মাইকেল জ্যাকসন! জাদুকরী গানের সঙ্গে যার দুর্দান্ত ডান্স বিশ্বের অগণিত ভক্তকে মুগ্ধ করেছে চৌম্বকীয় আবেশের মতো। এই আমেরিকান স্টাইলিশ যুবক একাধারে ছিলেন তুখোড় গায়ক, অভিনেতা, ডান্সার, গীতিকার, রেকর্ড প্রযোজকসহ বহু প্রতিভায় ভাস্বর। আজ ২৫ জুন কিংবদন্তি এই পপসম্রাটের একাদশ প্রয়াণ দিবস। মহান এই সংগীত তারকার আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন - পান্থ আফজাল
আফ্রো-আমেরিকান দরিদ্র পরিবারে জন্ম
১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট আমেরিকার ইন্ডিয়ানা প্রদেশের গ্যারে শহরে জন্ম ‘কিং অব পপ’ মাইকেল জ্যাকসনের। পুরো নাম মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন। আফ্রো-আমেরিকান এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম অদ্ভুত এই যুবকটির। জো জ্যাকসন ও ক্যাথেরিন জ্যাকসন দম্পতির সন্তান মাইকেল দশ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন অষ্টম। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে মাইকেল জ্যাকসনকে কপিকল অপারেটর হিসেবে কারখানায় কাজ করতে হয়েছে।
পাঁচ বছরে সংগীত জীবন
বাবা জোসেফ জ্যাকসন কারখানার শ্রমিক হলেও গানের চর্চা করতেন। আমেরিকান নিগ্রোদের প্রিয় ‘রিদম অ্যান্ড ব্লুুজ’ এর চর্চা শুরু হয়েছিল পারিবারিক আবহে। মাত্র ৫ বছর বয়সে এমজের সংগীত জীবন শুরু হয়। ‘জ্যাকসন ফাইভ’ নামের একটি ব্যান্ড দলের সদস্য ছিলেন মাইকেল। ব্যান্ডটি গঠন করার পর তারা কিছু গান রিলিজ করে, যা পরবর্তীতে বিলবোর্ড চার্টে স্থান করে নেয়। সেখান থেকে প্রথম মিউজিক অ্যালবাম ‘ডায়ানা রোজ’ ১৯৬৯ সালে প্রকাশ হয়। এ অ্যালবামের প্রথম একক গান ‘আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক’ ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে বিলবোর্ডের হট তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে নেয়। সেই সময় বিখ্যাত মিউজিক ম্যাগাজিন ‘রোলিং স্টোন’ তাদের প্রচ্ছদে এই উঠতি তারকাদের কভার করে। সত্তর দশকের পর ‘জ্যাকসন ফাইভ’ ছাড়ে মাইকেল। এরপর মাইকেলের একক শিল্পী হিসেবে সংগীতবিশ্বে পথচলা শুরু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে একক শিল্পী হিসেবে মাইকেল জ্যাকসনের সংগীতবিশ্বে পথচলা শুরু হয়।
এমটিভির উত্থান
১৯৮২ সালে রিলিজ হওয়া ‘থ্রিলার’ অ্যালবামটি সর্বকালের বিক্রীত রেকর্ড হিসেবে আজও অটুট, ‘বিট ইট’ গানটি প্রচার করে শিরোনামে আসে এমটিভির নাম। অনেকেই হয়তো জানেন না, মাইকেল জ্যাকসনের এই একটি গানকে পুঁজি করে এমটিভির উত্থান ঘটে।
অদ্বিতীয় পারফর্মার
গানের তালে তালে ১৯৮৮ সালে বের হয় ‘মুনওয়াকার’। তবে প্রজন্ম তাকে অভিনেতা হিসেবে চিনেছে ‘মেন ইন ব্ল্যাক টু’ দিয়ে।
অর্জনের ঝুলিতে যত রেকর্ড
জীবিতকালে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন মাইকেল জ্যাকসন। তার মধ্যে দুইবার হয়েছেন ‘রক এন রোল হোল অব ফেম’। এ ছাড়াও ১৩টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, ১৩টি সেরা একক সংগীত এবং ৭৫ কোটি অ্যালবাম বিক্রির রেকর্ড রয়েছে তার ঝুলিতে। তার গাওয়া পাঁচটি সংগীত অ্যালবাম বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবাম।
মানবতাবাদী শিল্পী
মানবতাবাদী এই শিল্পী তার আয়ের অনেক অংশ দান করেছেন নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। পরিবেশ রক্ষায় গেয়েছেন ‘আর্থ সং’। জীবদ্দশায় নিজের অর্থায়নে লিউকেমিয়া এবং ক্যান্সার ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন মাইকেল জ্যাকসন। শিশুদের জন্য এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য তিনি কোটি কোটি ডলার দান করে গেছেন। ১৯৯৬ সালে তার আয়ের অর্থ দিয়ে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। তারপরও তাকে নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ ছিল না।
কৃত্রিম দুই সন্তানের জন্ম
১৯৯৪ সালের আগস্টে এলভিস প্রিসলির কন্যা লিসা মেরি প্রিসলিকে বিয়ে করেন মাইকেল জ্যাকসন। যদিও দুই বছর সংসারের পর তারা আলাদা হয়ে যান। ’৯৭-তে আবারও বিয়ের পিঁড়িতে বসেন পপসম্রাট। জ্যাকসন ডিবোরাহ নামে এক নার্সকে বিয়ে করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, কৃত্রিম উপায়ে তাদের দুটি সন্তান হয়। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে ছেলে প্রিন্স মাইকেল জ্যাকসন এবং ১৯৯৮ সালে মেয়ে প্যারিস মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম হয়। ১৯৯৯ সালে ডিবোরাহর সঙ্গেও মাইকেল জ্যাকসনের ডিভোর্স হয়ে যায়। প্যারিস, প্রিন্স ও জ্যাকসন জুনিয়র-মাইকেলের এই তিন সন্তান।
যৌন নিপীড়নের অভিযোগ
নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই প্রথম তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন এক শিশুর বাবা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নানা কেলেঙ্কারিতে জড়ালেও প্রায় ৪০ বছর ধরে সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
জীবনের শেষদিকে এসে নানা যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে আমেরিকায় একজন ইমামের উপস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তার প্রযোজক বন্ধু ও গীতিকার ডেভিড ওয়ার্নসবি ও ফিলিপ বুবাল তাকে সহায়তা করেন। মুসলিম হওয়ার পর তিনি মিকাঈল নাম গ্রহণ করেছিলেন।
হারিয়ে গেছে অস্কার
১৯৩৯ সালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ সেরা সিনেমা ক্যাটাগরিতে জিতেছিল অস্কার। ডেভিড সেলঝেনিক নির্মিত ছবির এই অস্কারটি পরে নিলাম থেকে কিনে নিয়েছিলেন পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসন। জানা গেছে, অস্কার পুরস্কারটি নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। সব সম্পত্তির মধ্যে ১৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার দিয়ে নিলাম থেকে কেনা হয়েছিল পুরস্কারটি।
অক্সিজেন কক্ষ তৈরি
পৃথিবীর মায়া তারও ছিল। তাই অমর হওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন তিনি। এ জন্য বিশ্বের সর্বোচ্চ চিকিৎসাবিজ্ঞানের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। নিজের ক্লোন তৈরি করে অমর হতে চেয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। মৃত্যুর আগে এর জন্য তিনি লাখ লাখ ডলার ব্যয়ও করেছেন। নেভারল্যান্ডের একটি কক্ষে মাইকেল ঘুমাতেন, তা নাকি অক্সিজেন কক্ষ। এই কক্ষে ঘুমালে নাকি অনেক বছর বেশি বাঁচা যায়। একবার তিনি দাবি করেছিলেন, অক্সিজেন চেম্বারে ঘুমানোর জন্য অন্তত ১৫০ বছর বাঁচবেন তিনি।
প্লাস্টিক সার্জারি রহস্য
গায়ের রং ছিল কালো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বদখত ত্বকের রোগ দেখা দেয়। চামড়ার রং সাদা হতে শুরু করে। জানা যায়, তিনি শুধু নাকের সার্জারি করিয়েছিলেন, ত্বকের নয়। চামড়ার রঙের অস্বাভাবিকতার জন্য ভারি মেকআপ ব্যবহার করতেন।
মৃত্যুর আগে ৬০ দিন নির্ঘুম
বিশ্বখ্যাত পপতারকা মাইকেল জ্যাকসন মৃত্যুর আগে ৬০ দিন নির্ঘুম ছিলেন বলে জানা যায়। যদি ঘটনাটি সত্যি হয়, তাহলে জ্যাকসনই পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি টানা দুই মাস ঘুমাননি।
রহস্যজনক মৃত্যু
মাইকেলের মৃত্যু নিয়ে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা। মাত্র ৫০ বছর বয়সে ব্যক্তিগত ডাক্তারের উপস্থিতিতে তারই দেওয়া ঘুমের ওষুধের ওভার ডোজে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। কিছু সূত্রমতে, অতিরিক্ত ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের ফলে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় তার। আবার অনেকে বলছেন, ‘দিস ইজ ইট’ কনসার্টে অংশ নেওয়ার পর অতিরিক্ত ৫০টি শোতে সংগীত পরিবেশন করার চাপে ছিলেন তিনি।