বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে সিনেমা হল

আলাউদ্দীন মাজিদ

বদলে যাচ্ছে সিনেমা হল

‘পর্যাপ্তসংখ্যক ও মানসম্মত ছবি নেই এ কারণে দর্শক সিনেমা হলবিমুখ। ফলে  লোকসানের কবলে পড়ে আমাদের নাকাল হতে হচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। এভাবে লোকসান গুনে কি সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব? প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফিরোজ রশীদ। তার কাছে পাল্টা প্রশ্ন- তাহলে কী করবেন? এক কথায় তার জবাব, সিনেমা হল বদলে ফেলতে হবে। মানে বিশাল জায়গাজুড়ে প্রায় হাজার আসনের সিনেমা হল রাখার আর কোনো অর্থ নেই। এখন যেটা করতে হবে তা হলো, সিনেমা হলগুলো ভেঙে সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে হবে। সেই বাণিজ্যিক ভবনে থাকবে দুই থেকে তিনশত আসনের একাধিক সিনেমা হল। কিন্তু সিনেপ্লেক্স নয়, কারণ সিনেপ্লেক্সে ব্যয় বেশি, টিকিটের দামও বেশি। তাই মালিক পক্ষ এবং দর্শক দুইয়ের জন্যই তা অনুকূল হবে না। সাধারণ দর্শক উচ্চমূল্যে টিকিট কিনে ছবি দেখতে পারবে না। আরেকটি বিষয় হলো মফস্বলের সাধারণ দর্শকও সিনেপ্লেক্সে বেশি দামের টিকিটে ছবি দেখবে না। গ্রাম-গঞ্জে এখন যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, জারি, সারি গানের আসর, সার্কাস, পুতুলনাচ বলতে কিছু নেই। তাদের যদি সিনেমার মাধ্যমে বিনোদন দেওয়া না যায় তাহলে তো তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। আশির দশক পর্যন্ত সিনেমা হলে সব শ্রেণির দর্শক আসত। তখন মানসম্মত ছবিও নির্মাণ হতো। এখন তো আর তা নেই। মধ্যে বাজে ছবির সময় শুরু হলে  বেশির ভাগ দর্শক সিনেমা হলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ওপর এখন তো সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয়ও সারা বিশ্বের ছবি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই দেশের প্রধান এই গণমাধ্যম সিনেমা শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে সিনেমা হল পরিবর্তনের বিকল্প নেই। বর্তমানের সিনেমা হলগুলো ভেঙে সেই জায়গায় বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করে সেখানে ছোট পরিসরে কয়েকটি সিনেমা হল নির্মাণ করলে সিনেমা হল পরিচালনার ব্যয়ও কমবে আর বাণিজ্যিক ভবনে থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে সিনেমা হলের লোকসান পূরণ করা সম্ভব হবে। কাজী ফিরোজ রশীদ আরও জানান, তার মালিকানাধীন সাভারের চন্দ্রিমা ও শিউলী এবং রংপুরের শাপলা সিনেমা হল তিনটি ভবিষ্যতে ভেঙে এভাবেই সিনেমা হল নির্মাণ করবেন। একই মত ব্যক্ত

করে রাজধানীর মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির আরেক সাবেক সভাপতি ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ বলেন, ছবিই তো নেই। ছবি ছাড়া এতবড় সিনেমা হল  রেখে লোকসান গোনার কোনো মানে আছে? তিনি বলেন, আমার সিনেমা হলটি এখনই ভাঙছি না। কারণ এই ভবনটিতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে একটু দেরিতে হলেও ভবিষ্যতে বর্তমান কাঠামো বদলে কয়েকটি দুই থেকে তিনশত আসনের সিনেমা হল নির্মাণ করব। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার সাথী সিনেমা হলের মালিক চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তো মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবির অভাব রয়েছেই। তার ওপর বর্তমানে অনলাইনে ছবি মুক্তির কালচার শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় সিনেমা হলের দর্শক আরও কমে যাবে। তাই বড় মাপের সিনেমা হল রেখে জায়গা নষ্ট করে আর লোকসান গুনতে চাই না। বড় সিনেমা হল ভেঙে আমিও  সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে  ছোট পরিসরে মানে দুই থেকে তিনশত আসনের একাধিক সিনেমা হল গড়ার পক্ষে। সত্যি বলতে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ সিনেমা দেখার ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন চায়। বিশ্বে এখন তাই হচ্ছে। তাই আমাদেরও দর্শকরুচি আর বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন পথে হাঁটতে হবে। মিয়া আলাউদ্দীন জানান, সরকারি হিসাবে দেশে এখন ৯২টি সিনেমা হল আছে। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, লোকসানের কারণে অধিকাংশ সিনেমা হলের মালিক অনেক দিন ধরে সিনেমা হলের লাইসেন্স নবায়ন করছেন না। ফলে সরকারি হিসাবের তালিকায় সেসব সিনেমা হলের নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। এখন আসলে প্রায় সব সিনেমা হল মালিকই চাচ্ছেন বড় সিনেমা হল ভেঙে সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে তাতে ছোট আকারে একাধিক সিনেমা হল নির্মাণ করতে। করোনাকাল অবসানের পরই সব সিনেমা হল মালিক মিলে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবেন বলে আলোচনা চলছে। যশোরের শার্শায় অবস্থিত ময়ূরী সিনেমা হলের কর্ণধার আশরাফুল বাবুরও একই মত। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ময়ূরীর ছিল একসময় রমরমা অবস্থা। দর্শকমুখর হয়ে থাকত ৭০০ আসনের এই সিনেমা হলটি। কর্ণধার বাবু আক্ষেপ নিয়ে বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে সিনেমা হলের অস্তিত্ব এ দেশে থাকবে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। তিনি জানান, করোনার কারণে সিনেমা হল বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে স্টাফদের বেতনসহ নানা খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তাই আগামীতে তিনিও সিনেমা হল ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে সেখানে ছোট পরিসরে সিনেমা হল নির্মাণ করতে চান।

বলাকা হলের অন্যতম ব্যবস্থাপক শাহিন জানান, এখন পর্যন্ত তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। তার কথায় হলের ব্যবসা হয় মাসে ২-৩ লাখ টাকার, কিন্তু মাসে বেতন দিতে হয় ৬ লাখ টাকার বেশি। ঈদ মৌসুম বা খুব হিট ছবি ছাড়া প্রতি মাসে ভর্তুকি দিতে হয়। রায়েরবাজারের মুক্তি সিনেমা হলে কাজ করেন ২২ জন কর্মচারী। হলটির ব্যবস্থাপক শহিদুল্লাহ বলেন, বেতন কীভাবে চালিয়ে যাবে সেই চিন্তায় অস্থির কর্তৃপক্ষ। মিরপুরের পূরবী হলের ম্যানেজার পরেশ জানান, তাদের হলে মোট ৩২ জন কর্মচারী কাজ করেন। তার কথায় ব্যবসা না থাকলে মালিকের পক্ষে বেতন দেওয়া কীভাবে সম্ভব? রংপুরের শাপলা হলের ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে হল খুললেও দর্শক আসবে বলে আমার মনে হয় না। এই সিনেমা হলে ২২ জন কর্মচারী ফুলটাইম চাকরি করেন। যশোরের মণিহার প্রেক্ষাগৃহের হিসাবরক্ষক   তোফাজ্জল  হোসেন বলেন, আমরা ৩২ জন কাজ করি। মালিকপক্ষ ভর্তুকি দিয়ে হল চালাত। বেতন দেওয়া হতো আমাদের মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারের আয় থেকে। এখন তাও প্রায় বন্ধ। চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেসে কাজ করেন ১৫ জন, ঝুমুর হলে ১২ জন। তাদেরও নিয়মিত বেতন দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান প্রেক্ষাগৃহ দুটির ম্যানেজার সাইফ হোসেন। লোকসান গুনে বন্ধ করে দেওয়া ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘অভিসার’-এর কর্ণধার সফর আলী ভূঁইয়া উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, প্রতি মাসে ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। এভাবে আর কতদিন। তাই বাধ্য হয়ে মার্চ মাস থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১৯৬৮ সালে  প্রতিষ্ঠিত ১০০০ আসনের অভিসার। সফর আলী জানান, একসময় এটি ছিল উন্নত জীবন ধারণের ব্যবসা। মাসে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা নিট মুনাফা হতো। হঠাৎ চলচ্চিত্রের মানে ধস নামলে দর্শকের অভাবে বছরের পর বছর শুধুই লোকসান গুনে যাচ্ছি। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে করোনা শেষ হলেও সিনেমা হলের ব্যবসা কেউ চালিয়ে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সরকার  চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করলেও ‘সিনেমা হল’ শিল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ঢাকার আজাদ সিনেমা হলের কর্ণধার কলিমুল্লাহর উদ্বেগ আরও তীব্র। তার কথায় ২৫ জনের মতো স্টাফ আর বিদ্যুৎ বিলসহ যাবতীয় খরচ লাখ লাখ টাকার, কতদিন এভাবে বেকার বসে বসে চালাব। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য এই সিনেমা হলটি গত ৫ মাস বন্ধ থাকায় এর সব যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, আসন-  সবই নষ্ট হয়ে গেছে। সিনেমা হল কখনো খুললে এসব সংস্কারের টাকা কোথায় পাবেন তিনি জানেন না। সরকারের কাছে সিনেমা হলের জন্য কোনো সহযোগিতা চেয়ে কখনো পাওয়া যায়নি বলেও তার ক্ষোভ। দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত হাজার আসনের বিখ্যাত সিনেমা হল ‘উর্বশী’র অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে বলে জানান এর কর্ণধার খুরশিদ আলম। তিনি উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, সিনেমা হলের মেশিন থেকে শুরু করে সবকিছুই তো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় ১৫ জন স্টাফকে স্বল্প পরিমাণে বেতন দিচ্ছি। প্রতি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। সিনেমা হল বন্ধ করে এখানে গোডাউন বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতাম। তাই ভাবছি আগামীতে এখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে তাতে  ছোট ছোট কয়েকটি সিনেমা হল তৈরি করব। এতে একদিকে সিনেমা হলের আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন হবে, অন্যদিকে সিনেমা হল মালিকরা ব্যয় কমে যাওয়ায় লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ছবি ও দর্শক খরায় বড় সিনেমা হল বদলে ছোট সিনেমা হল করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর