বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

উত্তম-সুপ্রিয়া অধ্যায়

উত্তম-সুপ্রিয়া অধ্যায়

মহানায়ক উত্তম কুমারকে ঘিরে যে নায়িকাবৃত্ত, তার প্রথম দুই নাম অবশ্যই সুচিত্রা সেন এবং সুপ্রিয়া দেবী। তবে এই দুজনের মধ্যে সুপ্রিয়াই নায়ক উত্তমকে একান্ত আপন করে পেয়েছিলেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হয়নি। তবে উত্তমের মৃত্যু সম্ভবত তার মতো করে আর কাউকে নিঃসঙ্গ করেনি। আজকের আয়োজনে রূপকথার সেই উত্তম-সুপ্রিয়া অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

উত্তম-সুপ্রিয়ার প্রথম দেখা

সুপ্রিয়াকে ‘বেণু’ বলে ডাকত বাড়ির সবাই। ব্যানার্জি দম্পতির শেষ সন্তান বেণু। সুপ্রিয়ার বোনদের একজনের বর ছিলেন সাহিত্যিক বনফুল। ফলে অজান্তেই বেণুর শিল্প-সাহিত্য-থিয়েটার-চলচ্চিত্রের প্রতি ঝোঁক  বেড়ে যায়। মিচিনার ‘টাউন হলে’ একবার বেণুর বাবা তিনটি নাটক পরিচালনা করবেন বলে স্থির করলেন। বাবার উকিল বন্ধুরাই কুশীলব। বাবার প্রস্তাবে বেণু তুমুল রিহার্সেল করে দুটি চরিত্র করল এবং উপস্থিত সবার প্রশংসা কুড়াল। এরমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেল। বেণুর পরিবারকে বার্মা ছাড়তে হলো। শেষতক কলকাতায় সংসার পাতা হলো গিরিশ মুখার্জি রোডে। এরমধ্যে বেণু ভাগলপুরে চিত্রাঙ্গদায় মদনের পাঠ করল। এখানেই প্রথম দেখা হলো মহানায়ক উত্তমের সঙ্গে। ১৮-১৯ বছরের উত্তম তখন পাড়ায় হিরো। যাত্রা-থিয়েটারে পার্ট করে।

 

সুপ্রিয়ার দাদার চরিত্রে উত্তম

‘বসু পরিবার’-এ উত্তম কুমারের সঙ্গে আবার দেখা সুুপ্রিয়ার। ছবিতে বেণুর দাদার চরিত্রে উত্তম। এই ছবির শুটিং চলাকালে পাহাড়ি সান্যাল বেণুর নতুন নাম রাখলেন ‘সুপ্রিয়া ব্যানার্জি’। একটা দৃশ্যে সুপ্রিয়া দাদা উত্তমকে জড়িয়ে ধরে ছোট ভাইকে মারার জন্য ছাড়াতে যাবে। সুপ্রিয়ার বাবা এর জন্য কোনোভাবেই বেণুকে শুটিং করতে দেবেন না। কোনো রকমে ছবি শেষ হলে বাড়ির সবাই মিলে ঠিক করল, তার ফিল্ম করা বন্ধ।

 

সুপ্রিয়ার বিয়ে ও উত্তমের নায়িকা হিসেবে চুক্তি

‘বসু পরিবার’ ছবিটি করার পর পরই বিয়ে হয়ে গেল সুপ্রিয়ার। স্বামী বিশ্বনাথ চৌধুরী। এদিকে সত্যজিৎ রায় বসু পরিবার দেখে সুপ্রিয়াকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন। রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে বানালে সুপ্রিয়াকে দিয়েই ‘বিমলা’ করাতে চান তিনি। পরে অবশ্য সে ছবিতে সুপ্রিয়ার কাজ করা হয়নি। তার প্রথম নাম ছড়াল আম্রপালি করে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এসে আম্রপালিতে সুপ্রিয়াকে কাস্ট করেছিলেন। অভিনয়ের খ্যাতি উত্তম কুমারের কানেও গেল। এরপর উত্তমের নায়িকা হিসেবে উত্তর মেঘ, সোনার হরিণ, শুন বরনারীতে সই করলেন সুপ্রিয়া।

 

উত্তমময় সুপ্রিয়ার জীবন

এক দিন ঋত্বিক ঘটকের পক্ষ থেকে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে রিফিউজি মেয়ে নীতা চরিত্রের অফার এলো সুপ্রিয়ার। নীতা আর কোমলগান্ধারের অনুসূয়ার পর ঋত্বিক পরে সুপ্রিয়াকে মাথায় রেখে সুবর্ণরেখার চিত্রনাট্য করেছিলেন। কিন্তু অন্য পরিচালকদের ছবিতে ফাঁকি দিয়ে ঋত্বিকের ছবি করতে উত্তম না করলেন। মেঘে ঢাকা তারার সেটে সুপ্রিয়াকে দেখে উত্তম বলেছিলেন, ‘এই কালিঝুলি মেখে অভিনয় করলে কেউ আর পুছবে না। গ্ল্যামারাস রোল কর।’ তখনো উত্তমের সঙ্গে প্রেম হয়নি সুপ্রিয়ার। পরে অবশ্য সুপ্রিয়ার জীবন হয়ে উঠেছিল পুরোপুরি উত্তমময়।

 

উত্তম-সুপ্রিয়ার প্রেম

১৯৬০ সালে মুক্তি পায় উত্তম-সুপ্রিয়া জুটির ব্যবসাসফল ছবি ‘শুন বরনারী’। সহশিল্পী হিসেবে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। দুজনেরই ব্যক্তিজীবনের শূন্যতা থেকে হয়তো জন্ম নেয় প্রেম। এই প্রেম ছিল পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। উত্তমের ওপর সবকিছুর জন্যই ভীষণ নির্ভর করতেন সুপ্রিয়া। অনেক সময় একসঙ্গে শুটিংয়ে যাওয়া-আসা করতেন তারা। এ নিয়ে গৌরী দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের দাম্পত্য কলহ চরম আকার ধারণ করে। অন্যদিকে সুপ্রিয়ার মধ্যে তিনি খুঁজে পান বিশ্বস্ত বন্ধু, নির্ভরযোগ্য সহকর্মী এবং তার শিল্পী সত্তার অনুরাগীকে।

 

সুপ্রিয়ার ঘরে যেভাবে উত্তম

বড় প্রেম দূরে ঠেলে দেয়-কথাটি যেমন অনেক ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি সব বাধা পায়ে দলে কাছে টেনে আনে দুজনকে- সেটিও সত্যি। গৌরীর সঙ্গে সংসারে ভীষণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন উত্তম। সুপ্রিয়াও বিশ্বনাথকে ডিভোর্স দিয়েছেন। প্রতিদিনই সুপ্রিয়ার ময়রা স্ট্রিটের বাসায় আসতে লাগলেন উত্তম। এক দিন আর ফিরে গেলেন না। ১৯৬৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর গিরিশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাসভবন থেকে উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ফ্ল্যাটে। গৌরীকে ডিভোর্সও দেননি উত্তম। তাই সুপ্রিয়াকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করতে পারছিলেন না। অনেকে নিন্দা করেছে অনেক। দুজনই কারও ধার ধারেননি। নিজের স্ত্রী এবং বাড়ি ছেড়ে উত্তম নিজের জীবনের শেষ সতের বছর সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই কাটিয়েছেন। সুপ্রিয়াও স্বামীকে পাকাপাকিভাবে ছেড়ে উত্তমের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হয়নি। উত্তমের মৃত্যুর পর সুপ্রিয়া তার স্মৃতিগুলো আঁকড়েই বাকিটা জীবন বেঁচে ছিলেন।

 

সুপ্রিয়ার হিন্দি ছবির জগৎ ত্যাগ

১৯৬২ সালের ২ ডিসেম্বর উত্তম-সুপ্রিয়ার বিয়ে হয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়। ৫ ডিসেম্বর তারা বিবাহ-উত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যেখানে চলচ্চিত্র জগতের প্রচুর অতিথির সমাগম হয়। তবে গৌরী দেবীর সঙ্গে আইনগতভাবে বিচ্ছেদ না হওয়ায় তারা রেজিস্ট্রি করতে পারেননি। স্বামী হিসেবে উত্তম ছিলেন খুবই রোমান্টিক এবং কখনো কখনো বেশ ঈর্ষাকাতর। উত্তমের বারণ মেনেই হিন্দি ছবির জগৎ ত্যাগ করেন সুপ্রিয়া। বাড়িতে প্রযোজক ও পরিচালকদের বেশি আসা-যাওয়া এবং সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে আড্ডা একেবারেই পছন্দ করতেন না উত্তম। তবে উত্তমের নারী সহকর্মী, ভক্ত কিংবা উঠতি নায়িকাদের মাত্রাতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতায়ও ঈর্ষা বোধ করতেন না সুপ্রিয়া। কারণ তিনি জানতেন উত্তম এদের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। এমনকি সুচিত্রা সেনকেও ঈর্ষা করেননি। পর্দায় সুচিত্রা-উত্তমের রোমান্টিক দৃশ্য দেখেও তিনি বুঝতেন সেটা নিছক অভিনয়।

 

উত্তমের একান্ত ‘সুপ্রিয়া’

‘মেঘে ঢাকা তারার’ নীতা হিসেবে সুপ্রিয়ার অভিনয় তাকে করে রাখবে অমর। নীতার সঙ্গে বাস্তবের সুপ্রিয়ারও অনেক মিল। দুজনই পরিবারে অভাব দেখেছে, মায়ের অনাদর পেয়েছে। দাদা সংগীতে নাম করবে বলে নীতা যেমন আত্মত্যাগ করেছে, সুপ্রিয়াও উত্তম চলচ্চিত্রে নাম করবে বলে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। নীতা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল প্রেমিকের কাছে। সুপ্রিয়াও উত্তমকে পেয়েও যেন পাননি। তবু বেণু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুপ্রিয়া ব্যানার্জি, সুপ্রিয়া চৌধুরী হয়ে সুপ্রিয়া দেবী-এই চলচ্চিত্রযাত্রার নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে তিনি শুধুই উত্তমের একান্ত ‘সুপ্রিয়া’।

 

মহানায়কের প্রিয় সুপ্রিয়ার রান্না

নিত্যনতুন রান্না করতে ভালোবাসতেন সুপ্রিয়া। তার হাতের রান্না ছাড়া উত্তম খেতে পারতেন না। পরে ‘বেণুদির রান্না’ ইন্ডাস্ট্রিতে একটা মিথ হয়ে দাঁড়াল। রান্নার বই লিখেও বেণুদি কিংবদন্তি বনে যান।

 

উত্তম-সুপ্রিয়ার জীবনে আর কোনো প্রেম আসেনি

উত্তমের জীবনে সুপ্রিয়া ছাড়া আর কোনো নারী যেমন ছিলেন না, তেমনি সুপ্রিয়ারও জীবনে আর কোনো প্রেম আসেনি। যৌথ জীবনে অনেক অপবাদ ও লোকনিন্দা সহ্য করতে হয়েছে উত্তম-সুপ্রিয়াকে। কিন্তু তাদের প্রেম যে সত্যিই চিরদিনের তা সময়ের কষ্টিপাথরে প্রমাণিত হয়েছে।

 

উত্তমের ময়ূরপুচ্ছ ধুতি-পাঞ্জাবি আর সুপ্রিয়ার সুগন্ধি সমাচার

সুপ্রিয়ার জামদানি শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ আর সুগন্ধিতে ময়রা স্ট্রিটের বাড়ি মউ মউ করত। ঘাড়ের কাছে একটা সেন্ট মাখতেন সুপ্রিয়া, যা আবেদন সবার কাছে বাড়িয়ে দিত। সুগন্ধির গন্ধ মিশে যেত সুপ্রিয়ার হাতের রান্না মসলার জাদুতে। সঙ্গে ময়ূরপুচ্ছ ধুতি-পাঞ্জাবিতে উত্তম কুমার। উত্তম কুমার বলতেন, তিনি তিনটি জিনিস খেতে ভালোবাসতেন-চা চিনি চুমু আর বিশেষ একজনের (সুপ্রিয়া) হাতের রান্না! এই বলে বেণুদির দিকে তাকিয়ে চোখটা স্লাইট মেরে দিতেন উত্তমভঙ্গিতে।

 

এই জুটির অভিনীত সেরা ছবি  

উত্তম কুমারের বিপরীতে বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া দেবী। উল্লেখযোগ্য সিনেমা হচ্ছে মেঘে ঢাকা তারা, উত্তর মেঘ, বিধিলিপি, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, চৌরঙ্গী, উত্তরায়ণ, কাল তুমি আলেয়া, বাঘ বন্দী খেলা, দুই পুরুষ, দেবদাস, সোনার হরিণ, সব্যসাচী, বহ্নিশিখা, যদি জানতেম, বন পলাশীর পদাবলী, দুই পৃথিবী, বসু পরিবার, শুন বরনারী, চিরদিনের, শুধু একটি বছর, সন্ন্যাসী রাজা প্রভৃতি।

 

উত্তম আকাশে সুপ্রিয়ার যাত্রা

মৃত্যুর আগ অবধি দুইজনের মধ্যে দারুণ এক বোঝাপড়া টিকেছিল। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা যান উত্তম। এরপর থেকে জীবনের শেষদিন অবধি স্বামী, পরমবন্ধুর স্মৃতিচারণা করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সুপ্রিয়া। ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের ৬৯তম প্রজাতন্ত্র দিবসের ভোরে নিজ বাসভবনে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত বর্ণময় এক চরিত্র সুপ্রিয়া দেবী। উত্তম আকাশে ডানা মেলেন সুপ্রিয়াও।  শেষ হয় উত্তম-সুপ্রিয়া অধ্যায়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর