মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সেই রূপবান সুজাতার গল্প

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম ‘রূপবান’ তিনি। আছে আরও অনেক স্মরণীয় চরিত্র ও ছবি। জমিদার বাড়ির মেয়ে রূপবান এখন কেমন আছেন। তার চলচ্চিত্র জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন-আলাউদ্দীন মাজিদ

সেই রূপবান সুজাতার গল্প

জমিদার বাড়ির মেয়ে তন্দ্রা

  তন্দ্রা মজুমদার, চলচ্চিত্রে এসে হন সুজাতা। অভিনেতা আজিম তার স্বামী। কুষ্টিয়ার থানাপাড়া জমিদার বাড়ির মেয়ে তন্দ্রা। জন্ম ১০ আগস্ট। জন্মের মাত্র ছয় মাস পর বাবাকে হারান। জমিদার বাড়িতেই শৈশব কেটেছে।

 

অভিনয়ে অভিষেক...

ষাট দশকে ঢাকায় এসে পুরান ঢাকায় উঠলেন। তারপর ৪০ টাকা বাড়িভাড়ায় নতুন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে চলে এলেন। একদিন সেই বাড়ির বাড়িওয়ালার ভাই তার মাকে বললেন, তার সঙ্গে মঞ্চের পরিচালক আমজাদ হোসেনের পরিচয় আছে। তার মা তাকে অনুরোধ করে বললেন, বাবা আমার ছোট মেয়েটাকে যদি অভিনয়ে দিতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। মায়ের অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, তার কোনো একটি সন্তান ছবির জগতে আসুক। তিনি উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। সেসব দেখেই তিনি এই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তারপর আমজাদ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি তন্দ্রাকে মঞ্চনাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে...

‘রূপবান’ খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সালাহউদ্দিন ১৯৬৩ সালে তার ‘ধারাপাত’ সিনেমার জন্য একটি নতুন মুখ খুঁজছিলেন। আমজাদ হোসেন তখন তার সহকারী পরিচালক ছিলেন। তিনি তন্দ্রার কথা সালাহউদ্দিন সাহেবকে বললেন। সালাহউদ্দীন তন্দ্রার নাটক দেখে তাকে পছন্দ করলেন। সিনেমায় নায়িকা চরিত্রে মনোনীত করলেন। তবে সিনেমায় একটি নাচের দৃশ্যের মাধ্যমে প্রথম আগমন। সেই ছবিটির নাম ছিল ‘দুই দিগন্ত’; কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে প্রথম মুক্তি পেয়েছে ‘ধারাপাত’। এভাবেই চলচ্চিত্রে পথচলা শুরু হলো তন্দ্রার।

‘রূপবান’ হলেন যেভাবে...

১৯৬৫ সালে সালাহউদ্দীন ‘রূপবান’ নামের ছবি তৈরি করলেন, ছবির নায়িকা হিসেবে তন্দ্রাকে নেবেন সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তার স্ক্রিনটেস্ট হলো। এ ছবির মাধ্যমে একদিকে তন্দ্রার ফিল্মি নাম সুজাতা অন্যদিকে এ ছবিটি ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা ছবি। এ ছবিতে অভিনয় করার সময় এফডিসিতে ঢুকলেই সুজাতাকে দেখে অনেকে বলত, এই দেখ যাত্রার নায়িকা যাচ্ছে। এর কপালে কী আছে কে জানে? অনেকে আবার মুখটিপে হাসত। সুজাতার ভয় ছিল রূপবান চরিত্রে আমাকে নিয়ে চারদিকে এত যে সমালোচনা শুনছি, তাতে ছবিটি মুক্তি পেলে আর কোনো ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পাব তো? তবে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ছবিটি এক অভাবনীয় ব্যাপার ঘটাল। প্রতিটি হলে এত লোক সমাগম, এত ভিড় হলো, যা আগে কোনো দিন হয়নি। মাসকে মাস ‘রূপবান’ একেকটা সিনেমা হলে চলেছে। সেই সময়ে কোনো উর্দু বা বাংলা ছবিই রূপবানকে বিট করতে পারেনি। ছবিটির জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সুজাতার জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল। তারপর থেকে একটার পর একটা সিনেমায় সই করতে লাগলেন সুজাতা।

একে একে ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘মোমের আলো’, ‘মেঘভাঙা রোদ’, ‘ডাক বাবু’, ‘মধুমালা’, ‘সাইফুলমুলক বদিউজ্জামান’, ‘এতটুকু আশা’, ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’, ‘অবুঝ মন’, ‘টাকার খেলা’, ‘প্রতিনিধি’, ‘বদলা’, ‘আলোর মিছিল’, ‘বেঈমান’, ‘আপনজন’সহ অনেক দর্শকপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করলেন। বেশ কটি ছবি প্রযোজনা ও অর্পণ নামে একটি ছবিও পরিচালনা করেন সুজাতা।

 

নায়ক আজিমের সঙ্গে বিয়ে

দীর্ঘদিন প্রেমের পর ১৯৬৭ সালের জুলাইয়ে নায়ক আজিমের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের ১০ বছর পর ১৯৭৭ সালে তাদের ঘর আলো করে সন্তান ফয়সাল জন্ম নিল। সংসার ও চলচ্চিত্র দুটি একসঙ্গে চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি তার।

 

ঋষি কাপুরের মুখোমুখি

১৯৭২ সালে ‘এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ হয়েছিল। সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য আমি ও আজিম মস্কো গেলাম। এরপর তাসখন্দ। এই উৎসবে ৬৪টি দেশ থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গিয়েছিলেন। বোম্বে থেকে রাজকাপুর ও ঋষি কাপুর এসেছিলেন। একদিন রাত ৮টার সময় হোটেলের রুমে কেউ একজন নক করলেন। দরজা খুলে দেখি, ঋষি কাপুর দাঁড়িয়ে আছেন। ফর্সা, ছিপছিপে অসাধারণ সুন্দর এই অভিনেতা আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি সুজাতা?’ জি। ‘রুমে একটি শ্যাম্পেনের বোতল আছে, আজিম ভাই সেটি দিতে বলেছেন।’ আমি বোতলটি তার হাতে তুলে দিলাম। তারা ‘ববি’ ছবিটি নিয়ে উৎসবে এসেছিলেন। সেই স্মৃতি এখনো অমলিন আমার হৃদয়ে।

যেমন আছেন এখন

ঢাকার পশ্চিম রামপুরার মহানগর আবাসিক এলাকায় একটি বাড়িতে ছেলে ফয়সাল আজিম, তার স্ত্রী আর দুই নাতি ফারদিন ও আবিয়াজকে নিয়ে থাকেন সুজাতা। স্বামী অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও প্রযোজক আজিম মারা গেছেন ২০০৩ সালে।  সুজাতা জানান, ছেলে ও তার স্ত্রী এবং দুই নাতিকে নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে তার। লেখালেখি করছেন। ঘরের কাজকর্ম করছেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর