বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ভালো নেই চলচ্চিত্রপাড়া

আলাউদ্দীন মাজিদ

ভালো নেই চলচ্চিত্রপাড়া

ভালো নেই চলচ্চিত্রপাড়া। চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা চরম দুর্ভোগে আছেন। চলতি বছরের ১৮ মার্চ থেকে করোনা মহামারীর কারণে সরকার সিনেমা হল বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে এফডিসিতে নেই চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ। চলচ্চিত্রপাড়া খ্যাত কাকরাইলের চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অফিসগুলো এখন জনশূন্য। ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ ‘রাজমণি’ ও ‘অভিসার’। দেশে এখন সিনেমা হলের সংখ্যা ৬০-এর ঘরে। ঈদের আগে চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা সিনেমা হল খুলে দেওয়ার জন্য তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে আপাতত সিনেমা হল না খোলার পক্ষে মত দেন তিনি। অন্যদিকে গত মাসে প্রদর্শক সমিতির পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সিনেমা হল খুলে দেওয়ার জন্য একটি লিখিত আবেদন জানানো হলেও এখন পর্যন্ত তাতে কোনো সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কবলে পড়েছে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প। এ বিষয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও নির্মাতা মতিন রহমানের বক্তব্য হলোÑ ‘সব সুরক্ষা মেনেও যদি সিনেমা হল খুলে দেওয়া হয় তাতে যে অচিরেই আশার আলো দেখা দেবে তা কিন্তু নয়। কারণ আমাদের দেশের সিনেমা হলের ভিতরের যে কাঠামো তাতে শারীরিক দূরত্ব মানা মুশকিল। তা ছাড়া সিনেমা হল একটি বদ্ধ ঘর। সেখানে এসি চলবে। এতে যদি একজন করোনা পজিটিভ দর্শকও থাকে তাহলে তার থেকে ভাইরাস সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হলো দর্শক তখনই বিনোদন নিতে যাবে যখন তার মন শঙ্কামুক্ত এবং প্রফুল্ল থাকবে। তাই করোনার ভয়ে দর্শক সিনেমা হলে যাবে বলে আমার মনে হয় না। আরেকটি বিষয় হলো অনেকে করোনায় চাকরি হারানোর কারণে নিজ বাড়িতে চলে গেছেন। অনেকে মারা গেছেন। এ অবস্থা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই। বিদেশে একটি রিপোর্টে চরম আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছেÑ ‘সিনেমা শিল্প বুঝি আর বাঁচল না।’ বিকল্প অবস্থায় ইউটিউবসহ আধুনিক প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তি দিলে তাতে সেন্সরসহ নানা অভাবে সেই ছবির মৌলিকত্ব হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। এতে সর্বজনীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে সিনেমা। হলিউডে ইতিমধ্যে দেড় লাখ সিনেমা এক্সপার্ট চাকরি হারিয়েছেন। এ অবস্থা থেকে আমাদের দেশও রেহাই পায়নি। ইতিমধ্যে যেসব প্রযোজক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ফেলেছেন বা প্রায় নির্মাণ কাজ শেষ করে এনেছিলেন তারা আজ সেই ছবি মুক্তি বা নির্মাণ শেষ করতে না  পেরে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকে ঋণ করে ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে এখন দুর্দশায় পড়েছেন। পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী, সিনেমা হল মালিক ও হলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন মহাদুর্ভোগে। এভাবে চলতে থাকলে আসলেই সিনেমা শিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য।

চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, করোনার কারণে বন্ধ থাকা সবই সীমিত পরিসরে খুলে গেছে। বন্ধ ছিল শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পর্যটন কেন্দ্র ও সিনেমা হল। এই ঈদে পর্যটন কেন্দ্রও খুলেছে। করোনার কারণে মার্চ মাসে সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রযোজকরা। প্রথমত, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যেসব ছবি মুক্তি পেয়েছিল সেগুলোর প্রদর্শনী বজায় রাখতে না পারায় প্রযোজক ও প্রদর্শকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত, যেসব নির্মাতা ছবির কাজ শেষ করে ফেলেছেন তারা সেই ছবি আর মুক্তি দিতে পারছেন না বলে আর্থিক লোকসানে পড়েছেন। তৃতীয়ত, যারা নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি তারাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন। চতুর্থত, যেসব প্রযোজক ঈদ বা অন্য উৎসবকে কেন্দ্র করে বিগ বাজেটের ছবি নির্মাণ করেছেন তারা সবচেয়ে বেশি করুণ অবস্থায় রয়েছেন। কারণ তারা ব্যাংক লোনও পরিশোধ করতে পারছেন না। তাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। সিনেমা শিল্পকে এই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে সিনেমা হল খুলে দিতে হবে। এ অবস্থায় আসনে বসার ক্ষেত্রে একটি আসনের সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে মোট চারটি আসন খালি রাখতে হবে। আর চার আসনের ভর্তুকি সরকারকে দিতে হবে। এই প্রস্তাবে রাজি না হলে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, যেসব ছবি মুক্তির জন্য প্রস্তুত রয়েছে সেগুলো যেন সরকার কিনে নেয় এবং যে কোনো সময় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সরকার যদি নিশ্চুপ থাকে তা হলে এই শিল্পটি আর থাকবে না। চরম মানবেতর জীবনে পড়া এই শিল্পের সঙ্গে যুক্তরা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার চরম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সবকিছুই স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে গেলেও সিনেমা হল খুলছে না। এতে পরিচালকরা কাজের অভাবে মানবেতর জীবনের মুখে পড়েছেন। ইতিমধ্যে অনেক ছবির নির্মাণ কাজ শেষ। অনেক ছবির নির্মাণ করোনার কারণে মাঝপথে এসে থেমে গেছে। এসব ছবি মুক্তি বা এর নির্মাণ শেষ করতে না পারলে প্রযোজকরা তো নতুন ছবি নির্মাণে অবশ্যই এগিয়ে আসবেন না। তা হলে পরিচালকরা কাজ পাবেন কীভাবে? তা ছাড়া এসব ছবি বেশি দিন পড়ে থাকলে ছবিগুলোর মেরিট নষ্ট হয়ে যাবে এবং দর্শক তা দেখবে না। এ অবস্থায় সরকার যদি স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ মানার শর্তে সিনেমা হল খুলে দেয় তাহলে এই দুরবস্থার অবসান ঘটতে পারে। কারণ করোনার কারণে তো আর হাউসফুল দর্শক হবে না। সিনেমা হলের বেশির ভাগ আসন প্রতি শোতে অবশ্যই খালি থাকবে।  দৈনিক চার শোতে সীমিত আকারে আগত দর্শক দিয়ে অবশ্যই সিনেমা হল চালানো যায়। আমার মতে এভাবে এখনই সিনেমা হল খুলে দিলে চলচ্চিত্র জগতে গতি আসবে। চলচ্চিত্র গবেষক ও নির্মাতা মতিন রহমান আক্ষেপ করে বলেন, চলচ্চিত্র শিল্প এমন স্থবির অবস্থায় পতিত হওয়ায় চলচ্চিত্রের মানুষদের মধ্যে চরম হতাশা দানা বেঁধে উঠেছে। ফলে এই জগতে দেখা দিয়েছে নানা অস্থিরতা।

প্রায় পাঁচ মাস ধরে এফডিসিতে শুটিং নেই। চলচ্চিত্র ব্যবসার প্রধান তিন মৌসুম দুই ঈদ ও বাংলা নববর্ষে ছবি মুক্তি পায়নি। ফলে হতাশাগ্রস্ত চলচ্চিত্রের মানুষগুলো অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ আর কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হয়েছে খোদ এফডিসিতে বসে। সিনেমার স্বার্থবিরোধী কর্মকা- ও অনিয়মের অভিযোগে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বয়কট করেছে চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চলচ্চিত্রকার বলছেন, যদিও নিয়ম অনুযায়ী এক সমিতি অন্য সমিতির পদত্যাগ কখনই দাবি করতে পারে না। তারপরও ১৮টি সংগঠন মিশা-জায়েদের পদত্যাগ দাবি করছে। এ ছাড়াও এফডিসির সামনে মানববন্ধন করেন গত নির্বাচনে ভোটাধিকার হারানো ১৮৪ জন শিল্পী। তবে এ মানববন্ধনে দেখা যায় অনেক অচেনা মুখ। আবার ১৮টি সংগঠনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। যেখানে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন মিশা-জায়েদ। চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠনের দাবি, তারা শিল্পী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বয়কট করেনি, করেছে ব্যক্তি মিশা-জায়েদ খানকে। একদিকে করোনা মহামারী অন্যদিকে দেশের তিন ভাগের এক ভাগ অঞ্চল বন্যাকবলিত, ফলে অচিরেই সিনেমা হল খোলা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ। সিনেমার কোনো কাজ নেই। আর এই হতাশার মধ্যে চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, চলচ্চিত্র না থাকলেও চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগার এফডিসি উত্তপ্ত রয়েছে হতাশাগ্রস্ত চলচ্চিত্রের মানুষের উত্তেজনায়। অন্যদিকে করোনার কারণে কর্মশূন্য থাকা সত্ত্বেও এফডিসির বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভাঙার কাজ চলছে এখানে আবাসিক হোটেল, শপিং মল আর সুইমিং পুল নির্মাণের উদ্দেশ্যে। যা মেনে নিতে পারছেন না সচেতন চলচ্চিত্রকাররা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর