সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

গানের জগতে মাহমুদুন্নবী পরিবার

গানের জগতে মাহমুদুন্নবী পরিবার

বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তি শিল্পী মাহমুদুন্নবী। অনুকরণীয় কণ্ঠশৈলীতে চমৎকার সব গান গেয়ে ষাটের দশকে আধুনিক বাংলা গানে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কেবল গানই লালন করেছেন তাঁর হৃদয়ে। এ যুগেও তাঁর গানের আবেদন অমলিন। তাঁর সুযোগ্য চার সন্তান ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, রিদওয়ান নবী পঞ্চম এবং তানজিদা নবী বাবার পথেই হাঁটছেন। এই সংগীত পরিবারকে নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

বেদনা ও প্রেমের শিল্পী

১৯৩৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানের কেতু নামক অজপাড়া গাঁয় মাহমুদুন্নবীর জন্ম। দেশবিভাগের পর সপরিবারে তাঁরা তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং খুলনায় স্থায়ী হন। তবে বাবার কর্মক্ষেত্র ফরিদপুরেই কেটেছে মাহমুদুন্নবীর শৈশব ও কৈশোর। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে কিছুকাল চট্টগ্রামে, পরে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর চেতনা আর শিল্পীসত্তা চালিত হয়েছিল সুরের টানে। ঢাকার ইসলামপুরে একজন ওস্তাদের কাছে কিছুকাল গানের তালিম নেন মাহমুদুন্নবী।

 

গানের ভুবনে উজ্জ্বল অনুপ্রবেশ

১৯৫৫ সালে এসএসসি পাস করার পরপরই সুরের টানে বাড়ি থেকে পালিয়ে করাচি যান তিনি। শেখ লুৎফর রহমান, নিজাম উল হকদের সঙ্গে এক মেসে থাকতেন। সেখানে মাঝে মাঝে যেতেন মেহেদী হাসান। মাহমুদুন্নবীর গান শুনে সংগীতের বরপুত্র মেহেদী হাসান বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যদি তোমার মতো কণ্ঠ মাঠুর্য আমাকে দিতেন তাহলে আমি বিশ্বজয় করতাম।’ এরপর করাচি বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রচারিত হয় তাঁর প্রথম গান ‘পথে যেতে দেখি আমি যারে’। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা এই গানটির মাধ্যমেই আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে উজ্জ্বল অনুপ্রবেশ শিল্পী মাহমুদুন্নবীর। করাচিতে আঁধুরী দস্তা নামের এক ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন। এর অব্যবহিত পর শিল্পীর আটটি গান নিয়ে আধুনিক গানের একটি লং প্লে রেকর্ড প্রকাশ হয়। দেশে ফিরে ১৯৬২ সালে ঢাকা রেডিওর অডিশনে পাস করেন। ১৯৬৬ সালে কাগজের নৌকা ছবিতে ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে ‘দেখে কেন মনে হয় যেন তারে চিনি’ এবং ১৯৬৭ সালে চাওয়া-পাওয়া ছবিতে আরেকটি রোমান্টিক গান ‘কিছু আগে হলে ক্ষতি কি ছিল দেখা হলোই যখন’ করেন। ষাটের দশকের শুরুতে মাহমুদুন্নবী ঢাকায় স্থায়ী হন। এ সময় থেকে ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। শিল্পের প্রতি যেমন, তেমনি সমাজের প্রতিও দায়বদ্ধ ছিলেন শিল্পী মাহমুদুন্নবী। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ছিল তাঁর সম্পৃক্ততা। এ সময় তাঁর গাওয়া গণজাগরণমূলক বেশকিছু গান মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে।

 

একজন ভারসেটাইল জিনিয়াস

মাহমুদুন্নবী ছিলেন একজন ভারসেটাইল জিনিয়াস। যদিও অধিকাংশ সংগীতবোদ্ধা তাঁকে একটা জেনুইন প্যাথেটিক ভয়েস বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রোমান্টিক, প্যাথেটিক যাই হোক না কেন মাহমুদুন্নবীর শিল্পীসত্তার মূল  বৈশিষ্ট হলো তাঁর কণ্ঠের অপরিমেয় গভীরতার সহজাত আবেগ। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় গায়িকা নির্মলা মিশ্র বলেন, ‘মাহমুদুন্নবীদা’র কণ্ঠে বিধাতা এত আবেগ দিয়েছেন! ১৯৬৮ সালে ঢাকা মেইড উর্দু ছবি ‘পায়েল’-এ মাহমুদুন্নবীর গাওয়া ‘হাওয়া ধীরে বহে না, ঘাটা ধীরে চালনা’ শ্রোতাদের বিস্ময়াভিভূত করেছিল।

 

প্রথম গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তি

মাহমুদুন্নবী ১৯৭৫ সালে ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে’ গানটির জন্য বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তিত হলে তিনি ‘দি রেইন’ ছবিতে ‘আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই’ গানটির জন্য প্রথম গায়ক হিসেবে ১৯৭৭ সালে জাতীয় পুরস্কার জিতে নেন। শিল্পীর দুর্ভাগ্য হারজিৎ ছবিতে তাঁর একটি মাস্টারপিস ‘সুরের ভুবনে আমি আজো পথচারী’ গানটিও তিনি একই বছর গেয়েছিলেন। না হলে এ গানটিরও পুরস্কার জেতার কথা ছিল। স্বরলিপি ছবিতে তাঁর একটি সিনসিয়ার পরিবেশনা ছিল ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। অসাধারণ গানের জন্য তাঁর নাম এখনো উপমহাদেশের সুপরিচিত ইমোশনাল শিল্পী জগন্ময় মিত্র, সতীনাথ মুখার্জির সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

 

স্মরণীয় রোমান্টিক যেসব গান

শিল্পী হিসেবে মাহমুদুন্নবীর বড় কৃতিত্ব ত্রিশ বছরের সংগীত জীবনে তিনি কখনো নিম্ন রুচির গান করেননি। গুটিকয়েক চটুল প্রেমের গান গেয়েছেন, তাও তাঁর একনিষ্ঠ গায়কিতে উঠে গিয়েছিল শিল্পের মাত্রায়। অনেক হৃদয়গাহী গান উপহার দিয়েছেন শিল্পী মাহমুদুন্নবী। সেসব গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘চঞ্চল এক গানের পাখি’, ‘প্রেমের নাম বাসনা’, ‘আমি যে কেবল বলেই চলি’, ‘কি আনন্দ দিয়ে এ ভুবন মাতিয়ে’, ‘ওই মধু চাঁদ আর এই জোছনা’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘এক অন্তবিহীন স্বপ্ন ছিল’, ‘নেই অভিযোগ কারো কাছে’, ‘সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম’, ‘কে আমায় আলোর ঠিকানা বলে দেবে’, ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ আমার অজান্তে’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘মন তো জানে না মন চায় কি’, ‘এ জীবন যেন এক ছন্দ’, ‘আয়নাতে ওই মুখ’, ‘ও মেয়ের নাম দেব কী’, ‘দু’চোখ আমার এ কোন আলোয়’সহ অসংখ্য গান।

 

গানপাগল অভিমানী

মাহমুদুন্নবী ছিলেন সহজ-সরল, মিষ্টভাষী এবং গানপাগল অভিমানী এক মানুষ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কেবল গানই লালন করেছেন তাঁর হৃদয়ে। এ দেশের সংগীতাঙ্গনে বিস্তৃত অবদান রাখা সত্ত্বেও মাহমুদুন্নবীর মতো শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। শিল্পীর নামে একুশে পদক ঘোষণা করেও প্রদান করা হয়নি। ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর অনেক অভিমান নিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমান মাহমুদুন্নবী।

 

মাহমুদুন্নবীর সুযোগ্য চার সন্তান

রাশিদা চৌধুরী প্রয়াত শিল্পী মাহমুদুন্নবীর সহধর্মিণী। মাহমুদুন্নবীর সুযোগ্য চার সন্তান হলেন- ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, রিদওয়ান নবী পঞ্চম ও তানজিদা নবী। এই চারজনই গানে-কথায় শিল্পী মাহমুদুন্নবীকে সর্বদা স্মরণ করেন। তারা বাবার গান সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন শো, রেডিও, টেলিভিশনে নিয়মিত গাইছেন বাবার গান। বাবাকে নিয়ে তৈরি করছেন গান।

 

ফাহমিদা-সামিনা, দুই বোনই গান করেন প্রাণের আনন্দে

বড় বোন ফাহমিদা পৌনে তিন বছরের বড় সামিনার থেকে। দুই বোনই সংগীতাঙ্গনে সমান জনপ্রিয়। দুজনে বেড়ে উঠেছেন প্রায় একসঙ্গে এবং দুজনেই মঞ্চে জনপ্রিয়। তাদের মতে, দুজনেই গান করেন প্রাণের আনন্দে। ফাহমিদা বলেন, ‘সংগীত জীবনে বাবার পথ ধরেই চলতে চাই।’ এদিকে তাদের ছোট বোন তানজিদা নবী থাকেন লন্ডনে। ভাই পঞ্চম ঢাকায় ব্যস্ত গান নিয়ে। নতুন নতুন গান তৈরি করছেন। বাবাকে নিয়ে ফাউন্ডেশন করার পরিকল্পনা তাদের অনেক দিনের স্বপ্ন।

 

বাবাকে নিয়ে সামিনার প্লান

সামিনা চৌধুরী দীর্ঘ চার মাস ঘরেই আছেন। বাসায় বসে দৈনন্দিন কাজ, ফেসবুকে স্মৃতির ডালি শেয়ার, নিজেই খোলা গলায় গান করে পোস্ট দেওয়া সব তো করছেনই। এন্ড্রু কিশোরের প্রয়াণেও ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে করেছেন স্মৃতি রোমন্থন। এদিকে বাবাকে নিয়ে সামিনা নতুন কিছু গান করছেন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবাকে নিয়ে আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে তার। করোনা নিয়ে তিনি দুই-তিনটা গান করেছেন। এছাড়াও নতুন কিছু গান তৈরি রয়েছে। এই লকডাউনে তিনি নিজের মতো করে সময় কাটাচ্ছেন। কখনো ফেসবুকে গান গেয়ে আবার কখনো বাবার স্মৃতিকে মনে করে অতীত স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন।

 

ফাহমিদার আস্থা ‘বাবা’

ফাহমিদা নবী। যার গাওয়া গানে রচিত হয়েছে জীবনের অগণিত গল্প! তাঁর সেই গানের শুরুটা কিন্তু নিজের ঘর থেকেই। জনপ্রিয় এ সংগীতশিল্পী বেড়ে উঠেছেন গানে গানে। করোনাকালীন তিনি রয়েছেন বিদেশ-বিভূঁইয়ে। তিনি চার মাস ধরে আটকা পড়েছেন লন্ডনে। দেশে ফিরতে পারছেন না। তবে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক, তাই এ মাসেই তিনি দেশে ফিরছেন। এদিকে বাবাকে নিয়ে স্মৃতির ডালি টেনে তিনি বলেন, ‘যাঁর ওপর ডানা মেলে কাজ করে যাচ্ছি, তিনি তো আমার বাবা মাহমুদুন্নবী! অনেক ঝড় যায়, ভয় পাই না। কারণ ইচ্ছা, চাওয়া এবং গভীর অভিমানের ভালোবাসাকে এক করে, কণ্ঠকে শুধু ভালো গানের জন্যই লালন করে যাচ্ছি। যার মূল্য কে দেবে, কে দেবে না-ভাবার সময় নেই! আছে শুধু ছায়ার মতো নির্ভরতার আস্থা আর সত্যের এক ভিত। মানুষকে ভালোবাসতে আর গানের মধ্যে মমতাকে ঠাঁই দিতে শিখেছি বাবার মতো। তাঁর গানের ঝুলিতে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো গানই নেই!

যা আছে সব প্রিয় তার খাতায়।’

 

মাহমুদুন্নবীপুত্র সেই পঞ্চম

রিদওয়ান নবী চৌধুরী পঞ্চম, যাকে সবাই ‘আর্কের পঞ্চম’ নামে চিনি। আশিকুজ্জামান টুলুর সঙ্গে লিড বাজিয়েছেন ব্যান্ড আর্কের প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে। গান গেয়ে অর্জন করেছেন বিপুল জনপ্রিয়তা। আর্কের বাইরে গড়ে তুলেছিলেন ব্যান্ড ‘এইজেস’ এবং সদ্য গড়ে তুলেছেন ‘মুনজ’ নামে নতুন একটি ব্যান্ড। এছাড়াও করেছেন বোন সামিনা-ফাহমিদাসহ অন্য অনেক শিল্পীর অ্যালবামের মিউজিক ডিরেক্টরের কাজ।

সর্বশেষ খবর