সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

উপমহাদেশ কাঁপানো কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা

উপমহাদেশ কাঁপানো কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা

অনেকেই রুনা লায়লাকে খুব গম্ভীর ভাবেন। অথচ অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে থেকেও খুব সহজ, সরল আর প্রাণবন্ত তিনি। নতুন কিংবা পুরনো কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঠোঁটের কোণে সহজ সরল হাসি লেগেই থাকে। রুনা লায়লা এমনই। তার চারপাশের মানুষগুলো যেন তার মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে থাকেন। গুণী এই শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন-

আলী আফতাব

 

শৈশব ও পারিবারিক জীবন

১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর রুনা লায়লা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা আনিতা সেন ওরফে আমেনা লায়লা ছিলেন সংগীতশিল্পী। তার মামা সুবীর সেন ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী। তার যখন আড়াই বছর বয়স তার বাবা রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে যান। সেই সূত্রে তার শৈশব কাটে পাকিস্তানের লাহোরে। তারা দুই বোন এক ভাই। বোন দীনা লায়লা এবং ভাই সৈয়দ আলী মুরাদ। অভিনেতা আলমগীর তার স্বামী। তার একমাত্র কন্যা তানি লায়লা। উচ্চাঙ্গ সংগীতে দীক্ষা নিয়েছেন ওস্তাদ হাবিব উদ্দিন খান ও আবদুল কাদের পিয়ারাংয়ের কাছে। গজলে দীক্ষা নিয়েছেন পন্ডিত গোলাম কাদিরের (মেহেদি হাসানের ভাই) কাছে।

 

প্রথম গানের শুরু

রুনা লায়লার বয়স তখন ৬ বছর। বাসায় গান শিখেন তিনি। পুরো পরিবারই তখন করাচিতে। বড় বোন দীনাও গান করেন। ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন নামে প্রতিষ্ঠান একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে দীনার গাইবার কথা। কিন্তু হঠাৎ করেই দীনার গলা খারাপ হয়ে গেল। আয়োজকরা পড়লেন বিপদে। তারা বাসায় এলে দীনার মা বললেন, ‘দীনা না গাইতে পারলে রুনা গাক’। এ কথা শুনে আয়োজকরা দ্বিধায় পড়ে গেলেন। এইটুকু মেয়ে কী গান গাইবে। শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে রুনা লায়লা একটি ক্ল্যাসিকাল রাগ গাইলেন। সবাই দেখল মাত্র ছয় বছরের একটি মেয়ে তানপুরা যার চেয়ে অনেক বড় সে বসে বসে গাইছে। গান শুনে শেষে সবাই খুশি, অ্যাওয়ার্ড পেলেন রুনা, সঙ্গে কিছু ক্যাশপ্রাইজও।

প্রথম প্লেব্যাক

করাচিতে ‘জুগনু’ চলচ্চিত্রে রুনা লায়লা প্রথম গান করেন। গানটি ছিল ‘গুড়িয়াসি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি পেয়ারি। ১৯৭৪ সালের শুরুতে দেশে ফিরে প্রয়াত সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ ছবিতে প্রথম গান করেন। গানের কথা ‘ও জীবন সাথী তুমি আমার’। এ গানে তার সঙ্গে কণ্ঠ দেন খন্দকার ফারুক আহমেদ। সে বছরই বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠানে গাইবার সুযোগ পান রুনা লায়লা। দেবু ভট্টাচার্যের সুরে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা পাঁচটি গান ধারণ করা হলো অনুষ্ঠানটির জন্য। সে অনুষ্ঠানে তিনি পোশাকে পরির্বতন আনলেন। একটু নেচে গান পরিবেশন করলেন। ব্যস, সবার দৃষ্টি পড়ল রুনা লায়লার দিকে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল রুনার গায়কীর সুনাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বহু চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন তিনি।

 

হিন্দি ছবিতে গান

১৯৭৫-এ প্রথম হিন্দি ‘এক সে বাড়কার এক’ ছবিতে গান করেন তিনি। এরপর তিনি গান করেন অগ্নিপথ, পেয়ারে লাল, সাপ্নোকা মন্দির, ধারান্দা এমন অনেক ছবিতে। এ ছাড়া বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে ‘জানে বাহা’র ছবিতে মোহাম্মদ রফির সঙ্গে গান করেন তিনি।

 

মোহাম্মদ রফি ও কিশোর কুমারের সঙ্গে কিছু স্মৃতি

মোহাম্মদ রফি ও কিশোর কুমারের সঙ্গে অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে রুনা লায়লার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মোহাম্মদ রফি ও কিশোর কুমারের সঙ্গে বেশকিছু অনুষ্ঠানে গিয়েছি আমি। কিশোরদা খুব মজা করতেন। চমকে দিতে ভালোবাসতেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় একসঙ্গে কোনো গান রেকর্ড হয়নি। সেবার কলকাতার নেতাজি স্টেডিয়ামে শো। আমি, কিশোরদা এবং মোহাম্মদ রফি। আমি ব্যাকস্টেজে ঢুকে ড্রেসিংরুমে। ওখানে যারা ছিল তাদের জিজ্ঞেস করলাম মোহাম্মদ রফি ও কিশোরদা এসেছেন কিনা? কিশোরদা পেছনের দরজায় লুকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ লাফ দিয়ে সামনে এসে বললেন, নমস্কার, আমি এখানে। আমি চমকে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে আবার বললেন, দেখো আমি তোমাকে কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম। আমি যখন স্টেজে গাইছি তখন অডিয়েন্সের মধ্যে গিয়ে নানান ফানি চেহারা করতেন। মজার এক মানুষ ছিলেন।

 

আমেরিকায় প্রথম গানের অনুষ্ঠান

গানকে সঙ্গে নিয়ে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন এই গুণী শিল্পী। অনেক দেশে রয়েছে অনেক ধরনের মজার অভিজ্ঞতা। তেমনি এক অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। ১৯৭৭-এ আমি প্রথমবারের মতো আমেরিকা যাই বাংলাদেশ আমেরিকান কালচারাল ফোরামের উদ্যোগে। অতিথিদের বেশির ভাগ ডিপ্লোম্যাক্স, সিনেটরস। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আসবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি আর আসতে পারলেন না। এলেন তার পুত্র চিফ কার্টার এবং পুত্রবধূ। সবার শেষে আমি দামাদাম মাস্তাকালান্দার গানটি গাইলাম। পুরো হল তখন নাচছে, তালি বাজাচ্ছে। চিফ কার্টার এবং এফবিআইর সবাই খুব ভয় পেয়ে গেল যে, হঠাৎ কী হলো? চিফ কার্টার আমাদের হাইকমিশনারকে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে? তিনি চিফ কার্টারকে আশ্বস্ত করলেন চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। বোঝালেন আমার এ গানটা সবার খুব প্রিয় এবং গানটা গাইলে সবাই খুব এক্সাইটেড হয়ে যায়।

 

কাশ্মীরে বিনা পারিশ্রমিকে গান

১৯৭৮ সালের কথা। আমার কাছে একটা আমন্ত্রণপত্র এলো। তাও আবার কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহর নিজ হাতে লেখা। তিনি কাশ্মীরে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করতে চান। এজন্য আমি তাকে ফান্ড জোগাড় করে দিতে কোনো সাহায্য করতে পারব কিনা? আমি পারফর্ম করলে ফান্ড উঠবে। ভারতে তিনি অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছেন কিন্তু তাদের কেউই টাকা ছাড়া পারফর্ম করতে রাজি হলেন না। আমি তাকে উত্তর পাঠালাম। আমাকে হাতে লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এজন্য আমি সম্মানিত বোধ করছি। যেহেতু আপনি একটি মহৎ উদ্দেশ্যে ফান্ড তুলতে চাইছেন সেখানে পারিশ্রমিক নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু বললাম আমার সঙ্গে কয়েকজন মিউজিশিয়ান আসবেন এবং আমার পরিবারের কয়েকজন সদস্য যেতে ইচ্ছুক। তিনি আমাকে সাদরে কাশ্মীর আমন্ত্রণ জানালেন। লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে তার অফিশিয়াল রেসিডেন্সে থাকতে দিলেন। বাড়িতে দাওয়াত করলেন। অনুষ্ঠানের দিন তিনি এমন এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন যা কোনো দিন ভুলবার নয়। আমি বাংলাদেশের একজন শিল্পী যিনি মানবতার ডাকে এসেছি। বিনা পারিশ্রমিকে গান গাইছি সব বললেন। শুধু আমাকে নয় বাংলাদেশের মানুষকে, বাংলাদেশ সরকারকে তিনি ধন্যবাদ জানান। এত স্বনামধন্য একজন রাজনীতিবিদের কাছ থেকে এতটা সম্মান পেয়ে সেদিন শিল্পী হিসেবে, বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে আরেকবার গর্ববোধ করলাম।

 

চলচ্চিত্রে অভিনয়

চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ নামক চলচ্চিত্রে নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেন রুনা লায়লা। ‘শিল্পী’ চলচ্চিত্রটি ইংরেজি চলচ্চিত্র ‘দ্য বডিগার্ড’-এর ছায়া অবলম্বনে চিত্রিত হয়।

 

সংগীতজীবন

বাংলাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি এই শিল্পী চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক গানের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের বাইরে গজলশিল্পী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তার বেশ সুনাম রয়েছে। পাঁচ দশকের দীর্ঘ সংগীতজীবনে ১৭ ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন রুনা লায়লা। অর্জন করেছেন উপমহাদেশের কোটি মানুষের ভালোবাসা। বাংলা ছাড়া রুনা লায়লা উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছেন তিনি। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, বেলুচ, ফার্সি, আরবি, স্প্যানিশ, ফরাসি কিংবা ইংরেজি এমন অনেক ভাষার গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। সুরকার নিসার বাজমির ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ডের পর রুনা লায়লা নাম লেখান গিনেস বুকে। ১৮টি ভাষায় গান গাওয়া, নিজের সংগীতজীবন নিয়ে নির্মিত ‘শিল্পী’ ছবিতে অভিনয় করা সব মিলিয়ে রুনা লায়লা উপমহাদেশের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। বাংলা গানের অমূল্য রতœ রুনা লায়লার কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’, ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’, ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘শিল্পী আমি তোমাদেরই’, ‘সাধের লাউ বানাইলো’, ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি’, বন্ধু তিন দিন তোর’, ‘জীবনো আঁধারে পেয়েছি’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট’ এবং ‘বাড়ির মানুষ কয় আমায়’ ইত্যাদি।

সর্বশেষ খবর