সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

এক কিংবদন্তি আশা ভোঁসলের কথা

এক কিংবদন্তি আশা ভোঁসলের কথা

‘আশা ভোঁসলে’ ভারতীয় সংগীত জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম। টানা সাতবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া এ শিল্পী একসময় অনুরোধ করেন তাকে যেন আর পুরস্কার দেওয়া না হয়। এ কিংবদন্তির ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

প্রকৃত নাম আশা মঙ্গেশকর

আশা ভোঁসলের প্রকৃত নাম ‘আশা মঙ্গেশকর’। তার মঙ্গেশকর পদবিটি পৈতৃক সূত্রেই পাওয়া। বাবার নাম ছিল দীনানাথ মঙ্গেশকর। দীনানাথ ছিলেন মারাঠি সংগীত মঞ্চের একজন অভিনেতা ও শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। আশার যখন নয় বছর বয়স, তখন তার পিতা মারা যান। আশা ও তার বড় বোন লতা মঙ্গেশকর তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চলচ্চিত্রে গান গাওয়া ও অভিনয় শুরু করেন। তার গাওয়া প্রথম গান হলো মারাঠি ভাষার মাঝা বল (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে ‘চল চল নব বল’। হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে আশার অভিষেক হয় ১৯৪৮ সালে ‘সাবন আয়া’ ছবির গানে প্লেব্যাকের মাধ্যমে। আশা ভোঁসলে ১৯৩৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সঙ্গিল রাজ্যের (বর্তমান মহারাষ্ট্রে অবস্থিত) সঙ্গিল জেলার গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন।

 

যেভাবে ‘আশা ভোঁসলে’ হলেন

আশা তার দিদি লতা মঙ্গেশকরের সেক্রেটারি গণপত রাও ভোঁসলের প্রেমে পড়েন একসময়। লতার শত বারণ সত্ত্বেও গণপতের প্রতি আশার প্রেমের কমতি হয়নি কোনোভাবেই। ছোটবেলা থেকে দরিদ্রতার নাগপাশে বেড়ে ওঠা আশা যেন নিজের জীবনের সব ভরসা খুঁজে পান গণপতর মধ্যে। আশা মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিলেন গণপতকে। গণপতও তাকে রঙিন স্বপ্নে বুঁদ করে রেখেছিলেন। দিদির শাসন বারণ উপেক্ষা করে দুজনের আকাশ পাতাল প্রেম শেষ পর্যন্ত প্রণয়ে গড়ায়। গণপত ভোঁসলেকে বিয়ে করেছিলেন আশার মাত্র ১৬ বছর বয়সে। তারপর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত নিজের নামের পদবি ‘মঙ্গেশকর’ ছেঁটে ফেলে হয়ে যান ‘ভোঁসলে’। মানে স্বামীর পদবি ভোঁসলে গ্রহণ করে হয়ে যান আশা ভোঁসলে।

 

বেশিদিন টেকেনি বিয়ে

দিদি লতার অমতে বিয়ে করায় আশার মুখ দেখা, কথা বলা বন্ধ করে লতা। গণপতকে চাকরিচ্যুতও করেন তিনি। বেকার গণপতকে নিয়ে আবার জীবন সংগ্রামে নামেন আশা ভোঁসলে। প্রবাদ আছে ‘অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢুকে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’। আশার জীবনে এ প্রবাদটিই সত্যি হয় একসময়। আশা তখন তিন ছেলেমেয়ের মা। অভাবের তাড়নায় সংসারের বোঝা বইতে না পেরে ছেলেমেয়েসহ আশাকে বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেন গণপত।

 

রাহুল দেবের প্রেমে

১৯৬৬ সাল। প্রখ্যাত সংগীতকার শচীন দেব বর্মণের ছেলে গায়ক রাহুল দেব বর্মণ পঞ্চম প্রেমে পড়ে বিয়ে করেন তারই অন্ধভক্ত রীতা পটেলকে। প্রায় ৫ বছরের মাথায় ১৯৭১-এ এসে বোঝাপড়ার ভার সামলাতে না পেরে দুই দিকে সরে যান দুজনেই। এরপর সম্পর্ক, প্রেম, বিয়ের পথে আর না হেঁটে গানের নেশায় বুঁদ হয়ে রইলেন পঞ্চম। কিন্তু ‘শিল্পীর জীবনে যে প্রেম ঘুরে-ফিরে আসে’ সেই কথা সত্যি প্রমাণ করে ফের ভালোবাসায় জড়িয়ে গেলেন রাহুল। এবার তার জীবনে এলেন তার বয়স থেকে ৬ বছরের বড় আশা ভোঁসলে। আপাদমস্তক যিনি সুরেলা। আশার জীবনেও ততদিনে সুর কেটেছে একবার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে গণপত রাও ভোঁসলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন আশাজি। তার সেই ঘর টেকেনি। সুরে-সুরে, গানে-গানে দুই ঘরপোড়া গরু যখন এক হয়েছিলেন, ভয় ছিল দুজনার মনেই। তাই ভালোবাসলেও সেকথা মুখ ফুটে প্রথমে কিছুতেই আশাজিকে জানাতে পারেননি রাহুল। একের পর এক গান গাইয়েছেন রাহুল তাকে দিয়ে। বেশিক্ষণ কাছে পাওয়ার আশায়। সেই গানে গানেই বোঝাতে চেষ্টা করতেন, আশা তার পরম পাওয়া। আশা আরও একটু সাহসী। তাই পঞ্চমকে আদর করে ডাকা শুরু করেছেন ‘বাবস’ বলে। কিন্তু ভালোবাসার কথা বলতে ভয় ছিল তারও। শেষে একদিন আশাকে দিয়ে গাওয়ালেন রাহুল, ‘কহে দু তুমহে, ইয়া চুপ রহু...’, মানে ‘তুমি কি কিছু বলবে নাকি চুপ করেই থাকবে?’ গান রেকর্ডিংয়ের পর আশা যখন বেরিয়ে আসছেন রেকর্ডিং রুম থেকে তখন রাহুল তাকে নরম গলায় বললেন, আর কীভাবে বলে বোঝাতে হবে। লজ্জায় লাল আশা সেদিন কোনো কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে বলেছিলেন, সব বুঝেছেন। আর বলতে হবে না। এরপর ১৯৮০ তে ফের সাতপাক ঘোরেন রাহুল দেব বর্মণ-আশা ভোঁসলে।

 

যেভাবে আশার জীবনে রাহুল

আশার জীবনে রাহুল এসেছিলেন সই শিকারি হয়ে। একদিন আশা এসেছেন শচীন দেব বর্মণের স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং করতে। সময়টা ১৯৫৬ সাল। আশা ততদিনে ‘গুমরাহ’, ‘ওয়াক্ত’, ‘আদমি অউর ইনসান’, ‘হামরাজ’ ছবির গানের দৌলতে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। রাহুল দেব তখন বাবার সহকারী। কলেজে পড়েন। স্টুডিওর কালো কাচের বাইরে থেকে আশাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছিলেন রাহুল। এই তার স্বপ্নের সেই গায়িকা? অটোগ্রাফ নিতে হবে, একথা মনে হতেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। গান শেষ হওয়ার পরে স্টুডিওর বাইরে আসতেই গায়িকার দিকে খাতা বাড়িয়েছিলেন ভবিষ্যতের ‘রকস্টার’ সুরকার আর ডি বর্মণ। সেই সই দেওয়া থেকে শুরু। সেদিনই কি রাহুলের মনে হয়েছিল, ‘ইয়ে লাড়কি জারাসি দিওয়ানি লাগতি হ্যায়’...?

 

রাহুলকে হারানোর ভয়

১৯৮০-তে বিয়ে হলো সুর-তাল-ছন্দ আশ্রয় করে বেঁচে থাকা দুই শিল্পীর। রাহুল-আশা গানের দুনিয়ায় প্রথম তারকা দম্পতি, যারা একসঙ্গে ১৪ বছর বাঁধা ছিলেন গান দিয়ে। ‘তোমায় কোনোদিন ছেড়ে যাব না...ইয়ে ওয়াদা রাহা’...রাহুল এ শপথ আশাকে করলেও গায়িকার মনে প্রচ- ভয়। গণপতের থেকে পাওয়া অসম্মান কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারেন না। তার ওপর বছর ছয়েকের বড় তিনি রাহুলের থেকে। শাশুড়ি মা তাই খুশি নন এ বিয়েতে। বিয়ের দিনও নিন্দুকে মুখ মচকেছে, ‘তিন সন্তানের মাকে বিয়ে করল রাহুল! শেষ পর্যন্ত টিকলে হয়।’ ফুলশয্যায় খুব ভয়ে ভয়ে সেকথা ‘বাবস’কে জানিয়ে আশার প্রশ্ন ছিল, ‘সবাই যা বলছে তেমনটা হবে না তো? তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যাবে না তো?’ সেদিন নতুন বউয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রাহুল আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে, ‘দুনিয়া ছাড়লেও আমি তোমায় কোনোদিন ছেড়ে যাব না...ইয়ে ওয়াদা রাহা’...। বাস্তবে ঠিকই রাহুল তাকে ছেড়ে যাননি, কিন্তু নিয়তি বড়ই নির্মম, এবার জীবনের নির্মোঘ সত্য ‘মৃত্যু’ আশার দ্বিতীয় সংসার ভেঙে তছনছ করে দিল। রাহুলকে কেড়ে নিল তার জীবন থেকে। ১৪ বছর সুর নিয়ে, গান নিয়ে একসঙ্গে ঘর করার পর ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে পাকাপাকি বাসিন্দা হলেন পঞ্চম।

 

ভোঁসলে পদবি পাল্টাননি আশা

কথায় আছে ‘প্রথম প্রেমের স্মৃতি নাকি কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।’ আশার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল বলে বলতেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। প্রথম স্বামী গণপতের সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং পরবর্তীতে রাহুল দেব বর্মণকে বিয়ে করলেও প্রথম স্বামীর পদবি ‘ভোঁসলে’ আজ পর্যন্ত ত্যাগ করেননি আশা। এখনো আশা ভোঁসলে হয়েই রইলেন তিনি।

 

গানের জগতে যত প্রাপ্তি

সংগীতজীবনে দীর্ঘ ৫ দশক সেরা শিল্পীর দৌড়ে ছিলেন আশা ভোঁসলে। ১৯৫৭ সালে নয়া দৌড়, আশা, নবরঙ্গ, মাদার ইন্ডিয়া, দিল দেকে দেখো, পেয়িং গেস্ট প্রভৃতি চলচ্চিত্রে একের পর এক হিট গান গেয়ে বড় বোন লতাকে হটিয়ে রাতারাতি বলিউডের শীর্ষস্থান পেয়ে যান আশা, যার পুরোটাই ওপি নায়ারের বদৌলতে। ১৯৫৮ সালে হাওড়া ব্রিজ, কাগজ কে ফুল, ফাগুন প্রভৃতি ছবির মাধ্যমে জয়যাত্রা অব্যাহত রাখেন। ’৭০ আর আশির দশকে আশার কণ্ঠ বেশি আরোপ করা হতো জীনাত আমান, পারভীন ববি, রেখা, হেলেন ও শর্মিলা ঠাকুরের প্রতিটি ছবিতে। আজ পর্যন্ত আশা তার গায়কী অক্ষুণœ রেখেছেন অনবদ্য উচ্চতায়।

 

যত সম্মাননা

১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আশা ভোঁসলে সাতবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা নেপথ্য গায়িকার পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৭ সালের পর তিনি জানান যে তার নাম যেন আর ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য গণ্য করা না হয়। ২০০১ সালে তিনি ‘ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’ পান। আশার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো ‘বলিউডের সর্বকালের সেরা কণ্ঠশিল্পী’ নির্বাচিত হওয়া। ২০১৫ সালে তখন ৮১ বছর বয়সী বর্ষীয়ান এ গায়িকা টপকে গেছেন নিজের বড় বোন লতা মঙ্গেশকরকে। ৮৫ বছর বয়সী লতা হয়েছেন দ্বিতীয়। ওই বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা ‘ইস্টার্ন আই’ সেরা ২০ কণ্ঠশিল্পীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। গানের সংখ্যা, সম্মাননা, আন্তর্জাতিক প্রভাব, বৈচিত্র্য, ভক্তসংখ্যা এবং সংগীতাঙ্গনে জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে তালিকাটি তৈরি করা হয়। খবরটি জেনে আশা নিজেই চমকে গিয়েছিলেন। তার কথায়, ‘ভেবেছিলাম সেরা তকমাটা বক্সার মুহাম্মদ আলীর জন্যই ছিল। ইস্টার্ন আই এবং সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এতদিন ধরে আমাকে সহ্য করে যাওয়ার জন্য।’ সেরা কণ্ঠশিল্পীদের তালিকায় প্রয়াত মোহাম্মদ রফি তৃতীয় আর কিশোর কুমার হয়েছেন চতুর্থ। শীর্ষ ২০ জনের মধ্যে আরও ছিলেন মুকেশ (৫), শ্রেয়া ঘোষাল (৭), গীতা দত্ত (১০), সনু নিগাম (১৪), কুমার শানু (১৭) এবং কবিতা কৃষ্ণমূর্তি (১৯)। ইস্টার্ন আই পত্রিকার বিনোদন সম্পাদক আসজাদ নাজির বলেন, ‘তালিকার শীর্ষস্থানটা নিঃসন্দেহে আশা ভোঁসলের প্রাপ্য। প্রচুর গান গাওয়ার পাশাপাশি তার কাজের সবচেয়ে বড় দিক হলো বৈচিত্র্য। আট দশক ধরে একের পর এক রেকর্ড ভেঙে অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ার গড়েছেন তিনি।’

সর্বশেষ খবর