বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় থিয়েটার অঙ্গনের বেহাল অবস্থা

করোনায় থিয়েটার অঙ্গনের বেহাল অবস্থা

প্রাঙ্গণেমোর থিয়েটার ভ্যান নিয়ে অনন্ত হীরা, মামুনুর রশীদসহ কজন থিয়েটারকর্মী

সবকিছুর মতো করোনাবন্দী দেশের থিয়েটার অঙ্গন। মহড়া বন্ধ; মঞ্চে নেই মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর ব্যস্ততা। জীবন থমকে গেছে। ফলে ঘরেই সময় কাটছে থিয়েটার কর্মীদের। তবে বেশ কিছু দল অনলাইনে চালাচ্ছে থিয়েটার কার্যক্রম। আবার কোনো দল সংকটে পড়ে বিকল্প ভাবনা নিয়ে নেমে এসেছে রাস্তায়। সবমিলিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে বিকল্প চিন্তা করছেন সবাই। করোনাকালীন থিয়েটারের সংকট নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

প্রায় চার মাস হয়ে গেছে! অন্যান্য অঙ্গনের মতো এই দীর্ঘসময় স্থবির থিয়েটার জগৎ। সরাসরি ব্যস্ততা নেই থিয়েটার সম্পর্কিত মানুষের। তবে কিছু দল থেমে নেই। অনেকেই থিয়েটার কার্যক্রম চালাচ্ছেন অনলাইন প্ল্যাটফরমে। অনলাইনে নিয়মিত নিচ্ছেন ওয়ার্কশপ; হচ্ছে কিছু মঞ্চনাটকের মহড়া ও শেষে প্রদর্শনী। তবে বরাবরের মতোই এই সংকটময় সময় থিয়েটার অঙ্গনের মানুষের পাশে তেমন করে নেই রাষ্ট্র, কোনো পৃষ্ঠপোষক। তাই জীবিকার তাগিদে অনেকেই নিচ্ছেন বিকল্প ব্যবস্থা। কেউ অনলাইনে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার সেবা চালু করেছেন, আবার কেউ ছোট ছোট পরিকল্পনা নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। যদিও এটাকে তারা বলছেন রাষ্ট্র, পৃষ্ঠপোষক বা সমাজের প্রতি তাদের প্রতীকী প্রতিবাদ।

সম্প্রতি মহড়াকক্ষের খরচ জোগাতে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি শুরু করেছেন নাট্য সংগঠন প্রাঙ্গণেমোরের নাট্যকর্মীরা। ‘শ্রমে সততায় সৃজনে বাঁচি’ স্লোগানে শুরু করেছে ‘প্রাঙ্গণেমোর থিয়েটার ভ্যান’। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পাঁচটি ভ্যান নামিয়েছেন তারা। আর প্রথম ক্রেতা হয়ে এই ভ্যানের উদ্বোধনও করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। সে সময় উপস্থিত ছিলেন প্রাঙ্গণেমোরের দলপ্রধান অনন্ত হীরা, নাট্যশিল্পী নূনা আফরোজসহ আরও কজন থিয়েটারকর্মী। এই উদ্যোগ সম্পর্কে অনন্ত হীরা বলেন, “চার মাস হয় আমাদের থিয়েটার বন্ধ। মঞ্চের পর্দা খুলতে পারছি না। আমাদের দলের অফিস, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত নাটকের মহড়া করি, সেখানে গত চার মাস আমরা যেতে পারছি না। কিন্তু ভাড়া দিয়ে যাচ্ছি প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা করে। গত চার মাসে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই অবস্থায় প্রাঙ্গণেমোর কার্যালয়টি হারানোর আশঙ্কা করছেন কর্মীরা। অর্থসংকটে পড়ে দলটির অনেক সদস্য রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। এদিকে মহড়াকক্ষে থাকা ১৪টি চলমান প্রযোজনার সেট, প্রপস, প্রিন্টিং, কম্পিউটার, ব্যানারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে রয়েছে প্রতিটি সদস্যের শ্রম, ঘাম আর আবেগের সম্পর্ক। তাই মহড়াকক্ষটি ধরে রাখতে এবং কর্মহীন হয়ে পড়া সহকর্মীদের সাময়িক অর্থসংকট মেটাতে চালু হয়েছে ‘প্রাঙ্গণেমোর থিয়েটার ভ্যান’।” এই উদ্যোগ সম্পর্কে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘সংকটকালে থিয়েটারকর্মীদের সহায়তায় যখন কেউ এগিয়ে আসছে না তখন এটা তো একটি প্রতিবাদও। এই দুর্যোগকালে সরকার কোথায়? রাষ্ট্র কার স্বার্থে কাজ করছে? এই দুর্যোগকালে থিয়েটারকর্মী, সংস্কৃতিসেবীরা কেমন আছেন, এ নিয়ে তো কারও কোনো উদ্বেগ লক্ষ্য করছি না। থিয়েটারের মানুষ যে কীভাবে বেঁচে আছেন, তা কেউ জানেন না।’ তবে এই বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এ প্রসঙ্গে নূনা আফরোজ বলেন, ‘এ উদ্যোগ কেউ কেউ অন্যভাবে দেখছেন। কিন্তু এটা শুধু সবজি বিক্রি করা নয়, প্রতীকী প্রতিবাদও বটে।’ দেশনাটকের দলপ্রধান মাসুম রেজা বলেন, ‘ইনকাম জেনারেট করার জন্য প্রাঙ্গণেমোরসহ অনেকেই উদ্যোগী হয়েছে। এটিকে ইতিবাচক মনে করি। করোনা দুর্দিন হলেও আমরা দেশনাটকের সবাই প্রস্তুতিতে আছি। আমি থিয়েটার সম্পর্কিত বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার বা টকশোতে আছি। অনলাইনে নতুন নাটক ‘পেন্ডুলাম’র মহড়া করছি;  নাটকও নামবে। আমি নতুন নাটক লিখছি দেশনাটকের জন্য। আসলে থেমে তো নেই কেউ।’ তারুণ্যদীপ্ত নাট্যদল বাতিঘরের দলপ্রধান মুক্তনীল বলেন, ‘শুধু করোনাকালীন সময়ই নয়; থিয়েটারে সংকট সবসময়ই ছিল। তবে আমি কিছু থিয়েটারের এমন উদ্যোগকে একদিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি। আবার অন্যদিকে এটিকে দেখি থিয়েটার শিল্পের দৈন্যতা হিসেবে। এটার মাধ্যমে থিয়েটার শিল্পের অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। তবে, আমি প্রাঙ্গণেমোরের এই বিষয়টিকে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে দেখছি। আর আমি মনে করি, থিয়েটারের মানুষ অনেক সচেতন ও দায়িত্বশীল। এই সংকটময় সময় তারা আরও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে বলে আমার বিশ্বাস।’ নাট্যজন লাকী ইনাম বলেন, ‘থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে, সব যে বন্ধ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। থিয়েটার যারা করেন, তারা কেউ কেউ কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে আগে থেকেই জড়িত। এই সময় তাদের ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোনো থিয়েটারই কর্মীকে ফিন্যানশিয়ালি হেল্প তেমন করে করতে পারে না। উন্নত দেশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে থিয়েটার চর্চার চেষ্টা করছে, যা এদেশে সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, এই সময় দলগুলোর কর্মকা- সরাসরি নেই; তবে অনলাইন প্লাটফরমে তারা কিন্তু বিভিন্নভাবে সক্রিয়। আমি নিজেকে সজীব রেখেছি, মাসে চারটি ক্লাস নিই অনলাইনে। আমি ও ইনাম কিছু নাটক অনুবাদ করছি। এরকম অনেক দল ও থিয়েটারকর্মী আছে, যারা সক্রিয় বিভিন্নভাবে। আসলে জীবন তো চালাতেই হবে, তবে সেটা যেন হয় সুন্দরভাবে। নান্দনিকতা বজায় রেখে। হতাশ হওয়া যাবে না; কাজ করে যেতে হবে।’    

প্রাঙ্গণেমোরের মতো অনলাইনে ইতিমধ্যে অনেক থিয়েটার দল ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সক্রিয়। তারা শিল্পকর্ম বিক্রি, অনলাইন সেবা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করছেন। নতুন থিয়েটার ‘ফ্রাইডে থিয়েটার’ অনলাইনে খুলেছে ফ্রাইডে শপ। তারা অনলাইনে বিক্রি করছে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। পাশাপাশি থিয়েটার চর্চাকে সক্রিয় রাখারও চেষ্টা করছে তারা। এদিকে এই করোনাময় সময় লকডাউনের প্রথম থেকেই বিভিন্ন নাটকের দল অনলাইন প্রিমিয়ার, স্বল্প পরিসরে পথনাটকের চিন্তা, অনলাইনে থিয়েটার নিয়ে সেমিনার, অনলাইনে থিয়েটার কর্মশালাসহ নানা আয়োজন করে চলেছেন। অনলাইনে মহড়া করা থেকে শুরু করে সেটি প্রদর্শনীর উদ্যোগও নিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থিয়েটার ও দেশনাটকের যৌথ উদ্যোগে আসছে ‘পেন্ডুলাম’ নামক নাটক।

মাসুম রেজার রচনায় ‘পেন্ডুলাম’ নামে নাটকটির নির্দেশনা দিচ্ছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। মাত্র এক বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নতুন নাটকের দল ‘অনুস্বার’ ২৫ তারিখে মোহাম্মদ বারীর নির্দেশনায় আর্থার মিলারের ‘দ্য প্রাইস’ নাটকটি এবং ‘মূল্য ও অমূল্য’ নাটকটি প্রদর্শন করবে। অন্যদিকে শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটার আনছে আরেকটি নাটক আনন জামানের রচনায় ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’। নাটকের দল প্রাচ্যনাট, বাতিঘর, বটতলা নিয়মিতই লাইভশো, কর্মশালাসহ বিভিন্ন আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। বড় দলের পাশাপাশি নতুন কিছু দলও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রয়েছে সক্রিয়। করোনাকালীন প্রস্তুতি নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মঞ্চে নামাবেন নতুন নাটক।

সর্বশেষ খবর