বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

সুনীল-নার্গিসের ভালোবাসা সঞ্জয়

সুনীল-নার্গিসের ভালোবাসা সঞ্জয়

বাঁ থেকে সুনীল দত্ত, নার্গিস ও সঞ্জয় দত্ত

বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনয় তারকা সুনীল দত্ত ও নার্গিস। এই দম্পতির সন্তান জনপ্রিয় অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত। মা-বাবার ভালোবাসার উপহার সঞ্জুর জীবন ছিল ঘটনা দুর্ঘটনায় ভরা। তার আলোচিত জীবন কাহিনির চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সুনীল-নার্গিসের প্রেম বিয়ে

নার্গিস আর সুনীল দত্ত। বলিউডের দুই জনপ্রিয় তারকাশিল্পী। আবার সুখী দম্পতি। তাদের  প্রেম-পরিণয়ের বিষয়টি  বেশ নাটকীয়তায় ভরা। নার্গিস ছিলেন  মুসলমান আর সুনীল দত্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ১৯৫৮ সালে তারা সাতপাকে বাঁধা পড়েন।

 

ভালোবাসার উপহার সঞ্জয়

সুনীল-নার্গিসের বিয়ের এক বছরের মাথায় ভালোবাসার উপহার হিসেবে তাদের ঘর আলো করে আসে পুত্র সঞ্জয় বলরাজ দত্ত। জন্ম ২৯ জুলাই ১৯৫৯ সাল।

 

বাবা মায়ের পথে

সঞ্জয় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর মা-বাবার পথ ধরেই হাঁটতে থাকেন। ১৯৮১ সালে ‘রকি’ চলচ্চিত্রে অভিষেকের পর তিনি ১৮০-এর অধিক হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। প্রায় ৩৮ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে দুটি ফিল্মফেয়ার, দুটি আইফা, দুটি বলিউড মুভি, দুটি স্ক্রিন, তিনটি স্টারডাস্ট ও একটি করে গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম ও বঙ্গ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার অভিনীত ‘রকি’, ‘সড়ক’, ‘সাজান’, ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’, ‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’ কিংবা ‘খলনায়ক’ এর মতো অসাধারণ সব ছবির কথা সারা বিশ্বের দর্শকের মনে চির জাগরুক হয়ে থাকবে। এর আগে শিশুশিল্পী হিসেবে সঞ্জয় ১৯৭২ সালের চলচ্চিত্র ‘রেশমা অউর শেরা’তে অভিনয় করেছিলেন, চলচ্চিত্রটিতে তার বাবা সুনীল দত্ত ছিলেন, সঞ্জয়কে চলচ্চিত্রটিতে কিছুক্ষণের জন্য বাচ্চা কাওয়ালি গায়ক হিসেবে দেখানো হয়।

 

বাস্তব জীবনে কেন খলনায়ক

বাস্তব জীবনে একসময় সঞ্জয় দত্ত খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও এতে তার কোনো দোষ ছিল না। অকালে মাকে হারানোর শোক সহ্য করতে না পেরে অতিমাত্রায় ড্রাগ আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। তার মা নার্গিস মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮১ সালে অকালে মারা যান, এই বছরেই সঞ্জয় অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘রকি’ মুক্তি পায়, চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার আগেই নার্গিস মারা যান। মা নার্গিসের অকাল মৃত্যুর শোক সঞ্জয়কে বাস্তব জীবনেও খলনায়ক হতে বাধ্য করে। শুরু হয় তার বেপরোয়া জীবন যাপন। একসময় মাদকাসক্তির হ্তা থেকে পুত্রের মুক্তির জন্য বাবা সুনীল তাকে যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন।

 

যে কারণে দাউদ কানেকশন

সঞ্জয় যৌবনের প্রথম দিকেই অভিনেত্রী টিনা মুনিমের প্রেমে পড়েন। সেই প্রেমে ব্যর্থ হলে আবেগপ্রবণ সঞ্জু বড়সড় ধাক্কা খান। অপরদিকে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরুতেই ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন মা নার্গিস। একদিকে ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা, অন্যদিকে মায়ের মৃত্যুশোক- সবমিলিয়ে ভেঙে পড়েন সঞ্জয়। যন্ত্রণা ভুলতে ডুবে যান নেশার অতল অন্ধকারে। নেশায় বুঁদ ছেলের সঙ্গে সে সময় বেশ দূরত্ব তৈরি হয় বাবা সুনীলের। সঞ্জয় জড়িয়ে পড়েন অপরাধজগতে। মুম্বাই মাফিয়া জগতের সবচেয়ে বড় ত্রাস দাউদ ইব্রাহিম সঞ্জয়ের সে সময়টাকেই কাজে লাগান। সঞ্জয় ১৯৯১ সালে একটি সিনেমার শুটিংয়ে দুবাই যান। দাউদ ইব্রাহিমের ছোট ভাই আনিস সিনেমাটির সেট পরিদর্শনে আসেন। সে সময় আনিস বড় ভাই দাউদের নির্দেশে সঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করেন। সেই থেকেই সঞ্জয়ের সঙ্গে দাউদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৯২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সঞ্জয়কে অপরাধ জগতের আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। ১৯৯৩ সালের মুম্বাই সিরিজ বোমা হামলায় সঞ্জয়ের মদদ ছিল বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে। আর এসবের পেছনে দাউদ ইব্রাহিমের হাত ছিল বলে জানা যায়। সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ওই সময় দাউদের ভাই আনিসের কাছ থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন। আদালতে প্রমাণিত হয়, সঞ্জয় আনিস ইব্রাহিমের সাহায্যে ৩টি স্বয়ংক্রিয় একে-৪৭ রাইফেল ও ২০টির অধিক হ্যান্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করেছিলেন। তবে তার বিপক্ষে আনা অন্য অভিযোগ, এসব অস্ত্র দাঙ্গায় ব্যবহার করা হয়েছে- এমন কোনো প্রমাণ গোয়েন্দা সংস্থা দিতে পারেনি। বাবা সুনীল দত্ত যখন জানতে পারেন ছেলেকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে, তখন তিনি সে সময়ের পুলিশ কমিশনারকে জানিয়ে দেন সঞ্জয় মরিশাস থেকে সেই রাতেই ফিরছেন। পুলিশের জেরার মুখে সবকিছু স্বীকার করেন সঞ্জয়। তেহেলেকা ম্যাগাজিনের করা তদন্তে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি এসেছে তা হলো ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ভারতের মুম্বাই রাজ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে সুনীল দত্ত সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এতে উগ্রপন্থি হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সুনীল দত্তকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করার চেষ্টাও করে তারা। মুসলিমপ্রিয় স্বভাবের কারণে সে সময় সুনীল দত্ত রাজনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। উগ্র হিন্দুবাদীদের টার্গেটে পরিণত হওয়া দত্ত পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিও পড়ে যাচ্ছিল হুমকির মুখে। এ অবস্থায় সঞ্জয় মনে করেছিলেন, হয়তো তার বাবা শেষ পর্যন্ত পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন না। আর এ কারণেই নাকি, অবৈধ পথে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহে অগ্রসর হন। পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেলেও সহিংস ওই ঘটনায় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্র বাড়িতে রাখার দায়ে করা মামলায় ২০১৩ সালের ২১ মার্চ সঞ্জয়কে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৬ সালে সাজা শেষে মুক্তি পান সঞ্জয়।

 

জেলে ফাইল বানাতেন

মুম্বাইয়ের ইয়েরাওয়ারা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১৬৬৫৬ নম্বরের কয়েদি ছিলেন সঞ্জয়। সেখানে কাগজের ফাইল বানানো আর বাঁধাইয়ের কাজ করেছেন তিনি। ওই কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি দিনে ২৫ থেকে ৪০ রুপি পেতেন।

 

যেভাবে মাদকাসক্ত

সঞ্জয়ের মা তখন চিকিৎসাধীন। সে সময়েই সঞ্জয় কুসঙ্গে জড়ান। মায়ের মৃত্যুর পর তার মাদকাসক্তি আরও বেড়ে যায়। যা উপার্জন করতেন সবই খরচ হয়ে যেত মাদকে। এমনকি, নিজের জুতোর ভিতরে রেখে নাকি পাচার করতেন মাদক।  কথিত আছে ৬ বছরের সঞ্জয় দত্তকে সিগারেটের নেশা ধরিয়েছিলেন খোদ বাবা সুনীল দত্ত। ঘটনাটি যখন ঘটেছিল, তখন সঞ্জয় দত্তের বয়স মাত্র ৬ বছর। কাশ্মীরে সুনীলের একটি ছবির শুটিং চলছে। ছোট্ট সঞ্জয়ও বাবার সঙ্গে উপস্থিত ছিল লোকেশনে। সেখানে সঞ্জয় দেখেন, সবাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে ধূমপান করছে। তার বাবাও। আর তা দেখতে দেখতেই হঠাৎ বায়না জুড়ে দেয় ছেলে- তারও একটা সিগারেট চাই। প্রথমে সবাই হেসে উঠেছিলেন শুনে। কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত আর হাসির রইল না। কেন না, ততক্ষণে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে সিগারেট সে খাবেই। বেগতিক দেখে এগিয়ে আসেন সুনীল। এক কোণে নিয়ে যান ছেলেকে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে দেখান, কীভাবে ধোঁয়া টেনে তা নাক দিয়ে ছাড়তে হয়। বাবা ভেবেছিলেন, সে কাশবে, স্বাদ বাজে লাগবে, নাকে-মুখে ধোঁয়া ঢুকে গিয়ে নাকাল হবে এবং পরিণামে আর সিগারেট খেতে চাইবে না। কিন্তু ওসব কিছুই হয়নি। বরং বাবা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, খুব সঠিকভাবে গোটা সিগারেটটা সে শেষ করে ফেলেছে।

 

বিবাহিত জীবনেও ঝড়ো হাওয়া

ঝড়ো হাওয়া সঞ্জয়ের একাধিক প্রেম-বিয়ে লন্ডভন্ড করে দেয়। ১৯৮০ তে অভিনেত্রী টিনা মুনিমের সঙ্গে প্রেমে জড়ান। তাদের আট বছরের প্রেমের সম্পর্ক এক সময় বিষাদে ভরে ওঠে। টিনার সঙ্গে সম্পর্কের সমাপ্তির পর ১৯৮৭ সালে অভিনেত্রী ঋচা শর্মাকে বিয়ে করেন। ১৯৮৮ সালে তাদের কন্যা ত্রিশলা জন্মগ্রহণ করে। ঋচা ১৯৯৬ সালে মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৯৯৮ সালে বিমানবালা-মডেল রিয়া পিল্লাইকে বিয়ে করেন সঞ্জয়। ২০০৫ সালে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং ২০০৮ সালে বিবাহবিচ্ছেদে রূপ নেয়। সঞ্জয় ২০০৮ সালে গোয়াতে গোপন এক অনুষ্ঠানে মান্যতা দত্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের আগে তারা দুই বছর প্রেম করেছিলেন। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর সঞ্জয় আর মান্যতা যমজ ছেলেমেয়ের পিতামাতা হন।

 

সঞ্জয়কে নিয়ে বায়োপিক ‘সঞ্জু’

বলিউডের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজ কুমার হিরানি সঞ্জয়ের জীবনের গল্প নিয়ে বায়োপিক নির্মাণ করেন। ‘সঞ্জু’ বায়োপিকটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ২৮ জুন। ওই বায়োপিকে সঞ্জয়ের চরিত্রে দেখা যায় রণবীর কাপুরকে। বায়োপিক থেকে সঞ্জয়ের জীবনের আরও কিছু অজানা তথ্য সবার সামনে আসে। মান্যতার চরিত্রে দিয়া মির্জা অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি ব্যবসা সফল হয় এবং ৫৬০ কোটি টাকা আয় করেন।

 

মাকে এখনো মিস করেন

মাকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা সঞ্জয়ের স্ট্যাটাস দেখলে এখনো বোঝা যায় মাকে কতটা মিস করেন সঞ্জু। লিখলেন, প্রতি দিন তিনি মাকে কতটা মিস করেন। প্রায় সময়ই মায়ের সঙ্গে নিজের একটি সাদা-কালো ছবি পোস্ট করে জীবনের ধূসর অংশের কথা শেয়ার করে এই অভিনেতা লিখেন, ‘৩৯ বছর হয়ে গেল তুমি নেই। কিন্তু আমি জানি তুমি সব সময় আমার পাশে আছ। খালি মনে হয় আজকে এবং প্রতিদিন যদি তুমি থাকতে। ভালোবাসি, মিস করি তোমাকে মা। সঞ্জয় দত্ত খুব বেশিদিন পাননি মাকে। মায়ের প্রয়াণের পর থেকে বাবা সুনীল দত্তের ভূমিকা প্রবল হয়ে দেখা দেয় সঞ্জয়ের জীবনে। স্বল্প দিন হলেও মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে থাকা শৈশব আজও সঞ্জয় দত্তের চোখের সামনে। রাজকুমার হিরানির তৈরি সঞ্জয় দত্তের বায়োপিকেও দেখা গেছে মা নার্গিসের সঙ্গে কতটা গভীর সম্পর্ক ছিল ছেলের। তার জীবনে দাগ  কেটেছিল মায়ের মৃত্যু কম বয়সে মাকে হারানোটা সঞ্জয়ের কাছে ছিল মর্মান্তিক। সুনীল দত্ত মারা যান ২০০৫ সালে।

সর্বশেষ খবর