রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

ওয়াহিদার বিরহে গুরুর আত্মহত্যা

ওয়াহিদার বিরহে গুরুর আত্মহত্যা

গুরু দত্ত অভিনীত ‘কাগজ কে ফুল’ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘বিছড়ে সাভি বারি বারি’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘একে একে সবাই ছেড়ে গেল’- ওই সময় সবাই বলত এই ছবি আর ছবির এ গানটি যেন গুরু দত্তের করুণ জীবনের ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করে দিয়েছিল।  গুরু দত্তের জীবনের বিচিত্র প্রেম কাহিনি ও এর পরিণতির কথা তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ

 

কে এই গুরু দত্ত

পঞ্চাশের দশকে গুরু দত্ত ছিলেন একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, চিত্র নাট্যকার ও অভিনেতা। এই চার ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন সফল। শুধু তাই নয়, গুরু দত্ত এগিয়ে ছিলেন তার সময়ের চেয়ে। তার পরিচালিত ‘পিয়াসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ ছবি দুটিকে বলা হয় বলিউডের শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সৃষ্টি।  তার পরিচালিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘বাজি’, ‘বাজ’, ‘পিয়াসা’, ‘আর পার’,  ‘জাল’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ’, ‘সয়লাব’। প্রযোজক ছিলেন ‘আর পার’, ‘সিআইডি’, ‘পিয়াসা’, ‘গৌরি’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘চৌধভিন কা চান্দ’, ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’, ‘বাহারে ফির ভি আয়েগি’ ছবির। অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন জনপ্রিয়। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’সহ বিভিন্ন ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি। গুরু দত্তর জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ জুলাই। তার নাম ছিল বসন্তকুমার শিব শঙ্কর পাড়ুকোন। দক্ষিণ ভারতের অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান তিনি। গুরু দত্ত ছিল তার পর্দা নাম। বাবা-মা দুজনই শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ফলে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। কলকাতার ভবানীপুরে শৈশব কাটে তার। তিনি বাঙালি সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন। বাঙালিদের মতোই বাংলা বলতে পারতেন। এ জন্যই বাঙালি নাম গ্রহণ করে হয়ে গেলেন গুরু দত্ত।

 

গীতা দত্তের সঙ্গে প্রেম

গুরু দত্ত ১৯৫০ সালে তখনকার বিখ্যাত গায়িকা গীতা দত্তের প্রেমে পড়েন। গুরুর প্রথম ছবি বাজি’তে তিনি নেপথ্য গায়িকা। স্টুডিও রেকর্ডিং করতে এসেছেন গীতা। উপস্থিত গুরুও। সেখানেই প্রথম চোখাচোখি। প্রথম দর্শনেই হাবুডুবু প্রেম। টানা প্রেমের সময় দুজনের চিঠি দেওয়া-নেওয়া করতেন গুরুর বোন ললিতা লাজমি। পরে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, গীতা যে শুধুই কোকিলকণ্ঠী ছিলেন তাই-ই নয়, ভয়ানক রূপসীও ছিলেন। যেন খোদাই করা অজন্তা গুহার ভাস্কর্য। এভাবে চলতে চলতে এলো সেই পূর্ণিমার রাত। জ্যোৎস্নায় ভাসছে পৃথিবী। চাঁদের আলোয় মাখামাখি গীতার বাংলো। সেই রাতেই বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ললিতাকে বলেছিলেন গীতা, ‘তোমার ভাইকে বিয়ে করব।’

 

পরিবারের অমতে বিয়ে

১৯৫৩ সালের ২৬ মে। ধুমধাম করে সাতপাক ঘুরলেন গীতা-গুরু দত্ত। দুজনের চোখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। আকাশের তারারাও যেন নতুন দম্পতির আনন্দে অনেক বেশি জ্বলজ্বলে। অনেক বেশি বড়। দুই পরিবারেরই দারুণ অমত ছিল এই বিয়েতে। বিশেষ করে গীতা দত্তের পরিবার। কারণ, গীতা বাংলাদেশের জমিদার দত্ত বাড়ির মেয়ে। বলিউডে তার গান যথেষ্ট জনপ্রিয়। গুরু তখন সবে পা রেখেছেন হিন্দি ছবির দুনিয়ায়। মারাঠি ব্রাহ্মণ। কিন্তু মিঞা-বিবি রাজি তো ক্যায়া করেগা কাজি। তাই বিয়েটা হয়েই গেল। সারা রাত কানে কানে গুনগুনে মধুরাত কেটে গেল দেখতে দেখতে।

 

ওয়াহিদার সঙ্গে প্রেম

গীতা দত্তকে বিয়ের তিন বছরের মাথায় ১৯৫৬ সালে গুরু দত্তর সঙ্গে পরিচয় হয় ওয়াহিদা রেহমানের। ওয়াহিদা তখন তেলেগু ছবিতে অভিনয় করে খানিকটা খ্যাতি পেয়েছেন। এক ফিল্মি পার্টিতেই দুজনের আলাপ হয়। সুন্দরী ও পরিশীলিত ওয়াহিদার প্রতি আকৃষ্ট হন গুরু দত্ত। তিনি তাকে মুম্বাই নিয়ে আসেন। নিজের প্রযোজিত ‘সিআইডি’ ছবিতে খলচরিত্রে সুযোগ দেন তাকে। এরপর গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’তে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেন ওয়াহিদা। নিজের ‘চৌধভিন কা চান্দ’ ছবিতে ওয়াহিদার বিপরীতে অসামান্য অভিনয় করেন গুরু দত্ত। তাদের পর্দা-রসায়ন যেমন অনবদ্য ছিল, তেমনি ব্যক্তি জীবনেও তারা ছিলেন পরস্পরের সেরা বন্ধু। স্নিগ্ধ ও ধীরস্থির স্বভাবের ওয়াহিদার প্রেমে পড়ে যান ছটফটে ও আবেগপ্রবণ গুরু দত্ত। এই প্রেমের ফলে তাদের ক্যারিয়ারেও সাফল্য যোগ হয়। দুজনেরই অভিনয়ে পরিপক্বতা আসে।

 

সংসারে ঝড়

ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে প্রেম গুরু দত্তের দাম্পত্য জীবনকে করে তোলে বিষময়। স্ত্রী গীতা দত্ত তাকে ত্যাগ করেন। যদিও তাদের বিচ্ছেদ হয়নি কিন্তু তারা পৃথকভাবে বাস করতে শুরু করেন যা গুরু দত্তের মানসিক টানাপড়েন আরও বাড়িয়ে দেয়। কারণ তিনি যেমন ওয়াহিদাকে ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন নিজের স্ত্রীকেও। দুজনের কাউকেই ত্যাগ করতে চাননি তিনি।

 

ক্যারিয়ারে ভাটার টান

ওয়াহিদার সঙ্গে প্রেম এবং সংসার জীবনের ভাঙন গুরুর ফিল্মি ক্যারিয়ারে নেতিবাচক ছাপ ফেলে, দেখা দেয় ভাটার টান। এ সময় মুক্তি পাওয়া তার ছবি ‘কাগজ কে ফুল’ আশানুরূপ বাণিজ্যিক সাফল্যের দেখা পেল না। এ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদা-গুরু জুটি। যদিও কাহিনি, পরিচালনা, অভিনয় সব দিক থেকে ছবিটি ছিল এক অসামান্য সৃষ্টি। কিন্তু বিবাহিত পরিচালকের সঙ্গে নায়িকার প্রেমের কাহিনি সে সময়ের দর্শক গ্রহণ করতে পারেনি। পরবর্তীতে অবশ্য ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে সিনেমাটি। এ ছবির সে সময়কার ব্যর্থতা আবেগপ্রবণ গুরুকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছিল।

 

গুরুকে ছেড়ে যান ওয়াহিদা

ওয়াহিদার সঙ্গে প্রেমের পরিণতিতে গুরু দত্তের ব্যক্তিগত ও ফিল্মি ক্যরিয়ার যখন ভাটার মুখে তখন উল্টো চিত্র দেখা দেয় ওয়াহিদার ক্ষেত্রে। তার ক্যারিয়ার তর তর করে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। দেবানন্দের বিপরীতে তিনি তখন সফল নায়িকা। তার অভিনয় যেমন প্রশংসিত হতে থাকে তেমনি রূপের জন্যও তিনি পান দারুণ জনপ্রিয়তা। গুরু দত্তের কাছ থেকে দূরে সরে যান তিনি। অবশ্য ওয়াহিদা তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নন্দার কাছে আক্ষেপ করেছিলেন, তিনি সরে গিয়েছিলেন এই কারণে, যেন গুরু দত্তের বিবাহিত জীবনে শান্তি ফিরে আসে।

কিন্তু সেটি ছিল তার ভুল ধারণা। তিনি বুঝতে পারেননি এই বিরহে অভিমানী গুরু দত্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন।

 

অবেশেষে আত্মহননের পথে

ওয়াহিদাকে হারানোর হতাশা গুরুর জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছিল। এই বিরহব্যথা সইতে না পেরে জনপ্রিয় নির্মাতা-অভিনেতা গুরু দত্ত ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পান করেন। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ ও অ্যালকোহলের বিষক্রিয়া ৩৯ বছর বয়সী এই শিল্পীর অকাল মৃত্যু ঘটায়। অবশ্য এর আগেও ওয়াহিদার সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে দুবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

 

আত্মহত্যার আগে আশাকে ফোন

আত্মহত্যার আগে গুরু ফোন করেছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আশা ভোঁসলেকে। জানতে চেয়েছিলেন তার স্ত্রী সেখানে আছেন কি না। আশা ভোঁসলেই শেষ ব্যক্তি যিনি গুরু দত্তের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগের দিন তিনি গিয়েছিলেন গীতার কাছে। কারণ তিনি তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে ছুটি কাটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গীতা ছেলেদের দেননি। গুরু দত্তের ছেলে অবশ্য এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মেনে নেননি। তার মতে এটি ছিল দুর্ঘটনা। ওয়াহিদা রেহমান বিয়ে করেন ১৯৭৪ সালে, গুরু দত্তের মৃত্যুর ১০ বছর পর। গুরু দত্ত ও ওয়াহিদা রেহমানের এই প্রেম বলিউডের সবচেয়ে করুণ প্রেম কাহিনির মধ্যে অন্যতম।

সর্বশেষ খবর