রবিবার, ২১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বলিউডের সেই ধাক্ ধাক্ গার্ল মাধুরী

বলিউডের সেই ধাক্ ধাক্ গার্ল মাধুরী

‘এক-দো-তিন চার পাঁচ ছে’, ‘মুঝে ধাক্ ধাক্ করনে লাগা’ কিংবা ‘মার ডালা’র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান শুনলেই এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে বলিউডের ভুবনমোহিনী রূপের অভিনেত্রী মাধুরীর ছবি। সেই মাধুরীকে নিয়েই লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ভাগ্য বদলে দিল ‘এক-দো-তিন’

বলিউডে নব্বই দশকের বাঘা সব অভিনেত্রীকে কড়া টক্কর দিয়ে সবার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাধুরী দীক্ষিত। ১৯৮৪ সালে ‘অবোধ’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক। মাত্র ৪ বছরের মাথায় ১৯৮৮ সালে এন চন্দ্রা পরিচালিত ‘তেজাব’ ছবিতে দক্ষ অভিনয় আর ভুবনমোহিনী রূপ দিয়ে দর্শক-নির্মাতার হৃদয় টালমাটাল করে দেন তিনি। একই সঙ্গে এই ছবির অসাধারণ জনপ্রিয় একটি গান ‘এক-দো-  তিন’ এ তুখোড় নাচের পারদর্শিতা দেখিয়ে স্বয়ং এ নাচের বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার সরোজ খানকে তাক লাগিয়ে দেন। সরোজ যখন নাচটির কোরিওগ্রাফ করতে যান তখন আনকোড়া একটি মেয়েকে দেখে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, কঠিন এই নাচটি কী এই নতুন মেয়েটি যথাযথ ভাবে আয়ত্ত করতে পারবে। সরোজ খানের মুখ উজ্জ্বল করে সুদক্ষ নাচের মুদ্রায় ইতিহাস রচনা করলেন মাধুরী। মাধুরীর প্রতিভায় মুগ্ধ সরোজ তাকে আশীর্বাদ জানাতে ভুলেননি। সিনেমা হলে ছবিটি চলার সময় আরও একদফা গানটি দেখতে চাইতেন দর্শকরা। গান শুরু হলেই পর্দায় টাকা ছুড়ে মারতেন তারা। এ ছবিতে মাধুরীর নাম ছিল মোহিনী। দর্শক সে সময় মাধুরীকে ‘মোহিনী’ ডাকা শুরু করেছিল। এরপর রুপালি জগতে তার ‘এক-দো-তিন’ করে অপ্রতিরোধ্য যাত্রা কেউ থামাতে পারেননি আর।

 

খানদের সঙ্গে যাত্রা...

বলিউডের তিন খানের সঙ্গেই অভিনয় কারিশমার স্বাক্ষর রাখেন মাধুরী। ১৯৯০ সালে আমিন খানের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন তিনি। ছবির নাম ‘দিল’। সুপার ডুপার হিট এই ছবিটি। এরপর সালমান খানের সঙ্গে ‘সাজান’ ছবিটি এখনো বলিউডে ইতিহাস হয়ে আছে। সালমানের সঙ্গে ‘হাম আপ কি হ্যায় কোন’, ‘হাম দিল দে চুকি সানাম’সহ বেশ কটি দর্শক তাক লাগানো ছবি রয়েছে। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘আনজাম’, ‘হাম তুমারি হ্যায় সনম’, ‘দেবদাস’সহ বেশ কটি ছবি বক্স অফিস মাতায়। অনিল কাপুরের সঙ্গে বেটা ছবির কথা কখনো ভোলা যাবে না। এ ছবিতে অভিনয় করে বলিউডের ‘ধাক্ ধাক্ গার্ল’ খ্যাতি পেতে সময় লাগেনি তার। সঞ্জয় দত্তের সঙ্গে ‘খলনায়ক’ ছবির কথা মনে পড়লে এখনো মাধুরীকে ভেবে অনেকেই গেয়ে ওঠেন ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’।

 

সফল চন্দ্রমুখী

২০০২ সালে প্রখ্যাত  সঞ্জয় লীলা বানশালীর ‘দেবদাস’ ছবিতে  চন্দ্রমুখীর মতো একটি চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করে শুধু দর্শক হৃদয় হরণ করেননি, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও জয় করে নেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে দিলীপ কুমার-সূচিত্রা সেনকে নিয়ে বিমল রায় নির্মিত ‘দেবদাস’ ছবিতে চন্দ্রমুখী চরিত্রে সফল অভিনয় করেন বৈজয়ন্তী মালা। সিনে বোদ্ধাদের মতে বৈজয়ন্তীকেও এই চরিত্রে ছাড়িয়ে গেছেন মাধুরী। এতে অসামান্য অভিনয় শৈলী ও অপূর্ব দক্ষতার জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেন।

 

সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক...

সালমানের সঙ্গে সুরুজ বারজাতিয়ার ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব এলে মাধুরী জানিয়ে দেন পারিশ্রমিক হিসেবে তাকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা দিতে হবে। এই বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিক যেন মাধুরীর দর্শকপ্রিয়তার সামনে অতি তুচ্ছ। তাই নির্মাতা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। ছবিটি বলিউডে রীতিমতো ঝড়  তোলে আয় করে নিয়েছিল ৬৫ কোটি রুপি। ভারতের বাইরেও এই ছবি তুলকালাম ব্যবসা করে। প্রযোজক তার ঘরে নিট মুনাফা তুলে আনে ১৫ কোটি রুপি। শুধু তাই নয় এ ছবির উঁচুমানের অভিনয়ের জন্য মাধুরী সাফল্যের ঝুলিতে পুরে নেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড।

 

হতে চেয়েছিলেন মাইক্রোবায়োলজিস্ট

মাধুরী দীক্ষিত ১৯৬৭ সালের ১৫ মে মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শঙ্কর দীক্ষিত ও মাতা স্নেহলতা দীক্ষিত। দীক্ষিত ডিভাই চাইল্ড হাই স্কুল এবং মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন ও মাইক্রোবায়োলোজিস্ট হতে চেয়েছিলেন মাধুরী। তিন বছর বয়স থেকে নৃত্যের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। আট বছরে কথক নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং একজন প্রশিক্ষিত ও পেশাদার কথক নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠেন। ১৯৯৯ সালে তিনি শ্রীরাম মাধব নেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে।

 

মানবহিতৈষী কাজও ছোট পর্দায়...

মাধুরী ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে শিশুদের অধিকার ও শিশুশ্রম বন্ধের জন্য কাজ করছেন। তিনি ভারত সরকারের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পাড়াও’ ক্যাম্পেইনের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন। তিনি একাধিক কনসার্ট সফর ও মঞ্চ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, সনি টিভির ‘কাহি না কাহি কোই হ্যায়’ অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন এবং নৃত্যানুষ্ঠান ‘ঝলক দিখলা জা’, ‘সো ইউ থিংক ইউ ক্যান ড্যান্স ও ড্যান্স দিওয়ানে’ অনুষ্ঠানের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।

 

যত সম্মাননা

অভিনয় জীবনে মাধুরী ছয়টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তার সহজাত সৌন্দর্যচর্চা এবং নৃত্যকলায় সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেন। হিন্দি চলচ্চিত্রে অনবদ্য ভূমিকার জন্য তাকে ২০০৮ সালে ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে রেডিফ মাধুরী দীক্ষিতকে বলিউডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ঘোষণা করে। মে ২০০৮ সালে লস এঞ্জেলসে ভারতীয় ছায়াছবি উৎসবে সম্মানিত করা হয়। মার্চ ২০১০ সালে ইকোনমিক টাইমস ঘোষণা করে যে, মাধুরী দীক্ষিত ‘৩৩ মহিলার একজন, যাকে নিয়ে ভারতবাসী গর্বিত’।

 

দুই দশকের সফল যাত্রা

১৯৮০ এবং ১৯৯০-দশকজুড়ে তিনি হিন্দি সিনেমার নেতৃত্বদানকারী অভিনেত্রী ও শীর্ষস্থানীয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে একচ্ছত্র প্রাধান্য ও প্রভাব বিস্তার করেন। রাম লক্ষণ (১৯৮৯), ত্রিদেব (১৯৮৯), কিষাণ কানাইয়া (১৯৯০), দিল (১৯৯০), সাজন (১৯৯১), বেটা (১৯৯২), খলনায়ক (১৯৯৩), হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন (১৯৯৪), রাজা (১৯৯৫) ও দিল তো পাগল হ্যায় (১৯৯৭) চলচ্চিত্রে অভিনয়ে অনন্য অভিনয় দক্ষতা দিয়ে বলিউডের শীর্ষ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং প্রেম প্রতিজ্ঞা (১৯৮৯), পারিন্দা (১৯৮৯), প্রহার (১৯৯১), আঞ্জাম (১৯৯৪), মৃত্যুদ- (১৯৯৭), পুকার (২০০০), লজ্জা (২০০১) ও দেবদাস (২০০২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হন। সংসার জীবনের কারণে  বেশ ক’বছর চলচ্চিত্র থেকে দূরে ও দেশের বাইরে থাকার পর ৭ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে স্বামী-সন্তানসহ মুম্বাইয়ে ফিরে আসেন এবং আজা নাচলে (২০০৭) ছবিতে অভিনয় করেন।  যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসে ‘মাধুরী এখনো তা দেখাতে পারেন’ শিরোনামে প্রতিবেদনে মাধুরীর অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসাসহ গভীর মূল্যয়ন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ব্ল্যাক কমেডিধর্মী ‘ইশকিয়া’ (২০১৪), অপরাধ নাট্যধর্মী গুলাব গ্যাং (২০১৪) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার প্রথম মারাঠি চলচ্চিত্র বাকেট লিস্ট (২০১৮) এবং তার সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র টোটাল ধামাল (২০১৯)।

সর্বশেষ খবর