সোমবার, ৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সোনালি দিনের সেই নায়িকা সুচন্দা

সোনালি দিনের সেই নায়িকা সুচন্দা

জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ কিংবা ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় ছবির কথা মনে পড়লেই যে অভিনেত্রীর চেহারা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিনি হলেন সুচন্দা। এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর নানা কথা তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ

 

চলচ্চিত্র জীবনের শুরু...

পুরো নাম কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। ১৯৬৪ সালে প্রখ্যাত অভিনেতা কাজী খালেকের একটা প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম কাজ তার। সুভাষ দত্ত পরিচালিত কাগজের নৌকা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। ১৯৬৭ সালে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’ নির্মাণ করেন জহির রায়হান। এতে অভিনয় করে তিনি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান। এরপর তার দর্শকপ্রিয় অগণিত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- জীবন থেকে নেয়া, চাওয়া পাওয়া, কুচবরণ কন্য, নয়নতারা, সুয়োরানী দুয়োরানী, যে আগুনে পুড়ি, মনের মত বউ, কাচের স্বর্গ, অশ্রু দিয়ে, বিচার প্রভৃতি। তাছাড়া পাকিস্তনের বেশ কটি ছবিতে অভিনয় করেন ও সেখানে পুরস্কৃত হন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। স্বামী জহির রায়হানের জীবদ্দশায় টাকা আনা পাই ও প্রতিশোধ চলচ্চিত্র দুটি প্রযোজনা করেন। এছাড়াও তিনকন্যা, বেহুলা লখীন্দর, বাসনা ও প্রেমপ্রীতি চলচ্চিত্রগুলো প্রযোজনা করেন। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘সবুজ কোট কালো চশমা’। ২০০৫ সালে স্বামী জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং সেরা প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর চলচ্চিত্রের অবস্থা মন্দ হতে শুরু করলে চরম ক্ষোভ নিয়ে এই জগৎ থেকে দূরে সরেন তিনি।

জন্ম ও পরিবার

সুচন্দার জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সাল। যশোরের বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা এএসএম নিজামউদ্দীন আইয়ুব ও মাতা হলেন চিকিৎসক বেগম জাহান আরা।  সুচন্দার সন্তানরা হলেন- আরাফাত রায়হান, তপু রায়হান, রাফাইয়াত মালিক, রাফাইয়া মালিক। তার ছোট বোন ববিতা ও চম্পা ঢালিউডের দুই অভিনেত্রী। অভিনেতা রিয়াজ তার চাচাত ভাই।

 

অভিনয় জীবনের মজার স্মৃতি...

অভিনয় জীবনের গল্প বলতে গিয়ে সুচন্দা জানালেন তার প্রথম অভিনীত ছবির কথা। তিনি বলেন, ১৯৬৬ সাল। প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা সুভাষ দত্ত আমাকে নিয়ে নির্মাণ করছেন ‘কাগজের নৌকা’ ছবিটি। চলচ্চিত্রে আমার প্রথম অভিনয়। ক্যামেরাসহ নির্মাণের অনেক ভাষাই ছিল আমার অজানা। চিত্রায়ন চলছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো আমি। সুভাষ দা লাইটম্যানকে বারবার বলছেন ওর চুলটা আরেকটু কাটো... আরেকটু কাটো...! আমি তো ভয়ে অস্থির, আমার এত সুন্দর লম্বা চুল কেটে ফেলবে। সুভাষ দাকে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছি না। ততক্ষণে চোখে অশ্রু জমে গেছে। শর্ট শেষ হলে দেখলাম কই চুল তো কাটা হয়নি। সুভাষ দার কাছে কাটাকাটির বিষয়টি জানতে চাইলে হেসে উঠে তিনি বললেন, ‘ধুর বোকা মেয়ে, ধীরে ধীরে সব বুঝবি।’ সেদিনের সেই কথা মনে পড়লে আজও আপন মনে হেসে ওঠি। এরপর ১৯৬৮ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করলাম। এটি নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম অভিনয়। ছবিটি বাম্পার হিট হয়ে গেল। এরপর আমি আর রাজ্জাক জুটি হয়ে বহু ছবিতে অভিনয় করলাম। সবই দর্শক নন্দিত হলো। আমাদের জুটির চাহিদা এতটাই বেড়ে গেল যে, তৎকালীন পাকিস্তানি চলচ্চিত্র প্রযোজকরাও আমাদের নিয়ে কাজ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।  তাদের কথায়- ‘যেতনা চাহেগা হাম দেঙ্গে, লেকেন সুচন্দা আওর রাজ্জাককো হামারি পিকচারমে চাইয়ে...।’

জহির রায়হানের উৎসাহে নির্মাণে...

সুচন্দা বলেন, ‘জহির রায়হান সব সময় আমাকে বলতেন নির্মাণে আসার জন্য। আমার কথা ছিল নির্মাণ একটি কঠিন কাজ। এর জন্য প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় দরকার। তাই তখন রাজি হলাম না। তবে দুটি ছবি প্রযোজনা করেছিলাম। এগুলো হলোÑ ‘টাকা আনা পাই’ এবং ‘প্রতিশোধ’। দুটি ছবিই ব্যবসাসফল হলো।’ এরপর তিনকন্যাসহ আরও বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করলাম। মূলত জহিরের উৎসাহ আমাকে নির্মাণে আসতে সহায়তা করেছিল।

 

‘তিনকন্যা’ নির্মাণের নেপথ্যে...

১৯৮৫ সালে মুক্তি পেল সুচন্দা প্রযোজিত ‘তিনকন্যা’ ছবিটি। সুপারহিট এ ছবিতে সুচন্দা আর তার দুই বোন ববিতা আর চম্পা প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। আর এ ছবির মাধমেই অভিনয়ে এসেছিলেন চম্পা। ছবির নির্মাণের নেপথ্যেও কথা জানাতে গিয়ে সুচন্দা বলেন, আমার বাবা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে অসুস্থ অবস্থায় প্রায় আমাকে ডেকে বলতেন, তুমি একটি ছবি নির্মাণ কর। তাতে তোমরা একসঙ্গে তিন বোন অভিনয় করবে। এক সময় বাবা মারা গেলেন।  বাবার ইচ্ছে কখন পূরণ করব এই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। শুটিং, যে কোনো কাজের মধ্যে কিংবা ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও কাগজ কলম সঙ্গে রাখতাম। এটি অবশ্য আমার পুরনো অভ্যাস। জহির রায়হান তার ছবির গল্প মনে পড়লেই আমাকে তা বলতেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমি তা লিখে ফেলতাম। এমনকি আমি ঘুমিয়ে পড়লেও তার যদি গল্পের কথা মনে পড়ত আমাকে ডেকে তুলত লেখার জন্য। আমি ঘুম ঘুম চোখে বালিশের নিচে রাখা কাগজ-কলম বের করে লেখা শুরু করে দিতাম। ঠিক তেমনি করেই ‘তিনকন্যা’ ছবির গল্প লেখা হলো। গল্পে তিন বোনের চরিত্র হলো- আমি শান্ত স্বভাবের সাংবাদিক, ববিতা খুব চঞ্চল আর চম্পা ধুমধারাক্কা প্রকৃতির একজন পুলিশ কর্মকর্তা। যেহেতু তিন বোনের গল্প তাই ছবির নাম ঠিক করলাম তিনকন্যা। পরিচালনা করলেন শিবলী সাদিক। বাস্তবের মতো পর্দাতেও তিনকন্যার ঝড় উঠল।

 

যেভাবে ‘হাজার বছর ধরে’...

জহির রায়হানের দর্শকপ্রিয় উপন্যাস ‘হাজার বছর  ধরে’ অবলম্বনে ২০০৫ সালে সুচন্দা একই শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে সুচন্দা বলেন, এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ণ করার স্বপ্ন আমার দীর্ঘদিনের। ভাবলাম জহির তো নেই, কাকে স্ক্রিপ্ট দেখাব। সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তাকে দেখে দিতে বললাম। তিনি বললেন, ঠিক আছি দেখে দেব, তবে এক শর্তে আর তা হলো তোমাকে ছবিটি পরিচালনা করতে হবে। তার শর্ত পূরণে ছবিটির নিদের্শনা দিলাম। ‘হাজার বছর ধরে’ শুধু দর্শক প্রিয় হলো না, সেরা ছবি, নির্মাতাসহ একাধিক ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার         জয় করল।

সর্বশেষ খবর