রবিবার, ৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

শাবানা-জাভেদ দম্পতির সাত সতেরো

শাবানা-জাভেদ দম্পতির সাত সতেরো

বলিউড সাম্রাজ্যে সত্তর দশকে দুই নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। একজন অভিনেত্রী শাবানা আজমি, অন্যজন কবি, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার। দুজনের সৃজনশীল কাজে বলিউড পায় অনন্য সমৃদ্ধি। এক সময় দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। এই দম্পতির কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও আলী আফতাব

 

শাবানা-জাভেদের জটিল প্রেম পরিণয়

সত্তর দশকের শেষভাগে বেঞ্জামিন গিলানির সঙ্গে শাবানা আজমির বাগদান সম্পন্ন হয়। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শনে তাদের পরিচয় হয়, কিন্তু আজমির উঠতি খ্যাতি সামলাতে না পেরে গিলানি এই বাগদান বাতিল করেন। পরে শেখর কাপুরের সঙ্গে তার সাত বছর সম্পর্ক ছিল। ১৯৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি কবি, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এটি ছিল জাভেদ আখতারের দ্বিতীয় বিবাহ, আগে তিনি বলিউডের চিত্রনাট্যকার হানি ইরানিকে বিয়ে করেছিলেন। শাবানা আজমির চলচ্চিত্র জীবনের মতো ব্যক্তিগত জীবনও রঙিন। বলা যায়, গীতিকার তথা কবি জাভেদ আখতার এবং শাবানা আজমির প্রেমকাহিনি কোনো সিনেমার চেয়ে কম ছিল না। ১৯৭০ সালে শাবানার বাবা কাইফি আজমির কাছে জাভেদ লেখালেখির শিল্পকলা শিখতে আসা শুরু করেন। সেই সূত্রে শাবানার সঙ্গে রোজ দেখা হতো তার। এভাবে একে অপরের কাছে আসতে শুরু করেন। বাড়িতে জাভেদের স্ত্রী হানি ও দুই সন্তান ফারহান এবং জোয়া আখতার রয়েছে। তারপরও জাভেদ-শাবানা একে অপরের প্রেমে রীতিমতো পাগল। হানি জানতে পারেন তার স্বামীর সঙ্গে শাবানার এই সম্পর্কের কথা। এ নিয়ে জাভেদের সঙ্গে হানির নিত্য অশান্তি শুরু হয়। অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছলেও জাভেদ তার সন্তানদের ছেড়ে বেরিয়ে আসতে রাজি হননি। অবশেষে এই রোজকার অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে হানি তার স্বামীকে শাবানার কাছে চলে যাওয়ার সম্মতি দেন। হানি জাভেদকে ভরসা দেন যে

সন্তানদের দেখভাল তিনি ভালোভাবে করবেন। হানি তাদের সম্পর্ক মেনে নিলেও শাবানার বাড়িতে চরম অশান্তি শুরু হয়। শাবানার বাবা কাইফি আজমি কিছুতেই মানতে পারেন না যে তার মেয়ে একজন বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করবে। কিন্তু জাভেদের প্রেমে পাগল ছিলেন শাবানা। বাবার কথা তিনি শোনেন না। অনেক সংঘর্ষের পর অবশেষে প্রেমের জয় হয়। জাভেদ তার প্রথম স্ত্রী হানিকে তালাক দিয়ে শাবানাকে বিয়ে করেন।

 

এক নজরে শাবানা-জাভেদ

শাবানা আজমির জন্ম ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদে। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সমাজকল্যাণমূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তিনি উর্দু ভাষার কবি কাইফি আজমি ও মঞ্চ অভিনেত্রী শওকত কাইফির কন্যা। তিনি পুনের ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন সংস্থার প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ১৯৭৪ সালে এবং অচিরেই তিনি সে সময়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় ও নব্য-বাস্তবতাবাদ নিয়ে নির্মিত নবকল্লোল আন্দোলনের সমান্তরাল চলচ্চিত্রে অন্যতম প্রধান অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। শাবানা চলচ্চিত্রে তার কাজের জন্য ভূয়সী প্রশংসা ও একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন, তন্মধ্যে রয়েছে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে রেকর্ডসংখ্যক পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মাননা। এছাড়া তিনি পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এবং ৩০তম ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘চলচ্চিত্রে নারী’ সম্মাননা লাভ করেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে ১৯৮৮ সালে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী এবং ২০১২ সালে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত করে। ২০১২ সালে অপ্সরা ফিল্ম পুরস্কারেও ভূষিত হন। শাবানা মুম্বায়ের কুইন ম্যারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন সংস্থানে ভর্তি হয়ে ১৯৭২ সালে তার শ্রেণিতে শীর্ষস্থান অর্জন করেন। পুনের ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন সংস্থান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ১৯৭৩ সালে খাজা আহমেদ আব্বাসের ফাসলা চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হন। তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র হলো শ্যাম বেনেগলের অভিষেক চলচ্চিত্র অঙ্কুর (১৯৭৪) এ ছবিতে কাজের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন শাবানা । তিনি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালে অর্থ, কন্ধার ও পার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। আশি দশকের শেষভাগে ও নব্বই দশকের শুরুতে তিনি কয়েকটি বিদেশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন, সেগুলো হলো জন শ্লেসিঞ্জারের মাদাম সুসৎজকা (১৯৮৮), নিকোলসা ক্লোৎজের বেঙ্গলি নাইট, রোলান্ড জোফের সিটি অব জয় (১৯৯২), চ্যানেল ফোরের ইমাক্যুলেট কনসেপশন (১৯৯২), ব্লেক অ্যাডওয়ার্ডসের সন অব দ্য পিংক প্যান্থার (১৯৯৩) এবং ইসমাইল মারচেন্টের ইন কাস্টডি (১৯৯৩)। ১৯৯৬ সালে দীপা মেহতার ফায়ার চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ৩২তম শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে সিলভার হুগো পুরস্কার এবং লস অ্যাঞ্জেলেস আউটফেস্ট থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি বিনজয় শুকলার গডমাদার চলচ্চিত্রের জন্য তার পঞ্চম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

অন্যদিকে জাভেদ আখতারের জন্ম ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪৫ সালে। তিনি ভারতের মূলধারার একজন লেখক এবং তার বেশিরভাগ সফল এবং জনপ্রিয় কাজগুলো সেলিম খানের সঙ্গে করেছেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১০ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হন। তার আসল নাম ছিল জাদু। তার বাবার লেখা একটা কবিতা ‘লম্বা, লম্বা কিসি জাদু কা ফাসানা হোগা’ থেকে এই নাম নেওয়া হয়। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ‘জাদু’ নামের সঙ্গে মিল রেখে জাভেদ নাম নেন। তিনি লখনউয়ের কলভিন তালুকদার কলেজ এবং মিন্টো সার্কেলে পড়াশোনা করেন। তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬৪ সালের ৪ অক্টোবর আখতার মুম্বাই আসেন এবং চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ করার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি কোনো কাজ পাননি। সেলিম খানের সঙ্গে প্রথম জাভেদ আখতারের সাক্ষাৎ হয় ‘সরহাদি লুটেরা’ ছবি তৈরির সময়। এ ছবি ছিল সেলিম খানের সর্বশেষ অভিনীত ছবিগুলোর একটা। এরপর তিনি চিত্রনাট্য লেখার দিকে মন দেন। এ সময় থেকে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সেলিম খান চিত্রনাট্য লিখতেন আর জাভেদ আখতার তাকে সংলাপ দিয়ে সাহায্য করতেন। সেই সময় থেকে তারা সেলিম-জাভেদ জুটি নামে ব্যাপক পরিচিতি পান। ১৯৮২-এর আগ পর্যন্ত তারা এভাবেই কাজ চালিয়ে যান।

অভিনেতা রাজেশ খান্না প্রথম সেলিম খান এবং জাভেদ আখতারকে তার ‘হাতি মেরে সাথি’ চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ দেন। এছাড়াও তাদের ব্যবসাসফল জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো : ইয়াদো কি বারাত (১৯৭৩), জাঞ্জির (১৯৭৩), হাত কি সাফাই (১৯৭৪), দেবর (১৯৭৫), শোলে (১৯৭৫), প্রেমাদা কান্নিকি, চাচা ভাতিজা (১৯৭৭), ডন (১৯৭৮), ত্রিশূল (১৯৭৮), মনুশুলু চেছিনা দঙ্গালু (তেলেগু ছবি), যুগনধার, দোস্তানা (১৯৮০), ক্রান্তি (১৯৮১), জামানা (১৯৮৫) এবং মি. ইন্ডিয়া (১৯৮৭)। তারা একত্রে প্রায় ২৪টির মতো চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন এবং ১৯৮২ সালের ব্যক্তিগত কারণে আলাদা হয়ে যান। সেলিম-জাভেদ জুটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল চিত্রনাট্যকার বলা হয়। জাভেদ আখতার ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। তিনি পাঁচবার জাতীয় পুরস্কার পান, এছাড়াও পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ, সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার লাভ করেন তার কবিতা সংগ্রহ ‘লাভা’র জন্য।

সর্বশেষ খবর