সালে ঢাকাই সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরুর পর অনেক নায়িকা আসেন। কর্মদক্ষতা দিয়ে প্রতিষ্ঠাও পান। এদের মধ্যে একজন অঞ্জু ঘোষ। ১৯৮২ সালে সওদাগর ছবির মাধ্যমে অভিষেক তার। প্রথম ছবিতেই সফল এই অভিনেত্রীকে সবাই চেনেন বেদের মেয়ে জোসনা নামে। তাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

আশির দশক। তখনো শাবানা, ববিতা, কবরীর মতো জনপ্রিয় অভিনেত্রীরা দাপিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এফ কবির চৌধুরী সব সময়ই ফোক ফ্যান্টাসি এবং রোমান্টিক ছবি নির্মাণ করে থাকেন। তার ছবিতে দর্শকদের তিনি সব সময়ই নতুনত্ব দিতে চান। এই চিন্তা থেকেই ১৯৮২ সালে কবির চৌধুরী যখন ‘সওদাগর’ ছবিটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন ঠিক করলেন এতে নায়িকা হিসেবে নতুন মুখ উপহার দেবেন তিনি। এরই মধ্যে অনেক মেয়ে দেখা হয়ে গেছে তার, কিন্তু মনে ধরল চট্টগ্রামে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করা শিল্পী অঞ্জু ঘোষকে। চট্টগ্রামে তখন মঞ্চ নাটকের জয়জয়কার। চট্টগ্রাম মুসলিম হল মিলনায়তনে আঞ্চলিক নাটক তখন দর্শক মন কাঁপিয়ে চলছে। আর এসব নাটকের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিলেন অঞ্জু ঘোষ-পংকজ জুটি। (পংকজ বদ্য পরে সুজন নামে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।) নির্মাতা এফ কবির চট্টগ্রামে গিয়ে বেশ কিছু আঞ্চলিক নাটক দেখেন এবং অঞ্জুর অভিনয়ে মুগ্ধ হন। ব্যস, ১৯৮২ সালে অঞ্জু ঘোষ আর তখনকার পোশাকি ছবির জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিমকে জুটি করে নির্মাণ করলেন ‘সওদাগর’ ছবিটি। মুক্তির পরে ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে দর্শক রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অঞ্জুর ভিন্নমাত্রার আবেদনময়ী অভিনয়, নাচ আর তির্যক চাহনিতে কুপোকাত দর্শক। ফলশ্রুতিতে ‘সওদাগর’ সুপারহিট আর অঞ্জু ঘোষ প্রথম ছবিতেই ঢাকাই সিনেমা জগতে নিজের স্বতন্ত্র ও পোক্ত আসন গড়ে নিলেন। তার মোহময়ী হাসিতে পুরুষরা ছিল পাগলপারা। যাত্রাপালার মাধ্যমে পথচলা শুরু হলেও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করেন। ওই সময় গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে অঞ্জু ঘোষ মানেই সিনেমা হিট। তাকে দেখার এবং তার মন ভোলানো হাসির জন্য সিনেমা হলে ভিড় লেগে থাকত। তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া তোজাম্মেল হক বকুল নির্মিত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটি এখনো মাইলফলক হয়ে আছে। তাই বলা যায়, ১৯৮২ সালে অঞ্জু অভিনীত প্রথম ‘সওদাগর’ আর ১৯৮৯ সালের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবি দুটি অঞ্জুর চলচ্চিত্র জীবনের প্রধান রেকর্ড। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ করে রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যান অঞ্জু ঘোষ। এই ছবির ব্যবসায়িক রেকর্ড আজ পর্যন্ত অন্য কোনো ছবি ভাঙতে পারেনি। বাংলাদেশের শহর-বন্দর থেকে একেবারে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ছিল বেদের মেয়ে জোসনা আর অঞ্জু বন্দনা। ছবিটির এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার কারণে পরে এটি কলকাতায় রিমেক হয়।

 

অঞ্জু ঘোষের সাতসতেরো...

অঞ্জুর প্রকৃত নাম অঞ্জলি ঘোষ। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অঞ্জু এবং তার পরিবার চলে আসেন চট্টগ্রামে। সেখানকার কৃষ্ণকুমারী গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। আর তখন থেকেই শুরু হয় তার নাচ শেখা। প্রথমে অঞ্জু ঘোষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরার হয়ে যাত্রায় নৃত্য পরিবেশন শুরু করেন। পরে মঞ্চ নাটকে নিয়মিত হন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মোট ৬টি ভাষার শতাধিক চলচিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি বাংলার নীলো নামে পরিচিত ছিলেন। নীলো হলেন পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় একজন নায়িকা। ১৯৮৭ সালে অঞ্জু সর্বাধিক ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮৯ সালে তার অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ অবিশ্বাস্য রকমের ব্যবসা করে এবং সৃষ্টি করে নতুন রেকর্ড। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯০ সালে তার গাওয়া ১২টি গান নিয়ে ‘মালিক ছাড়া চিঠি’ নামের একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যান এবং সেখানকার চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করে যান। পাশাপাশি সেখানকার যাত্রাপালাতেও অভিনয় করতে থাকেন। ২০০৪ সালের দিকে কলকাতার বড় পর্দায় তার চাহিদা কমলেও যাত্রাপালায় সরব ছিলেন এই অভিনেত্রী। ২০০৮ সাল পর্যন্ত যাত্রা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কাজের ফাঁকে ২০০২ সালে বিয়ে করেন সহশিল্পী সঞ্জীবকে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত টিকেছিল অঞ্জু-সঞ্জীবের সংসার। একদিকে বিবাহবিচ্ছেদ, অন্যদিকে বয়সের কারণে যাত্রামঞ্চে চাহিদা কমে যাওয়া, এসব নিয়ে একসময় অসহায় ও একাকী জীবন কাটাতে থাকেন অঞ্জু ঘোষ। বর্তমানে অঞ্জু ঘোষের সময় কাটে ধর্মচর্চা আর সংগীতচর্চা করে। তিনি কলকাতার সল্টলেকে ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঘরের কাজকর্ম তিনি নিজেই করতে পছন্দ করেন। টেলিভিশনে খবর দেখেন তবে টিভি সিরিয়াল দেখা তিনি পছন্দ করেন না। অবসর সময়টা ভাগ করে নেন নিজের ভাইয়ের বাচ্চাদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সাইদুর রহমান সাইদ পরিচালিত চলচ্চিত্র, মধুর ক্যান্টিনে অভিনয়ে চুক্তিবদ্ধ হন। ছবিটির নির্মাণ কাজ এখনো শুরু হয়নি।

 

অঞ্জু কেন দেশ ছাড়লেন...

চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকাকালীনই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন অঞ্জু ঘোষ। কেন তিনি দেশ ছেড়েছিলেন?

এমন প্রশ্নে কখনই এই অভিনেত্রী মুখ না খুললেও তার অভিনয় জীবনের অন্যতম একজন গুরু প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সাইদুর রহমান সাইদ জানান, তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকেই তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। ‘র’ আদ্যাক্ষরের এক নায়কের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের প্রেম ছিল। সেই নায়ক হঠাৎ অন্যত্র বিয়ে করে বসলে হতাশ হয়ে পড়েন অঞ্জু। ক্ষোভের বশে বিয়ে করেন চিত্রপরিচালক এফ কবির চৌধুরীকে। সেই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। তাছাড়া কতিপয় মাস্তান তার পিছু নেয়। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে কলকাতায় পাড়ি জমান অঞ্জু। তবে অঞ্জু বলেন, ‘ওই সময় যে ধরনের অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব আসছিল সেটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। সাজ পোশাক সবকিছুতে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। তাই সিনেমা করা ছেড়ে দিলাম।’ তার কথায় দেশের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে তার কাছে মধুর মনে হয়। কারণ এ শহরেই তার বেড়ে ওঠা। এখান থেকেই তার অভিনয় যাত্রা শুরু।     

 

উল্লেখযোগ্য ছবি...

সওদাগর, বড় ভালো লোক ছিল, নরম গরম, আশীর্বাদ, আবে হায়াত, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, রাই বিনোদিনী, বেদের মেয়ে জোসনা, প্রাণ সজনী, পদ্মাবতী, সোনাই বন্ধু, আয়না বিবির পালা, আশা নিরাশা, মালা বদল প্রভৃতি।

সর্বশেষ খবর