রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় সংকটে নাট্যাঙ্গন

করোনায় সংকটে নাট্যাঙ্গন

নিত্যপুরাণ

সংকটে দেশের মঞ্চনাট্যাঙ্গন। কারণ করোনাভাইরাস। এ দুঃসময়ে মঞ্চকে ঘিরে নেই কোনো আয়োজন। সবাই করোনাবন্দী। ঘরে বসেই সময় কাটছে থিয়েটারসংশ্লিষ্ট সবার। অনলাইনে কিছু থিয়েটার চর্চা চললেও সবাই টিকে থাকতে করছেন বিকল্প চিন্তা। এ সময়ে থিয়েটার চর্চার বিভিন্ন সংকট নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ মঞ্চ নাট্যচর্চা। বন্ধ শিল্পকলা একাডেমিসহ মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর স্থানগুলো। চার মাস তো হয়েই গেছে! তবে কিছু কিছু দল কিন্তু করোনা আতঙ্কে থেমে নেই। তারা অনলাইন প্ল্যাটফরমে থিয়েটার কার্যক্রম চালাচ্ছে। নিয়মিত নিচ্ছেন ওয়ার্কশপ; হচ্ছে কিছু মঞ্চ নাটকের মহড়া ও প্রদর্শনী। ঘরে বসে অনলাইনেই হচ্ছে পান্ডুলিপি পাঠ, মহড়া, থিয়েটার প্রশিক্ষণ। তবে করোনার এ সময়ে কিংবা করোনা-পরবর্তীকালে কতটা বদলে যাবে থিয়েটার চর্চা, তা নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে বরাবরের মতোই এ সংকটকালীন  থিয়েটার অঙ্গনের মানুষের পাশে তেমন করে নেই রাষ্ট্র বা পৃষ্ঠপোষক। তাই জীবিকার তাগিদে অনেকেই নিচ্ছেন বিকল্প ব্যবস্থা। কেউ অনলাইনে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার সেবা চালু করেছেন, আবার কেউ ছোট ছোট পরিকল্পনা নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন। তবে এটা কতদিন সম্ভব হবে তা নিয়ে থিয়েটারসংশ্লিষ্ট সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আর এ বিকল্প ব্যবস্থাকে তারা বলছেন রাষ্ট্র, পৃষ্ঠপোষক বা সমাজের প্রতি তাদের প্রতীকী প্রতিবাদ। সম্প্রতি মহড়া কক্ষের খরচ জোগাতে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতে দেখা যায় নাট্য সংগঠন প্রাঙ্গণেমোরের নাট্যকর্মীদের। ‘শ্রমে সততায় সৃজনে বাঁচি’ স্লোগানে শুরু করেছে ‘প্রাঙ্গণেমোর থিয়েটার ভ্যান’। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পাঁচটি ভ্যান নামিয়ে তারা টিকে থাকার এ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রথম ক্রেতা হয়ে এ ভ্যানের উদ্বোধনও করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। সে সময় উপস্থিত ছিলেন প্রাঙ্গণেমোরের দলপ্রধান অনন্ত হিরা, নাট্যশিল্পী নূনা আফরোজসহ আরও কিছু থিয়েটার কর্মী। উদ্যোগ সম্পর্কে অনন্ত হিরা বলেন, ‘চার মাস হয় আমাদের থিয়েটার বন্ধ। মঞ্চের পর্দা খুলতে পারছি না। আমাদের দলের অফিস, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত নাটকের মহড়া করি, সেখানে গত চার মাস আমরা যেতে পারছি না। কিন্তু ভাড়া দিয়ে যাচ্ছি প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা করে। গত চার মাসে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ অবস্থায় প্রাঙ্গণেমোর কার্যালয়টি হারানোর আশঙ্কা করছেন কর্মীরা। অর্থ সংকটে পড়ে দলটির অনেক সদস্য রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। এদিকে মহড়াকক্ষে থাকা ১৪টি চলমান প্রযোজনার সেট, প্রপস, প্রিন্টিং, কম্পিউটার, ব্যানারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে রয়েছে প্রতিটি সদস্যের শ্রম, ঘাম আর আবেগের সম্পর্ক। তাই মহড়াকক্ষটি ধরে রাখতে এবং কর্মহীন হয়ে পড়া সহকর্মীদের সাময়িক অর্থসংকট মেটাতে চালু হয়েছে ‘প্রাঙ্গণেমোর থিয়েটার ভ্যান’। এ উদ্যোগ সম্পর্কে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এই সংকটকালে থিয়েটার কর্মীদের সহায়তায় যখন কেউ এগিয়ে আসছে না তখন এটা তো একটি প্রতিবাদও। এ দুর্যোগকালে সরকার কোথায়? রাষ্ট্র কার স্বার্থে কাজ করছে? এ দুর্যোগকালে থিয়েটার কর্মী, সংস্কৃতিসেবীরা কেমন আছে, এ নিয়ে তো কারও কোনো উদ্বেগ লক্ষ্য করছি না। থিয়েটারের মানুষ যে কীভাবে বেঁচে আছে তা কেউ জানে না।’ তবে এ বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এ প্রসঙ্গে নূনা আফরোজ বলেন, ‘এ উদ্যোগ কেউ কেউ অন্যভাবে দেখছেন। কিন্তু এটা শুধু সবজি বিক্রি করা নয়, প্রতীকী প্রতিবাদও বটে।’ এদিকে দেশনাটকের দলপ্রধান মাসুম রেজা দিলেন ভিন্ন বার্তা। তিনি এটিকে ইতিবাচক নিয়ে বলেন, ‘ইনকাম জেনারেট করার জন্য প্রাঙ্গণেমোরসহ অনেকেই উদ্যোগী হয়েছে। এটা কিন্তু ইতিবাচক। দুর্দিন হলেও আমরা প্রস্তুতিতে আছি। থিয়েটার সম্পর্কিত বিভিন্ন ওয়ার্কশপে, সেমিনার বা টকশোতে আছি। অনলাইনে নতুন নাটক ‘পেন্ডুলাম’র মহড়া করেছি; নাটকও নামছে। আমি নতুন নাটক লিখছি। থেমে তো নেই কেউ।’ বাতিঘর দলপ্রধান মুক্তনীল এ সংকটকালীন থিয়েটার চর্চাকে অন্যভাবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘শুধু করোনাকালীন  নয়; থিয়েটারে সংকট সবসময়ই ছিল। তবে আমি কিছু কিছু থিয়েটারের এমন উদ্যোগকে একদিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি। এটা অবশ্যই একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। আবার এটিকে দেখি থিয়েটার শিল্পের দৈন্যতা হিসেবে। এটার মাধ্যমে থিয়েটার শিল্পের অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মনে করি, থিয়েটারের মানুষেরা অনেক সচেতন ও দায়িত্বশীল। তারা এ সংকটময় সময়ে আরও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।’ নাট্যজন লাকী ইনাম বলেন, ‘থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে এজন্য সব যে বন্ধ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। থিয়েটার যারা করেন, তারা কেউ কেউ কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে আগে থেকেই জড়িত। এ সময়ে তাদের ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোনো থিয়েটারই কর্মীকে ফিন্যান্সিয়ালি হেল্প তেমন করে করতে পারে না। উন্নত দেশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে থিয়েটার চর্চার চেষ্টা করছে, যা এদেশে সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, এ সময়ে দলগুলোর কর্মকা- সরাসরি নেই; তবে অনলাইন প্ল্যাটফরমে তারা কিন্তু বিভিন্নভাবে সক্রিয়। আমি নিজেকে সজীব রেখেছি, মাসে চারটি ক্লাসর নিই অনলাইনে। আমি ও ইনাম কিছু নাটক অনুবাদ করছি। এরকম অনেক দল ও থিয়েটার কর্মী আছে, যারা সক্রিয় বিভিন্নভাবে। আসলে জীবন তো চালাতেই হবে, তবে সেটা যেন হয় সুন্দরভাবে। নান্দনিকতা বজায় রেখে। হতাশ হওয়া যাবে না; কাজ করে যেতে হবে।’ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘মার্চ মাস থেকেই সব জায়গায় দলগুলোকে আমরা শো বন্ধ করতে বলেছি। তবে আগামী দিনে কীভাবে আমরা কাজ করব, তা এখনো চিন্তা করতে পারছি না। তবে নাট্যকর্মীদের কিংবা দলগুলোকে সাহায্য করা হচ্ছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে। কারণ, অনেক দলেরই সেট-প্রপস নষ্ট হয়ে গেছে।’

তবে, করোনার এ সময়ে থিয়েটার চর্চায় এসেছে পরিবর্তন। বিশেষ করে অনলাইন মহড়া ও ক্লাসের কথা বলা যায়। কিংবা করোনা-পরবর্তীকালে থিয়েটার চর্চার ধরন। নাট্যজন ও নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে এটা এক ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘করোনার পরে বেশ কিছুদিন মঞ্চে কিংবা সিনেমা হলে লোক আসবে না। কম আসবে। থিয়েটার এখনো দেখেন মধ্যবিত্ত। তারা কিছুটা ভীত, আবার বেশি সচেতন। তাহলে একটা বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে থিয়েটার কর্মীদের জন্য দর্শক নিয়ে। তবে সময়ের ব্যবহার অনলাইনে ভালো করা যায়। যানজট, অর্থনৈতিক সংকট যে তৈরি হয়, একজন থিয়েটার কর্মীর সেটা কিন্তু এখানে নেই। আমি জানি না আগামী দিনে কী হবে? তবে আমাদের কর্মীরা কিন্তু নতুন করে ভাবতে পারে। অনলাইন পারফরম্যান্স বলে একটা জায়গা হয় কিনা। তা ছাড়া ফ্লোরে নামার আগ পর্যন্ত অনলাইনেই মহড়া হতে পারে। নতুন রিহার্সেল স্পেস বেরিয়ে গেল একটা।’

অনলাইনে ইতিমধ্যে অনেক থিয়েটার দল ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে আছে শিল্পকর্ম বিক্রি, নিত্যপ্রয়োজনীয় টাটকা জিনিসের ব্যবসা ইত্যাদি। পাশাপাশি থিয়েটারচর্চাকে সক্রিয় রাখারও চেষ্টা করছেন অনেকে। বিভিন্ন নাটকের অনলাইন প্রিমিয়ার, স্বল্প পরিসরে পথনাটকের চিন্তা, অনলাইনে থিয়েটার নিয়ে সেমিনার, অনলাইনে থিয়েটার কর্মশালাসহ নানা আয়োজন করে যাচ্ছেন থিয়েটারকর্মীরা। শুধু তাই নয়, অনলাইনে মহড়াও করছে নানা নাট্যদল। নাটকের দল প্রাচ্যনাট, বাতিঘর, বটতলাসহ অনেকেই নিয়মিত থিয়েটার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। করছে নানা আয়োজন। করোনার এ দুঃসময়ে সুখবর দিয়েছে ঢাকা থিয়েটার ও দেশ নাটক।  তিন দশক পর মঞ্চে ফিরবে অভিনেতা আফজাল হোসেন। মাসুম রেজার রচনায় ‘পেন্ডুলাম’ নামের নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। নাটকের দল অনুস্বার এনেছে মোহাম্মদ বারীর নির্দেশনায় আর্থার মিলারের ‘দ্য প্রাইস’ নাটকটি ‘মূল্য ও অমূল্য’ নামে।

শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটার আনছে আরেকটি নাটক আনন জামানের রচনায় ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর