সোমবার, ১০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

এক সুরের জাদুকরের প্রস্থান

আলী আফতাব

এক সুরের জাদুকরের প্রস্থান

একসময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে একটি কথা প্রচলিত ছিল। সেটি হলো-‘আপনি আলাউদ্দিন আলীর সুরে গান করেননি, তো কিছুই করেননি। আপনার সংগীতজীবনই ব্যর্থ।’ সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে বহু শ্রোতাপ্রিয় গানের জন্মদাতা। তিনি শুধু একজন সংগীত পরিচালকই নন, একাধারে সুরকার, বেহালাবাদক, গীতিকার। গতকাল বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে আমাদের ছেড়ে তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। গুণী এই মানুষটির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানার বাঁশবাড়ি গ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে। বাবা ওস্তাদ জাদব আলী। মা জোহরা খাতুন। মাত্র দেড় বছর বয়সে ঢাকার মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে চলে আসেন। তিন ভাই, দুই বোনের সঙ্গে কলোনিতেই বড় হতে থাকেন তিনি। সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে।

শহীদ আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে তিনি যন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে আসেন ১৯৬৮ সালে। এরপর তিনি প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজসহ বিভিন্ন সুরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে সংগীত পরিচালনা করে বেশ প্রশংসিত হন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’ ও ‘যোগাযোগ’ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৮৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে। লোকজ ও ধ্রুপদী গানের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা তার সুরের নিজস্ব ধারা বাংলা গানকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় চার দশক বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের বহু স্বনামধন্য শিল্পী তার সুরে গান করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন। এ পর্যন্ত তার ঝুলিতে জমা হয়েছে ৮টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৮৭ সালের ২৬ জুলাই একই দিনে তার সুর-সংগীতে ৩০টি গানের রেকর্ডিং হয়। মুম্বাই, কলকাতা ও ঢাকায় একই দিনে গানগুলোর রেকর্ডিং হয়। এমন উদাহরণ বিশ্বের খুব বেশি সংগীত পরিচালকের ক্যারিয়ারে নেই।

তার সুর করা গানের মধ্যে রয়েছে ‘ও আমার বাংলা মা তোর’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর’, ‘আছেন আমার মোক্তার’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে’, ‘এমনও তো প্রেম হয়’, ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘দুঃখ ভালোবেসে  প্রেমের খেলা খেলতে হয়’, ‘বাবা বলে গেল আর কোনোদিন’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’, ‘শেষ করো না শুরুতে খেলা’, ‘ইস্টিশনের রেলগাড়িটা’-এ রকম প্রায় ৪ হাজার সফল গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী।

রুনা লায়লা

আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় আনোয়ার পারভেজ পরিচালিত ‘দি রেইন’ ছবির একটি গানের মধ্য দিয়ে। এই ছবির একটি জনপ্রিয় গান ‘আয়রে মেষ আয়রে’ গানটি আমি গেয়েছিলাম। এরপর অনেক চলচ্চিত্রে তার সুর করা গানে আমি কণ্ঠ দিয়েছি। তার মতো গুণী মানুষের চলে যাওয়া আমাদের একটি অধ্যায়ের অবসান।

সৈয়দ আবদুল হাদী

‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’ এই গানটি ১৯৭৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত বাংলাদেশি চলচ্চিত্র গোলাপী এখন ট্রেনে ব্যবহার করা হয়। গাজী মাজহারুল আনোয়ার এই গানের গীতিকার আর সুর করেছিলেন আলাউদ্দিন আলী। গানটি চলচ্চিত্রের প্রথম ২০ মিনিটের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। চলচ্চিত্রে এই গানের চিত্রায়ণে ঠোঁট মিলিয়েছেন প্রখ্যাত অভিনয় শিল্পী আনোয়ার হোসেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে আমাকে আর  পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এমন সুরের মানুষ আমাদের মধ্যে আর কবে আসবে জানা নেই। আজ আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

সাবিনা ইয়াসমিন

কী বলব, আমাদের ছেড়ে একের পর এই গুণী মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন। আর ভালো লাগছে না। আলাউদ্দিন আলীর মতো একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালক আর আসবেন না। তিনি ছিলেন পাক ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার। তার অসংখ্য গানে আমি কণ্ঠ দিয়েছি। তবে একটি বিষয় হচ্ছে আলাউদ্দিন আলী এই রোগের কারণে অনেক দিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিলেন। আল্লাহ তার বেহেশত নসিব করুন।

কুমার বিশ্বজিৎ

আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘ইন্সপেক্টর’ ছবিতে আমি প্রথম গান করি। এখানে আমার সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী আলমগীর। এই ছবির গানটি আমার জন্য একটি পরীক্ষা ছিল। আলাউদ্দিন আলী ভাই বলেছিলেন এই গানটি যদি আমি ভালো করে গাইতে পারি তবেই তার সুর করা আরও গান গাইতে পারব। গানটি রেকর্ডের পর আলাউদ্দিন আলী ভাইয়ের অনেক পছন্দ হয়। এরপর টানা প্রায় ৩০০ ছবিতে আমি তার সুর করা  গানে কণ্ঠ দিয়েছি। তার সর্বশেষ একটি গান আমার এখনো করা হয়নি। ইচ্ছা ছিল তিনি সুস্থ হলে গানটি তাকে দিয়ে করাব।

 

তপন চৌধুরী

আলাউদ্দিন আলী আমাদের দেশের সুরস্রষ্টাদের মধ্যে অন্যতম। আমার সংগীত জীবনের পথচলায় তার অবদান অনেক বেশি। ‘ভাত দে’ সিনেমায় তার সুর ও সংগীতে আমি প্রথম গান করি। আমার ও মিতালী মুখার্জির অনেক জনপ্রিয় গানের সুরস্রষ্টা তিনি। আলাউদ্দিন আলী ভাইয়ের কাছে আমি অনেক ঋণী। এই গুণী মানুষটির আত্মার শান্তি কামনা করছি। আলাউদ্দিন আলীর চলে যাওয়া মানে বাংলাদেশের একজন জিনিয়াস, ট্যালেন্টের চলে যাওয়া। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।

সর্বশেষ খবর