শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

যেমন হতে পারে করোনা-পরবর্তী বিনোদন বিশ্ব

যেমন হতে পারে করোনা-পরবর্তী বিনোদন বিশ্ব

করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ও সতর্কতায় স্থবির হয়ে পড়েছে বিনোদনের দুনিয়া। হলিউড, বলিউডের পাশাপাশি ঢালিউডে পড়তে শুরু করেছে এর প্রভাব। তবে কি বিনোদন দুনিয়া স্থবির হয়ে পড়বে।  ঘরবন্দী জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে এখন ক্ষণে ক্ষণে সবার চোখ যাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। সবাই চায়, করোনাবিষয়ক তথ্য পেতে। এর পাশাপাশি নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তো আছেই। তবে তরুণ দর্শকের আগ্রহ ওয়েবভিত্তিক প্ল্যাটফরমের প্রতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তারা সংবাদ পাচ্ছেন আর বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে সিরিজ ও সিনেমা দেখে সময় পার করছেন। বিশেষ করে বঙ্গ বিডি, বায়োস্কোপ, আইফ্লিক্স, নেটফ্লিক্স, হইচই ইত্যাদির প্রতি সবার আগ্রহ তুলনামূলক বেশি। এখন প্রায় টিভি চ্যানেলেরই রয়েছে নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলের নাম।

  আলী আফতাব

 

ইউটিউব হবে দর্শকদের প্রধান আকর্ষণ

পরিসংখ্যানটা এলেন ডিজেনেরেসের টিভি শো থেকেই দিই। এ অনুষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দর্শকরা দেখতে পান এনবিসি ইউনিভার্সাল নামের চ্যানেলে। যুক্তরাজ্যে এটি দেখা যায় আইটিভি টুতে। তিন দেশ মিলে প্রতিদিন এ অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলে দেখেন ৩৬ লাখ দর্শক, যেখানে ইউটিউবে প্রতিদিন এ অনুষ্ঠানের একেকটি ভিডিওর গড় দর্শক সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। শুধু ‘ইউটিউব’ নামের এ ভিডিও প্ল্যাটফরমটির জন্য এখন এলেনের মতো বেশির ভাগ পশ্চিমা টিভি অনুষ্ঠান সঞ্চালকদের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। জিমি কিমিল, জিমি ফ্যালন, কোলবার্ট, জেমস কর্ডন সবাই এখন টিভি অনুষ্ঠান সঞ্চালনার পাশাপাশি ইউটিউবের আয় থেকে পাচ্ছেন আলাদা লভ্যাংশ। মার্কিন মুলুকের মতো ভারতেও একই অবস্থা। হোক সেটা কপিল শর্মার কমেডি শো কিংবা করণ জোহরের ‘কফি উইথ করণের’ ছোট ছোট ক্লিপ, সেটারই এখন টিভি চ্যানেলের চেয়ে ইউটিউবে কদর বেশি। ভারতীয়রা একধাপ এগিয়ে। তাদের টিভি চ্যানেলগুলো ‘নিউ মিডিয়া’র সঙ্গে পাল্লা দিতে একেকটা নেটওয়ার্ক খুলে বসেছে একেকটা নতুন ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সাইট। যেমন স্টার প্লাস চালু করেছে ‘হটস্টার’, জি নেটওয়ার্কের আছে ‘জি ফাইভ’। বাংলাদেশেও ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলো ধীরে ধীরে ডালপালা মেলছে। মৌলিক কনটেন্ট দিয়ে বায়োস্কোপ, হইচই, র‌্যাবিটহোল বিডি, আইফ্লিক্স, বঙ্গবিডি টেক্কা দিচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোকে। এভাবেই ২১ শতকের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে চ্যানেলগুলো। টিভি চ্যানেল থেকে হয়ে যাচ্ছে ইউটিউব চ্যানেল কিংবা স্মার্টফোনে থাকা ছোট্ট একটা অ্যাপ।

 

বাংলাদেশে বদলের হাওয়া

বৈশ্বিক বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিন দিন শক্তি বাড়ছে ‘নিউ মিডিয়া’র। শুরুতেই যেমনটা বললাম, আগে খবরে জানা যেত, কোন টিভি চ্যানেলে দেখা যাবে কোন নাটক। এখন খবর আসে কোন ইউটিউব চ্যানেলে উঠছে কোন নতুন নাটক, কোন গান। নতুন ধারার তোড়ে টিভি চ্যানেলগুলো বিকল্প মাধ্যমে রূপ নিচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো টেলিভিশনের চেয়ে এখন ইউটিউব নিয়ে বেশি মনোযোগী।

 

দেশি টিভি অনুষ্ঠানের দর্শক এখন বৈশ্বিক

ফাগুন অডিও ভিশনের জনপ্রিয়তম ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। এ অনুষ্ঠান ইউটিউবে পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। শুধু পুরো অনুষ্ঠান নয়, ফাগুন অডিও ভিশনের ইউটিউব চ্যানেল থেকে এ অনুষ্ঠানের ছোট ছোট অংশ দর্শক এরই মধ্যে দেখেছেন কয়েক লাখ কোটিবার। ইউটিউবে শুধুই ইত্যাদির জনপ্রিয়তার তোড়ে ফাগুন অডিও ভিশনের চ্যানেলটির সাবসক্রাইবারের সংখ্যা এখন ১৫ কোটির বেশি। একসময় যে দর্শকরা মাসের পঞ্চম শুক্রবারে রাত ৮টার বাংলা সংবাদ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতেন, ২১ শতকে এসে এখন আর অপেক্ষা নয়। মনমতো সময়ে প্রিয় অনুষ্ঠান হাতের কাছে থাকা পর্দায় দেখে নিচ্ছেন দর্শক। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত গানের অনুষ্ঠান ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’-এর কথাও বলি। গানের এ অনুষ্ঠানটি দেখানো হয় গানবাংলা চ্যানেলে। কিন্তু এ টিভির সম্প্রচার তো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। অনুষ্ঠানের একেকটা গান ইউটিউবের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শ্রোতাদের মধ্যে।

 

নতুন পথে রিয়েলিটি শো

শুধু টিভি চ্যানেলের নামে ইউটিউব চ্যানেল নয়। অনুষ্ঠানের নাম ধরেও তৈরি হচ্ছে আলাদা ইউটিউব চ্যানেল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শাহরিয়ার নাজিম জয়ের টকশোর কথা। তাছাড়া সাম্প্রতিক টিভি রিয়েলিটি শোগুলোও নিজেদের মূল মাধ্যম হিসেবে ধরছে ইউটিউব চ্যানেলকে। টিভি চ্যানেলে এর প্রচার হয়ে উঠেছে ‘অপশনাল’। কিছু দিন আগের সংগীতভিত্তিক রিয়েলিটি শো ‘সানসিল্ক ডিভাস’ কিংবা ‘কে হবে মাসুদ রানা?’-এর কথা ধরা যাক। দুটোই প্রচারিত হয়েছে আলাদা চ্যানেলে, কিন্তু আলোচনা হয়েছে ইউটিউবে পর্বগুলো ওঠার পরই।

 

বিনোদনের ধারাবদল

বিনোদন ব্যবসার ধরন পুরোপুরি বদলে দিয়েছে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং। আগে মানুষের বাসাবাড়ির বিনোদন ছিল মূলত টেলিভিশনকেন্দ্রিক। ভিসিপি-ভিসিআরের যুগেও টিভি নিজের গুরুত্ব ধরে রেখেছিল। ভিসিডি-ডিভিডিও ছিল টিভিনির্ভর। এ ধারণা ভেঙে দিতে ২০০৭ সালে নেটফ্লিক্স প্রথম নিয়ে আসে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগে ভিডিও সাবস্ক্রিপশন। স্মার্টফোন মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ার পর ধরন বদলে সরাসরি অনলাইন ভিডিও স্ট্রিম শুরু করে নেটফ্লিক্স। প্রযুক্তিনির্ভর এ নতুন ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় ও ডলারপ্রসবিনী হয়েছে যে ডিজনি-অ্যাপল-আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এতে নজর দিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে শুধু স্ট্রিমিং ব্যবসায় বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নগদ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এ ভিডিও স্ট্রিমিংকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে কনটেন্ট নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানামাত্রিক অধিগ্রহণে খরচ হয়েছে কমপক্ষে ৬৫০ বিলিয়ন ডলার।

 

বাড়ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেমন ফেসবুকের একাধিপত্য রয়েছে, তেমনি এতদিন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসাতেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছে নেটফ্লিক্স। বিশ্বজুড়ে ১৬০ মিলিয়নের বেশি গ্রাহক নেটফ্লিক্সের। কিন্তু এবার এতে ভাগ বসাতে এসে গেছে অনেকে। ডিজনি ও অ্যাপলের কথা তো আগেই হলো। আছে অ্যালফাবেটের ইউটিউব। আমাজনের ভিডিও স্ট্রিমিংসেবা হিসেবে আছে ‘আমাজন প্রাইম’। এ ছাড়া আরও ছোট কিছু প্রতিষ্ঠানও স্ট্রিমিং ব্যবসার অংশীদার হয়েছে। তবে ফেসবুক যেমন পুরো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বাজার একাই দখল করে আছে, স্ট্রিমিং জগৎ ঠিক তেমনটা নয়। বাজার অংশীদারিত্বের দিক থেকে স্ট্রিমিং ব্যবসায় কোনো প্রতিষ্ঠানই মোট বাজারের ২০ শতাংশের বেশি দখল করতে পারেনি। ফলে সবারই সুযোগ আছে অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার। বিশ্বে স্ট্রিমিংসেবার গ্রাহক ৭০০ মিলিয়নের বেশি।

 

আসছে আরও...

এখানেই শেষ নয়। সামনেই আসছে আরও দুটি স্ট্রিমিংসেবা। ওয়ার্নার মিডিয়ার মালিক প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা ‘এইচবিও ম্যাক্স’ নিয়ে আসবে। এর মাধ্যমে অনলাইনে এইচবিওর সব কনটেন্ট দেখতে পারবেন গ্রাহকরা। মাসে ১৪ দশমিক ৯৯ ডলারের (১ হাজার ২৬৬ টাকা) বিনিময়ে যেমন দেখা যাবে গেম অব থ্রোনস, তেমনি পাওয়া যাবে নতুন নতুন সিরিজও। আগামী বছর এনবিসি ইউনিভার্সাল আনবে ‘পিকক’। এ স্ট্রিমিং সাইট অন্যদের তুলনায় প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কেবল সংযোগ নিয়েছেন, এমন গ্রাহকরা এ স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। সাধারণত নেটফ্লিক্সসহ অন্যান্য স্ট্রিমিংসেবায় বিজ্ঞাপনের অত্যাচার সহ্য করতে হয় না। কিন্তু ওই অত্যাচার সহ্য করতে পারলে ‘পিকক’ নাকি ফ্রিতে মিলবে! অন্তত এখন পর্যন্ত এ আশ্বাসই দেওয়া হচ্ছে।

 

ভবিষ্যৎ

ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝিতে স্ট্রিমিংযুদ্ধ মারাত্মক আকার নেবে। তবে ডিজনি-এইচবিও-অ্যাপলের চাপে নেটফ্লিক্সের চিঁড়েচ্যাপ্টা হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম। কারণ, স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট হিসেবে একমাত্র নেটফ্লিক্সই বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। আবার নেটফ্লিক্সে কনটেন্টের সংখ্যাও ঢের বেশি। ৪৭ হাজার টিভি এপিসোড ও ৪ হাজার ছবি দিয়ে গ্রাহকদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে নেটফ্লিক্স। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই। একুশ শতকে এসে পুরনো ধারায় অনুষ্ঠান প্রচার করলে তা আর ধোপে টিকবে না এটা বুঝে গেছেন প্রযোজক ও অনুষ্ঠান নির্মাতারা। তাই দেশি-বিদেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো নতুন সময়ের নতুন ধারার সঙ্গে তাল মেলানো শুরু করে দিয়েছে। কারণ নানান সংস্থার, নানান পরিসংখ্যান বলছে, টিভি সূচি ধরে বিনোদন নেওয়ার দিন ফুরাতে চলেছে। মানুষ এখন ঝুঁঁকছে পকেট বিনোদনের দিকে।  তাই অনেকেই মনে করছেন করোনা-পরবর্তীতে বিনোদন বিশ্ব টিভি থেকে ইউটিউব আর ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলোর দিকে ঝুঁঁকবে।

 

সর্বশেষ খবর