শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যেভাবে চলচ্চিত্রে বিউটি কুইন শাবানা

নয় বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে রত্না এলেন চলচ্চিত্রে। সেই রত্না এক সময় অভিনয় দক্ষতা আর মোহনীয় রূপ দিয়ে হয়ে গেলেন ঢালিউডের বিউটি কুইন শাবানা। এই অভিনেত্রীর আদ্যপান্ত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

যেভাবে চলচ্চিত্রে বিউটি কুইন শাবানা

ছবি : নিকিতা

ভিন্ন ধাঁচের এক বিউটি কুইন...

  ‘আমি ভাত চুরি করি নাই তো। খিদা লাগে, খাই’- প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের এই সংলাপ একজন ক্ষুধার্ত মানুষের অসহায়ত্বের হাহাকার। এমন মর্মস্পর্শী সংলাপ একমাত্র শাবানার মতো একজন বলিষ্ঠ অভিনেত্রীর পক্ষেই পর্দায় জীবন্ত করে তুলে ধরে দর্শকের অশ্রু ঝরানো সম্ভব হয়েছে। এ ছবিতে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এলোমেলো জরির জীবনের গল্প করুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। এ কারণেই দর্শক হৃদয় তোলপাড় করার পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন। চলচ্চিত্রে অভিষেকের ২০ বছর পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এই চরিত্রের জন্য বাড়তি নজর কাড়েন শাবানা। এমনটাই জানালেন শাবানার এক গুণমুগ্ধ দর্শক সারাহ তামান্না। শাবানার অভিনয়কে ভালোবেসে অনিন্দ্য সুন্দরী এই অভিনেত্রীকে তার দর্শক-ভক্তরা ‘বিউটি কুইন’ উপাধি দিতে ভোলেননি।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে...

মাত্র ৯ বছর বয়সে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের হাত ধরে চিত্র জগতে অভিষেক শাবানার। তবে তখন তার নাম শাবানা নয়, ছিল রত্না। আজিজুর রহমান তাকে নিয়ে যান তার গুরু আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের কাছে। এহতেশামের আগ্রহেই ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে নাম লেখান তারই পরিচালনার ছবি ‘নতুন সুর’-এ। এরপর  নিয়মিত না হলেও ১৯৬৬ সালে ইবনে মিজানের ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে এবং মুস্তাফিজের ‘ডাক বাবু’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে কাজ করেন তিনি। প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতার সময়ে রত্না হিসেবে পরিচিত হলেও এহতেশামই পরে তার ‘চকোরী’ ছবিতে নাম দেন শাবানা। ১৯৬৭ সাল, বাংলা চলচ্চিত্রে আবির্ভাব ঘটল এক নতুন অভিনেত্রীর। উর্দু ছবি ‘চকোরী’তে প্রধান নারী চরিত্রে নায়ক নাদিমের বিপরীতে লাস্যময়ী তরুণীর সাবলীল অভিনয় দিয়ে শাবানা নজর কাড়লেন  দর্শকদের। ৮১ সপ্তাহ ধরে চলা এ ছবিতে চকোরী চরিত্রে শাবানাকে ভালো লেগে যায় দর্শক নির্মাতার। উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘চকোরী’ ছবিটি শাবানার খ্যাতি পৌঁছে দিয়েছিল সুদূর করাচি, পিন্ডি, পেশোয়ার, কোয়েটা, মারী পর্যন্ত।

সে বছরই ‘জংলী মেয়ে’, ‘কুলি’, ‘ছোট সাহাব’ মুক্তি পায়। এরপর দুই বছর উর্দু ছবি ‘চান্দ অউর চান্দনি’, ‘পায়েল’, ‘আনাড়ি’, ‘দাগ’-এ অভিনয় করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘বিজলী’ ছবিতে। চার্লস ডিকেন্সের অনবদ্য সৃষ্টি ‘অলিভার টুইস্টে’র ছায়া অবলম্বনে তৈরি এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে সুনাম কুড়ান শাবানা। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৭০-এ মুস্তাফিজের সঙ্গে ‘একই অঙ্গে এত রূপ’সহ কাজী জহিরের সঙ্গে প্রথমবার কাজ করেন ‘মধুমিলনে’।  অভিজাত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে বক্স অফিস ও দর্শকের মনেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপর ১৯৭২ সালটি ছিল শাবানার জন্য সোনালি সময়ের আরম্ভ। কাজী জহিরের অবুঝ মন-এর জমিদার কন্যা, চাষি নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’-এর মিতাসহ সব চরিত্রেই চূড়ান্ত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় অভিনয়ের ক্ষেত্রে জুটি হিসেবে কাজ করেছেন নাদিম, রাজ্জাক, ফারুক, জসিম, জাভেদ, সোহেল রানা, বলিউডের রাজেশ খান্না প্রমুখের সঙ্গে। ঢাকার চলচ্চিত্রে ৩০ বছর ধরে শাবানা রাজত্ব করেছিলেন। একাধারে এত রাজত্ব আর কোনো তারকা করতে পারেননি। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শুধু তার নামেই সিনেমা চলত। কোনো ছবিতে শাবানা আছেন শুনলেই এখনো টিভির সামনে ভিড় হয় দর্শকের।

 

চট্টগ্রামের মেয়ে শাবানা...

চাকরিজীবী ফয়েজ চৌধুরী এবং গৃহিণী ফজিলাতুন্নেসার ঘর আলো করে ১৯৫২ সালের ১৫ জুন জন্ম হয় আফরোজা সুলতানা রত্নার। চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের ডাবুয়া গ্রামে তার জন্ম।

সবচেয়ে বেশি ছবি আলমগীরের সঙ্গে

শাবানা অভিনীত ২৯৯টি ছবির মধ্যে ১৩০টিতেই তিনি জুটি বেঁধেছেন অভিনেতা আলমগীরের সঙ্গে। শাবানা-আলমগীর জুটির অনবদ্য রসায়ন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে এখনো অমর হয়ে আছে।

যত সম্মাননা...

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সঙ্গে বেশ সখ্যই ছিল শাবানার। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মোট ১১ বার জয় করে নেন এই সম্মাননা। তবে প্রথমবার ১৯৭৭ সালে প্রত্যাখ্যান করেন ‘জননী’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রের জন্য পাওয়া এ পুরস্কারটি। ১৯৮০ থেকে ৮৪ সাল টানা জয় করেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। এর মাঝে ১৯৯০ সালে সেরা প্রযোজক হিসেবেও জয় করেন এটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। এছাড়াও শাবানা পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার (১৯৮২ ও ১৯৮৭), আর্ট ফোরাম পুরস্কার (১৯৮৪, ১৯৮৮), সায়েন্স ক্লাব পুরস্কার (১৯৮৪), কথক একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৯), নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৮৮), প্রযোজক সমিতি পুরস্কার (১৯৯১), কামরুল হাসান পুরস্কার (১৯৮৭), নাট্য নিকেতন পুরস্কার (১৯৮৫), ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৫)। শাবানার ঝুলিতে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রুমানিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ আরও বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে।

 

বিয়ে, প্রযোজনা ও অভিনয় থেকে অবসর...

বিয়ে হওয়ার মানে যে ফুরিয়ে যাওয়া নয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শাবানা। ১৯৭৩ সালে এক সুতোয় জীবন বাঁধেন সরকারি কর্মকর্তা ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে। পরবর্তীতে দুজনে মিলে গড়ে তোলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ‘এস এস প্রোডাকশন’। এ সংস্থা থেকে ১৯৭৯ সালে আজিজুর রহমানকে দিয়ে শাবানা প্রথম প্রযোজনা করেন ‘মাটির ঘর’ ছবিটি। প্রায় ২৫টির মতো ছবি প্রযোজনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে যৌথ প্রযোজনার ছবিও রয়েছে। ১৯৯৭ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছবিই তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে সপরিবারে থিতু হন । তার পরিবারে স্বামী ছাড়াও আছেন বড় কন্যা সুমি ইকবাল, ছোট মেয়ে ঊর্মি সাদিক ও পুত্র নাহিন সাদিক।

সর্বশেষ খবর