রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

এফডিসির শুটিং ফ্লোর ভেঙে কী হচ্ছে

আলাউদ্দীন মাজিদ

এফডিসির শুটিং ফ্লোর ভেঙে কী হচ্ছে

৩ ও ৪ নম্বর শুটিং ফ্লোরের ভাঙার কাজ চলছে

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থায় নির্মিত হচ্ছে বিএফডিসি কমপ্লেক্স। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, দুঃখের কথা হলো এফডিসিতে কেন আবাসিক হোটেল, শপিংমল, শিশুদের খেলার জায়গা ইত্যাদি থাকবে। এখানে এসব যদি থাকে তাহলে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও শিল্পীদের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে না। অন্যদিকে এফডিসি কর্তৃপক্ষের কথা হলোÑএটি চলচ্চিত্র নির্মাণের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। এদিকে গত সপ্তাহ থেকে চলছে পুরনো ৩ ও ৪ নম্বর শুটিং ফ্লোর এবং এডিটিং ভবন ভাঙার কাজ। এ বিষয়ে চলচ্চিত্রকারদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো-

 

এমন বিকৃতি সমর্থন করি না : কবরী

বিএফডিসিতে ‘কমপ্লেক্স’-এর নামে আবাসিক হোটেল, বীমা অফিস, ফুড কর্নার কেন? যদি বলা হয় এফডিসি একটি রুগ্ন সংস্থা, আর একে বাঁচাতে এই উদ্যোগ তাহলে এটি ভুল ধারণা। এখানে কিসের লস, এফডিসি হলো সিনেমা নির্মাণের কারখানা। সরকার যদি সিনেমা নির্মাণের সব উদ্যোগ নেয়, সিনেমা হল তৈরির ব্যবস্থা করে, যথাযথ নির্মাতাদের উপযুক্ত অনুদান দেয়- তা হলে তো এই শিল্পের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই হয়ে যাবে। এর জন্য তো এফডিসিতে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্রয়োজন নেই। এফডিসি হলো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া তারই একটি স্বপ্নের সংস্থা। এর যে কোনো স্থাপনা ভেঙে ফেলা মানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অবমূল্যায়ন করা। পরবর্তীতে যারা আসবেন তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে পাবে না। এ ধরনের বিকৃতি কারও কাম্য হতে পারে না। চলচ্চিত্রের সময় মন্দ যাচ্ছে বলে ঐতিহ্য মুছে ফেলতে হবে? তাহলে কি একদিন এমন অজুহাতে দেশের জাতীয় সংগীত ‘সোনার বাংলা’ও মুছে ফেলা হবে! আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই-এমন অবমূল্যায়ন কখনো সমর্থন করি না।

 

এটি ঠিক হবে না : ববিতা

ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি এটি চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। মানে এখানে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজই হবে। এখানে কেন আবাসিক হোটেল বা অন্য কোনো স্থাপনা থাকবে। একদম ঠিক নয়। কারণ এটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। আবাসিক হোটেলে যখন বাইরের লোকজন ভাড়ায় থাকবে তখন চলচ্চিত্র নির্মাণ ও শিল্পীদের প্রাইভেসি বলে কিছু কি থাকবে? এমন উদ্যোগ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা না বলে কে নিল বা কেন নেওয়া হলো বুঝতে পারছি না। এখানে টিভি বা নাটকের অফিসও থাকা উচিত নয়। কারণ এফডিসি হলো শুধুই চলচ্চিত্র নির্মাণের সংস্থা। চলচ্চিত্রের সুদিন আবার ফিরবে বলে আমি আশাবাদী। বিএফডিসিকে আমি শুধুই চলচ্চিত্র উন্নয়ন ও নির্মাণের স্থান হিসেবে দেখতে চাইÑ এর বাইরে কিছু নয়।

 

আমি কিছুই জানি না : আলমগীর

এফডিসিতে যে ‘বিএফডিসি কমপ্লেক্স’ নির্মাণ হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি। তাই এ ব্যাপারে তেমন কোনো মন্তব্য করতে চাই না। শুধু বলব, এটি কী হবে বা এতে চলচ্চিত্রের কতটা কল্যাণ হবে বুঝতে পারছি না। এখানে উন্নয়নটা কোথায় তাও বুঝতে পারছি না। এটি যদি এফডিসির স্টাফদের বেতন প্রদানের নিশ্চয়তার জন্য করা হয় তাহলে তা হবে দুঃখজনক। কারণ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই সংস্থাটির নাম তিনিই দিয়েছেন বিএফডিসি বা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। তাই এখানে যেভাবে চলচ্চিত্র উন্নয়নের কাজ অতীতে হয়ে এসেছে তাই হবে, আমি শুধু তাই বুঝি।

 

এমন সংস্কার চাই না : মৌসুমী-সানি

এফডিসির আধুনিকায়ন হতেই পারে। কিন্তু এফডিসিতে কেন বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হবে? বাণিজ্যিকতা মানেই নানা রকম লোক সমাগম। এফডিসিতে নানা রকম মানুষ কেন আসবে? যেখানে কাজ নেই, সিনেমা নেই, সেখানে এফডিসিতে এমন সংস্কার (?) আসলে ভালো কিছু বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। আশা করছি, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে।

 

বাণিজ্যিক ভবন কেন : শাকিব খান

আমি এফডিসির উন্নয়নের পক্ষে। তবে সেটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে নয়। এখানে আধুনিক ভবন হতে পারে। কিন্তু এফডিসিতে ফ্লোর ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার যৌক্তিকতা কী সেটি আমি জানি না। এটি যে আমাদের মতো শিল্পী, কলা-কুশলীদের আবেগের জায়গা, তারা সেটা অনুধাবন করতে পারছেন না। বাণিজ্য দিয়ে সব কিছু হয় না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও এফডিসির যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন করলে এবং সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে আধুনিক সিনেমা হল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিলে এফডিসি এমনিতেই লাভবান হয়ে উঠত। এখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে আমাদের মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারে বলে আমি মনে করছি না।

 

মার্কেট কেন : মিশা সওদাগর

এফডিসিতে এমন অনেক বিষয় বা জায়গা আছে যেগুলোর সংস্কার করা খুব জরুরি; অথচ সেদিকে কোনো নজর নেই। কেন নেই সেটিই বুঝি না। অথচ শুটিং ফ্লোর ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন ও সিনেপ্লেক্স। এ দিয়ে কী হবে? আমাদের দরকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অভিনয় চর্চার জায়গা। এগুলো তৈরি করলে আমাদের অনেক উপকার হবে। শুটিং ভবন ভেঙে মার্কেট নির্মাণের পক্ষে আমি নই।

 

এটি তামাশা : খোরশেদ আলম খসরু

চলচ্চিত্রের মানুষের সঙ্গে এটি একটি তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আগে আমরা বলতাম প্রযোজক বাঁচলে সিনেমা হল বাঁচবে, এখন বলি সিনেমা হল বাঁচলে চলচ্চিত্র বাঁচবে। যেখানে দেশে সিনেমা হল এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, চলচ্চিত্র নির্মাণ তলানিতে এসে ঠেকেছে, চলচ্চিত্র শিল্প আরও অনেক সমস্যায় জর্জরিত সেখানে এসবের উন্নয়ন না করে এফডিসিতে শুটিং ফ্লোর আর এডিটিং ভবন ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ কার স্বার্থে হচ্ছে? আবারও বলব আগে সিনেমা হল বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক, তারপর অন্য কিছু।

 

এফডিসির স্বকীয়তা নষ্ট হবে : বদিউল আলম খোকন

এফডিসিতে কেন বাণিজ্যিক ভবন হবে। একে এফডিসির অঙ্গহানি বলা যায়। এ ধরনের কমপ্লেক্সে এফডিসি কর্তৃপক্ষ স্বাবলম্বী হলেও এফডিসির স্বকীয়তা নষ্ট হবে। এটি আমি চাই না।

 

এখানে শপিং মল হবে না : অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলী

এটি কোনো বাণিজ্যিক ভবন নয়, এটি হলো বিএফডিসি কমপ্লেক্স। এখানে শপিং মল থাকছে না। আবাসিক হোটেল রাখার কারণ দেশের বা ঢাকার বাইরে থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে নির্মাতা, শিল্পী, কলা-কুশলী এলে তাদের এখানে রাখা হবে। বাইরের মানুষকেও ভাড়া দেওয়া হবে। তবে একটি সুরক্ষিত জোনের মধ্যে থাকবে। আসলে চলচ্চিত্রকাররা যেভাবে এটিকে বাণিজ্যিক ভবন ভাবছে আসলে তা নয়, এটি হবে চলচ্চিত্র নির্মাণের আধুনিক স্থাপনা। চলচ্চিত্র সমিতির কর্মকর্তাদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এই প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে।

 

কী থাকছে বিএফডিসি কমপ্লেক্সে

এফডিসির ৩, ৪ ও ৫ নম্বর শুটিং ফ্লোর, পুরনো ১ ও ২ নম্বর এডিটিং ভবন, সুইমিং পুল, মেকাপ শেড, ব্যবস্থাপক ও সহকারী ব্যবস্থাপক সমিতির কক্ষ এবং পুলিশ শেড এবং এফডিসির মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে থাকা স্থাপনায় নির্মিত হচ্ছে এই বিএফডিসি কমপ্লেক্স। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর ৩২২ কোটি ৭০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে জানানো হয়, মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রশিল্পকে উজ্জীবিত করতে বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় বহুতল এফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হবে চারটি থ্রিডি অত্যাধুনিক সিনেপ্লেক্স। নির্মাণ করা হবে ৭৩ হাজার ৪৬৯ বর্গমিটার শুটিং ফ্লোর। এর ফলে বিনোদনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে চলচ্চিত্র শিল্পে বিরাজমান মহামন্দা থেকে গৌরবময় সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আওতায় নির্মিতব্য ভবনে নানা রকম কারিগরি ও আধুনিক সুবিধা স্থাপন করা হবে। ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভবনটিতে ছাপ থাকবে হাতিরঝিল প্রকল্পের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের। এর আওতায় স্থাপন করা হবে ডিজিটাল প্রজেক্টর ও উন্নত সাউন্ড সিস্টেমসমৃদ্ধ চারটি সিনেপ্লেক্স। বিএফডিসির সিনেপ্লেক্সে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে। দর্শক প্রেক্ষাগৃহমুখী হলে বাড়বে চলচ্চিত্র নির্মাণের হার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৭ সালে বর্তমানের এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএফডিসি কমপ্লেক্সে সিনেপ্লেক্স, তিন তারকা হোটেলসহ চলচ্চিত্র নির্মাণের অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকছে। বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতারাও এখানে ছবির কাজ করতে পারবেন। ৯৪ কাঠা জমির ওপর নির্মিত হবে ২০তলা ভবনের নতুন এই কমপ্লেক্স। এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর বিষয়টি নিয়ে এফডিসিতে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও এমডির মধ্যে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকেই এফডিসিকে আধুনিকীকরণের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর নকশায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে একটি অত্যাধুনিক শপিং কমপ্লেক্স, চলচ্চিত্রবিষয়ক পাঠাগার, ক্যামেরা লেন্সসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিক্রির ব্যবস্থা, সিনেপ্লেক্স, তিনটি শুটিং ফ্লোর, চারটি প্রদর্শনী কক্ষ নিয়ে তৈরি একটি মাল্টিপ্লেক্স, শিশুদের বিনোদনের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা, বিশেষ শিশুদের জন্য খেলার জায়গা, ফুড কর্নার, চেইনশপ, প্রযোজনা সংস্থার অফিস, তিনটি বেজমেন্টস, বেসরকারি চ্যানেলের শুটিংয়ের জন্য স্টুডিও রুম, ছাদে জমনেশিয়াম, সুইমিং পুল ও রেস্তোরাঁ। এই প্রকল্প থেকে অর্জিত বার্ষিক আয় এফডিসির খাতেই জমা হবে।

বিএফডিসি কমপ্লেক্সের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী। আর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আছেন, এফডিসির কারিগরি ও প্রকৌশল পরিচালক কে এম আইয়ুব আলী। আগামী বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

সর্বশেষ খবর