বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

যার সুরে মাতোয়ারা বিশ্ব

যার সুরে মাতোয়ারা বিশ্ব

এ আর রহমান

চরম দরিদ্রতা এ আর রহমানকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছে। সেই যুদ্ধে একদিন বিশ্বজুড়ে বিজয়ী হয়ে ওঠলেন তিনি। বিস্ময়কর এ আর রহমানের কম্পোজিশনে পশ্চিমা সুর তো আছেই, সেই সঙ্গে জাপানি পেন্টাটনিক সুর উঁকি দেয়। পাঞ্জাবি সুফি পপ থেকে শুরু করে তার কম্পোজিশনে বাংলার বাউল সুরের প্রয়োগে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। সব মিলিয়ে এ আর রহমানের অতলান্ত সাংগীতিক বিস্ময়ের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

শৈশবে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ 

সুরের জাদুকর এ আর রহমান মাদ্রাজের এক শৈব হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় বছরের ছেলে এ এস দিলীপ কুমারকে তার স্কুলের শিক্ষিকা বাড়ি চলে যেতে বললেন। কিছু না বুঝেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলেন। এসে দেখলেন বাবা আর নেই। শুরু হলো অভাবের সঙ্গে দিলীপের যুদ্ধ। ঘরে ছোট ভাইবোন, আর অসহায় মা  কস্তূরী। সঞ্চয়ের প্রায় সবই শেষ অসুস্থ বাবার চিকিৎসায়। বাবা আর কে শেখর মালয়ালাম ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে সুরকার ছিলেন। তার সঙ্গে কি-বোর্ড বাজাতেন ছোট্ট দিলীপ। চার বছর বয়সেই তিনি পিয়ানো বাজানো শিখে গিয়েছিলেন।

 

পড়াশোনা ছেড়ে সংগীত জগতে

মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন বাবা আর কে শেখর। একদিকে সংসার, অন্যদিকে পড়াশোনা, দুই নৌকায় পা রেখে চলা সম্ভব হলো না। পড়াশোনায় ইতি টানলেন কিশোর দিলীপ। একসময় ড্রাইভার হওয়ারও চিন্তাভাবনা করেন। দক্ষিণ ভারতের  সেরা কম্পোজার ইলাইয়ারাজা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে রহমানকে তার কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ  দেন।

 

হতে চেয়েছিলেন ড্রাইভার

সে সময় ইলাইয়ারাজার টিমের লিড কি-বোর্ড প্লেয়ার ভিজি ম্যানুয়াল তাকে জিঙ্গেলে  ক্যারিয়ার আরম্ভ করার পরামর্শ দেন। তখন তিনি বিষয়টি সিরিয়াসলি নেন এবং ভেবে রাখেন যে, এ লাইনে সফল না হলে ড্রাইভিং শিখবেন এবং একজন ড্রাইভার হিসেবে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেবেন। ১১ বছর বয়স থেকে শুরু করে তিনি দীর্ঘদিন তালিম নেন প্রখ্যাত শিল্পী মাস্টার ধনরাজের কাছে। তার কাছে তালিম নিয়ে নিজস্ব গানের দলও করেছিলেন দিলীপ।

 

কেন মুসলিম হলেন

সংগীত জগতে পা রাখলেও অভাব-অনটন সংসারের পিছু ছাড়ল না। সমস্যা সুরাহার খোঁজে দিলীপের ধর্মপ্রাণ মা বিভিন্ন ধর্মস্থানে ছুটতেন। তাদের পরিবারে সব ধর্মের প্রতি সম্মান ও উদারতা বজায় ছিল। জীবনের এমনই এক কঠিন সময়ে  পূর্ব পরিচিত এক সুফিসাধক তাদের পাশে দাঁড়ান। এই সুফিসাধকের প্রভাবে সমস্যা জর্জরিত পরিবারটি শান্তি খুঁজে পায়। ১৯৮৬ সালে, কস্তূরী তার সন্তানদের নিয়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তার নতুন নাম হয় করিমা। তবে ধর্মান্তরিত হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণও জানা যায়। ১৯৮৪ সালে রহমানের ছোট বোন এ আর রেহানা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে তার মা আজমির শরিফে মানত করেন। ১৯৮৮ সালে আল্লাহর রহমতে একজন মুসলিম পীরের সাহায্যে তার অসুস্থ বোন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে উঠলে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আসে এবং সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় তার নাম রাখা হয় আল্লাহ রাখা রহমান বা সংক্ষেপে এ আর রহমান।

 

শুরুতে মিউজিক কম্পোজার

একসময় ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ডকুমেন্টারির জন্য মিউজিক কম্পোজ করতেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঝুঁকে পড়েন বিজ্ঞাপনের দিকে। বছরপাঁচেকের মধ্যে তিনি ৩০০টিরও বেশি জিঙ্গেল কম্পোজ করেন। তার সুর করা জিঙ্গেলগুলোর মধ্যে কয়েকটি বেশ বিখ্যাত ছিল,  যেমন টাইটান ওয়াচের জিঙ্গেল। এখানে তিনি  মোৎসার্টের ২৫ নম্বর সিম্ফনি ব্যবহার করেন। সাম্প্রতিক সময়ও রহমানের কম্পোজ করা এয়ারটেলের জিঙ্গেলটি দারুণ জনপ্রিয়।

১৯৮৯ সালে ‘পাঞ্চাখান রেকর্ড ইন’ নামের ছোট একটি স্টুডিওর মাধ্যমে নিজস্ব সংগীত জগতের সূচনা করেন তিনি। পরবর্তীতে এটি ভারতের অন্যতম  সেরা সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিও হিসেবে নাম করে।

 

যেভাবে প্লে-ব্যাকে

চলচ্চিত্রের গানে এ আর রহমানের আত্মপ্রকাশ বোম্বে (তামিল, ১৯৯৫) ছবিতে। এর আগে তিনি অনেক গানে কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম কোনো গানে পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা পালন করেন বোম্বে সিনেমার হাম্মা হাম্মা গানটিতে। মুভি বোম্বের (১৯৯৫) তু হি রে... গানটি এবং বোম্বে থিম মিউজিক ট্র্যাক তার অনন্য দুটি সৃষ্টি। তার সেরা অধিকাংশ ট্র্যাক বা মুভিই প্রথমে তামিল ভাষায় করা, যা পরে হিন্দিতে ডাব করা হয়েছে। সেই ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তিনি তামিল,  তেলেগু, হিন্দি, মালয়ালাম, মারাঠি, কানাড়া, ম্যান্ডারিন ও ইংরেজি ভাষায় উপহার দিয়েছেন দুই শতাধিকেরও (ডাবিং ও জিঙ্গেলসহ) বেশি অ্যালবাম।

 

সফলতার শুরু

১৯৮৭ সালে রহমান আলৌইন শীর্ষক একটি জিঙ্গেল কম্পোজের সুযোগ পান যা অনেক বেশি মানুষের কাছে পরিচিতি পেতে সহায়তা করে। তখনই তিনি পরিচালক মণি রতœমের নজরে আসেন। রতœম তার তামিল ‘রোজা’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার সুযোগ দেন রহমানকে। এরপর  পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এ আর রহমানকে। রোজা নির্মাণের সময়ই চিত্রনাট্যকার সন্তোষ শিবান মালয়ালাম চলচ্চিত্র ‘যোধা’তে এ আর রহমানকে চুক্তিবদ্ধ করেন। এটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পরই জীবনের মোড় ঘুরে যায় এ আর রহমানের। ‘রোজা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জয় করেন ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার। এরপর ১৯৯২ সালে তিনি নিজ বাড়িতেই ‘পাঞ্চাখান রেকর্ড ইন’ নামে একটি রেকর্ড ও মিক্সিং স্টুডিও চালু করেন। স্টুডিওটি এত দ্রুত পরিচিতি পাবে তা এ আর রহমানও ভাবেননি। ভারতের গন্ডি ছাড়িয়ে এশিয়ার অন্যতম একটি রেকর্ডিং স্টুডিও হিসেবে এটি পরিচিতি পায়। ২০০৬ সালে তার রেকর্ডিং স্টুডিওর নাম বদলে রাখেন এ এম স্টুডিও।

 

এলো মাহেন্দ্রক্ষণ- ‘ডাবল অস্কার’

গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক এ আর রহমানকে অনেকেই ভালোবেসে মোজার্ট অব মাদ্রাজ নামে ডাকেন। তার জীবনের অন্যতম অর্জন আসে ২০০৯ সালে। ওই বছর ৮১তম অস্কার আসরে ড্যানি বয়েলের আলোচিত সিনেমা ‘স্লামডগ মিলিনিয়র’র মিউজিক কম্পোজার হিসেবে সেরা অরিজিনাল মিউজিক স্কোর ও সেরা অরিজিনাল সং ‘জয়  হো’র জন্য ডাবল অস্কার জেতেন। এ আর রহমানের সংগীত কৌশল বলিউডকে দিয়েছে নতুন ধরনের সাংগীতিক অভিজ্ঞতা। তারই স্বীকৃতিতে মণি রতœমের ‘রোজা’ সিনেমার দুটি গান জিতেছিল দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। জিতেছেন একটি বাফটা, গোল্ডেন গ্লোব, চারটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও ফিল্মফেয়ারসহ অসংখ্য পুরস্কার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সেরা ১০ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায় তার নাম স্থান পায়। ২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় উপাধি ‘পদ্মভূষণ’ অর্জন করেন। সম্প্রতি ব্রিটেনভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন তাকে ‘টুমরোস মিউজিক আইকন’ উপাধি দিয়েছে।

 

অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর

১৯৯৭ সালের ১৫ আগস্ট তার কণ্ঠে প্রথম অ্যালবাম  বের হয় ‘বন্দে মাতরম’ শিরোনামে সনি মিউজিক  কোম্পানির পক্ষ থেকে। বন্দে মাতরম মাইলস্টোন অ্যালবামটি শুধু ইন্ডিয়ায় তখন বিক্রি হয়েছিল ১.২  কোটি পিস। ১৯৯৯ সালে জার্মানির মিউনিখে কনসার্টে মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে পারফরম করেছেন তিনি। ২০০২-এ বিশ্ববিখ্যাত কম্পোজার অ্যান্ডরু লয়েড ওয়েবারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রিলিজ দেন তার প্রথম স্টেজ প্রোডাকশন বোম্বে ড্রিমস। ২০০৭ সালে তাজমহলকে দ্য নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্সে স্থান পাইয়ে দেওয়ার জন্য ওয়ান লাভ গানটি ৬টি ভাষায় রিলিজ দেন।

 

আন্তর্জাতিক আইকন

সংগীত পরিচালক কিংবা সুরকার হয়েও যে রীতিমতো প্রথম সারির তারকা হওয়া যায়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা যায়, তার প্রমাণ এ আর রহমান। ভারতের চলচ্চিত্র জগতে তিনি তারকাদের তারকা। ৮১তম অস্কারের মিউজিক ক্যাটাগরিতে ডাবল অস্কার বিজয়ী ভারতীয় এই মিউজিশিয়ান প্রথমে কি-বোর্ড প্লেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিশ্বসংগীতে অবদান রাখার জন্য ২০০৬ সালে ‘স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের’ পক্ষ থেকে রহমানকে একটি সম্মানসূচক অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। তাছাড়া মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, আন্না বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। দুইবারের অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে হোয়াইট হাউসে ডিনারের দাওয়াতও  পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে তার নামে মার্কহাম, ওন্টারিও, কানাডায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়।

 

মানবপ্রেমী

এ আর রহমান মানবপ্রেমী আখ্যায়ও ভূষিত হয়েছেন। বেশকিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত রহমান ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্টপ টিবি’ কার্যক্রমের বৈশ্বিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়াও ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এবং ‘ইন্ডিয়ান ওসেন’ নামক ভারতভিত্তিক বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

 

অজানা যত তথ্য

কানাডার মারখামের একটি রাস্তার নামকরণ ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস  থেকে করা হয়েছে তার নামে। এ আর রহমানের জন্মদিন আর তার ছেলে আমিনের জন্মদিন একই দিনে। শুধু ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ নয়, এ আর রহমান সুর করেছেন হলিউডের জনপ্রিয় মুভি ‘১২৭ আওয়ারস’ এবং ‘লর্ড অব ওয়ার’-এ। ২০০০ সালে এ আর রহমানেরই জিঙ্গেলে একটি ফরাসি বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল জিনেদিন জিদানকেও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর