শিরোনাম
রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

লকডাউনে আটকে পড়া ছবির ভবিষ্যৎ কী

আলাউদ্দীন মাজিদ

লকডাউনে আটকে পড়া ছবির ভবিষ্যৎ কী

‘সিনেমা হল এখনই খুলে দিলে যে দর্শক ছবি দেখতে আসবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ আমরা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কতটা করতে পারব সেই প্রশ্ন রয়েই যায়।’ চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুন এ কথা জানিয়ে আরও বলেন, সরকারের কাছে আমরা সিনেমা হল খুলে দেওয়ার যত দাবিই জানাই না কেন তাতে লাভ নেই। কারণ করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার ব্যবস্থা কতটা বা কীভাবে করা যাবে তার দায়িত্ব কে নেবে। সেই ব্যবস্থা করতে হলে সিনেমা হল মালিক আর নির্মাতারা বিচ্ছিন্নভাবে সরকারের কাছে দাবি না জানিয়ে সমষ্টিগতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সিনেমা নির্মাণ ও মুক্তির বিকল্প চিন্তা করতে হবে। কী সেই বিকল্প চিন্তা? এমন প্রশ্নে অনন্য মামুন বলেন, এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ প্রায় পাঁচ মাস ধরে সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে। কবে খুলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘদিন ধরে যদি সিনেমা হল বন্ধ থাকে তাহলে নির্মাতারা ছবি নির্মাণ কীভাবে করবেন। তাই সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এই মুহূর্তে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তির আর কোনো বিকল্প নেই। অনন্য মামুন জানান, তার ‘মেকআপ’ ছবিটি দীর্ঘদিন আগে নির্মাণ হয়ে করোনার কারণে আটকে আছে। তার অন্য ছবি ‘সাইকো’র চার দিনের কাজ বাকি আছে। কখন, কীভাবে এই কাজ শুরু করব জানি না। আর শুরু করতে যাওয়া নতুন ছবি ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমা হলের জন্য নির্মাণের কথা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রযোজক হতাশ। কারণ সিনেমা হল খুলতে কত সময় লাগবে তা অজানা। তাই আগামীকাল সোমবার তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন এটি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের জন্য নির্মাণ করবেন কিনা? এদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে শুটিং শুরু হওয়া দীপংকর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবিটির কাজও করোনার কারণে আটকা পড়েছে। এই ছবির চার দিনের শুটিং বাকি আছে। গত মার্চে  মোংলায় এই শুটিং হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার লকডাউনে তা আর সম্ভব হয়নি। এখন আগামী অক্টোবরে এই শুটিং করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান নির্মাতা। প্রখ্যাত নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’ নির্মাণ করে বসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। করোনার কারণে তিনিও ছবিটি নিয়ে আটকা পড়েছেন। তার কথায়, এটি আরটিভির প্রযোজিত ছবি। তারা ছবিটি কীভাবে মুক্তি দেবেন তা আমি জানি না। অনেকে এখন অনলাইন প্ল্যাটফরমের দিকে এগোচ্ছেন। আমার কথা হলো, বড় পর্দার জন্য নির্মিত ছবি অনলাইনে মুক্তি দিয়ে সেই ফ্লেভার দর্শক পাবেন না। তাই আমি এই ছবিটি অনলাইনে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে নই। আমার প্রত্যাশা, আরটিভিও আমার সঙ্গে সহমত হবে। বলিউডে কিছু ছবি বর্তমানে অনলাইনে মুক্তি দিলেও বড় মাপের ছবিগুলো কিন্তু ঠিকই বড় পর্দার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস নতুন দিনের চাকা আবার ঘুরবে। করোনাকাল অতিক্রম করে আমরা আবার সিনেমা হলে ছবি মুক্তির সোনালি দিন ফিরে পাব। জাজ মাল্টিমিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে ‘জ্বীন’ ছবির নির্মাণ শেষ করে মুক্তির প্রতীক্ষায় আছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির কর্মকর্তা আলিমুল্লাহ খোকন বলেন, এভাবে আর কত অপেক্ষা করা যায়। কারণ এর সঙ্গে অর্থ যুক্ত আছে। কিছু ডিজিটাল প্ল্যাটফরম গত ঈদে ছবিটি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু যে বাজেটে ছবিটি নির্মাণ হয়েছে তারা তার চেয়ে কম মূল্য প্রস্তাব করায় ছবিটি দিইনি। ওয়েব প্ল্যাটফরমগুলো যেন সঠিক মূল্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দেয় সে জন্য তাদের সঙ্গে চলতি সপ্তাহে বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারণ নির্মিত ছবিগুলো মুক্তির ব্যবস্থা করতে না পারলে নির্মাতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ও নতুন করে কোনো নির্মাতা আর ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসবেন না। এতে চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

করোনার কারণে গত মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে গেছে ছবি নির্মাণ, মুক্তি ও সিনেমা হল। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন নির্মাতা ও সিনেমা হল মালিকরা। এদিকে বেশ কিছু সিনেমা হলের মালিক ঈদে সিনেমা হল খুলে দেওয়ার দাবি জানালেও তথ্য মন্ত্রণালয় এ মুহূর্তে সিনেমা খুলে দেওয়ার বিপক্ষে। ঈদের আগে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক  বৈঠকে খোদ তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এখনো সিনেমা হল খোলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। প্রদর্শক সমিতি বলছে শপিং মল, পোশাক শিল্প-কারখানা ও ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যদি খুলে দেওয়া যায় তাহলে সিনেমা হল কেন নয়? সম্প্রতি সিনেপ্লেক্সের পক্ষ থেকেও সিনেপ্লেক্স খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। গত বুধবার স্টার সিনেপ্লেক্সের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত পাঁচ মাসে সিনেপ্লেক্স বন্ধ থাকায় প্রায় দেড়শ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। তাই এখনই যদি সিনেপ্লেক্স খুলে দেওয়া না হয় তাহলে সিনেপ্লেক্সগুলো বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না বলে জানানো হয়। কারণ ব্যবসা বন্ধ রেখে ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। করোনার কারণে সরকারি নির্দেশে গত ১৮ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে সিনেমা হল। এতে বন্ধ হয়ে গেছে ছবি নির্মাণ। এই কারণে এ পর্যন্ত প্রায় কয়েকশ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি চলচ্চিত্রকারদের। করোনার কারণে আটকে থাকা অন্যান্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘মিশন এক্সট্রিম’ পর্ব-১, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’ ও ‘মন দেব মন নেব’।

‘মিশন এক্সট্রিম’ ছবির প্রযোজক ও পরিচালকদের একজন সানী সানোয়ার বলেন, এ পরিস্থিতিতে দর্শক সিনেমা হলে যাবেন কিনা, তা-ও ভাবার বিষয়।

আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। ‘মন দেব মন নেব’ ছবির পরিচালক রবিন খান বলেন, পরিস্থিতি ভালো হলেও মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরতে সময় লাগবে। ‘শান’ ছবির প্রযোজক আজাদ খান বলেন, ছবি মুক্তি নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতির ওপর। মার্চে মুক্তির তালিকায় ছিল ‘বিশ্বসুন্দরী’, ‘জ্বীন’, ‘বিদ্রোহী’, ‘নীল মুকুট’, ‘পরাণ’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’ , ‘চল যাই’ ‘নারীর শক্তি’,  ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’, ‘গোর’,  ‘বান্ধব’, ‘নীল ফড়িং’ প্রভৃতি ছবি। করোনার কারণে মুক্তি স্থগিত করায়  সেগুলো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে জানান চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দিন। তার কথায়Ñ কোনো ছবি নির্দিষ্ট সময় মুক্তি  না  পেলে নানা কারণে ছবিটির মেরিট নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এটি লোকসানের কবলে পড়ে। ১৫ মার্চ থেকে নেপালে ‘কানামাছি’ সিনেমার শুটিং শুরুর কথা ছিল। সেটিও স্থগিত। আরও বন্ধ হয়ে গেছে অনন্তর ‘দিন : দ্য ডে’, নেয়ামুলের ‘গাঙচিল’, ‘জ্যাম’, রায়হান রাফির ‘স্বপ্নবাজি’, ‘ইত্তেফাক’, সৈকত নাসিরের ‘ক্যাসিনো’, ‘আকবর’, সাইফ চন্দনের ‘ওস্তাদ’, ‘মন্ত্র’, ‘কাপ্তান’ ও ‘কয়লা’, কবরীর ‘এই তুমি সেই তুমি’, মালেক আফসারীর ‘টেনশন’, মানিকের ‘আনন্দ অশ্রু, শনিবার বিকেল, ওস্তাদ, পাপ-পুণ্য, আগামীকাল, আদম, সিক্রেন্ট এজেন্ট, ডেঞ্জারম্যান, স্বপ্নবাজি, ঢাকা ২০৪০, বিক্ষোভ, মানুষের বাগান, পেয়ারার সুবাস, কমান্ডো, ‘ওপারে চন্দ্রাবতী’ ও ‘বসন্ত বিকেল’, ‘সাহসী  যোদ্ধা’, ‘পদ্মপুরাণ’-সহ বেশ কিছু ছবি। ছবি নির্মাণ বন্ধ ও মুক্তি দিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ কতটা ভয়াবহ হয় সেই আশঙ্কায় পড়েছেন এখন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর