শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

চিরদিনের নায়করাজ রাজ্জাক

চিরদিনের নায়করাজ রাজ্জাক

মৃত্যু অমোঘ নিয়তি। চাইলেই মৃত্যুকে পাশ কাটানো যায় না। এরপরও কেউ কেউ নিজের কর্মবলে নশ্বর পৃথিবীর অবিনশ্বর সত্তা হয়ে ওঠেন। আমাদের প্রিয় নায়করাজ তাদেরই একজন। সাধারণ মানুষ থেকে কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি। ষাট-সত্তর-আশির দশকে প্রবলভাবে রুপালি পর্দায় উপস্থিত হন রাজ্জাক। চেষ্টা-পরিশ্রম-মেধা আর অধ্যবসায় দিয়ে পৌঁছে যান সাফল্যের শীর্ষে। এর মধ্যেই জুটে যায় ‘নায়করাজ’ খেতাব। এরপর নায়ক থেকে প্রযোজক-পরিচালক-সংগঠক নানা পরিচয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলা চলচ্চিত্রের এ কিংবদন্তির আজ তৃতীয় প্রয়াণের দিনে নায়করাজকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

নায়করাজের শেষ দিনগুলো

বেশ কিছুদিন ধরে একটি নতুন ঘটনা ঘটছে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই নায়করাজ রাজ্জাক স্ত্রীকে ডেকে বলেন, ‘লক্ষ্মী তাড়াতাড়ি আমার নাস্তা দাও, ৯টা বেজে গেছে, শুটিংয়ে যেতে হবে। ড্রাইভারকে বল গাড়ি বের করতে, আমার জুতা কোথায়?’ স্ত্রী-পুত্ররা ছুটে এসে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, না এখন আপনার কোনো শুটিং নেই, আপনি বিশ্রাম নিন। নায়করাজ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার শুয়ে পড়েন। তার চোখের কোণে বেয়ে কষ্টের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজ্জাকপুত্র সম্রাট। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে সম্রাট বলেন, ‘বাবা সারাটা জীবন চলচ্চিত্রকেই মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছেন। এখনো ছুটে যেতে চান ক্যামেরার সামনে। বলেন, ‘আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই। কিন্তু শরীর তাকে সেই সুযোগ দেয় না। অসুস্থতা আর বয়সের ভারে নিজের পরম চাওয়া থেকে বঞ্চিত তিনি। অসহায়ের মতো অসীম শূন্যতায় তাকিয়ে থাকেন তিনি।’ দুঃখ নিয়ে সম্রাট ফিরে যান বাবার ক্যারিয়ার শুরুর দিনগুলোতে। তিনি শুনেছেন কমলাপুর থেকে হেঁটে এফডিসিতে যেতেন বাবা। পকেটে গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত থাকত না। নিজে এবং পরিবার দিনের পর দিন উপোস করেছেন। অনেক সংগ্রাম করে এ শিল্পে স্থান গড়ে নিয়েছেন। যখন সুদিন ফিরল পারিশ্রমিক ছাড়াই অনেকের ছবিতে কাজ করে দিতেন। অনেক নির্মাতা অর্থের অভাবে ছবির কাজ এগিয়ে নিতে পারতেন না। কিংবা ছবি মুক্তি দিতে পারছেন না। বাবা নিজের টাকা দিয়ে সব ব্যবস্থা করে দিতেন। তার কথা ছিল টাকার অভাবে ছবি যদি নির্মাণ না হয় বা মুক্তি না পায় তাহলে এ শিল্প তো আর টিকবে না। ছবির পরিমাণ আর সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, পর্যাপ্ত ছবি পেয়ে সিনেমা হলের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গেল।

ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প নিয়ে জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে অভিনয় করায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বাবাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। সম্রাট বলেন, মায়ের মুখে শুনেছি বাবা পরিবারের কাছে শেষ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কারণ পাকবাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়া মানে আর ফিরে আসা নয়। বাসায় কান্নার রোল পড়ে গেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত, একজন আর্মি অফিসার চিনতে পেরে বাবাকে ছেড়ে দেন। সম্রাট জানান, ১৯৯৯ সালের দিকে যখন চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হয় তখন অবস্থা এমন দাঁড়াল রুচি-বিবর্জিত একটি গ্রুপ হুট করে এ শিল্পে ঢুকে পড়ল। তারা মুরব্বি মানল না। বিষয়টি ছিল এমন এ শিল্পকে ধ্বংসের নীলনকশায় নেমেছে তারা। এ অবস্থায় সিনিয়ররা মানসম্মান নিয়ে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরতে বাধ্য হলেন। অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নায়করাজ তার প্রযোজনা সংস্থা ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন’ বন্ধ করে দিলেন। বাপ্পারাজ চুক্তিবদ্ধ হওয়া প্রচুর ছবিই শুধু ছাড়েননি, অভিনয় থেকেও সরে এলেন। অশ্লীলতা শুরুর দিকে রাজ্জাক চেষ্টা করেছিলেন সুস্থ ধারার ছবি নির্মাণ করে চলচ্চিত্রের সুনাম ফিরিয়ে আনতে। ২০০০ সালে তিনি নির্মাণ করলেন ‘মরণ নিয়ে খেলা’ ছবিটি। কিন্তু নীলনকশা বাস্তবায়নকারীদের ষড়যন্ত্রে ছবিটি লোকসান গুনল। সম্রাট বলেন, বাবার হাতে কাজ নেই, আমি পড়াশোনা করছি। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বাবা। ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন বন্ধ। অর্থের অভাবে সংসারে অচলাবস্থা দেখা দিল। তারপরও অন্য কোনো পেশায় যাননি বাবা এবং বড় ভাই বাপ্পা। শেষমেশ পেটের দায়ে কলকাতায় ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির কপিরাইট বিক্রি করতে হলো বাবাকে এবং সেখানে গিয়ে অভিনয় করতে হলো তাকে। দেশীয় চলচ্চিত্রের পুনরুদ্ধারে বাবা কিন্তু থেমে থাকলেন না। ২০০৭ সালে তিনি বললেন, এভাবে চুপ করে বসে থাকলে এ শিল্প তো একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাকে ও বড় ভাইকে ডেকে বললেন, চল আবার চেষ্টা করি। আমাকে নায়ক করে তিনি নির্মাণ করলেন, ‘আমি বাঁচতে চাই’ ছবিটি। আবার আমাদের নিয়ে চলচ্চিত্রশিল্প পুনরুদ্ধারে বাবার যাত্রা শুরু হলো। একের পর এক ছবি নির্মাণ করছেন তিনি। চলচ্চিত্রের উন্নতির জন্য নিজের পরিবারকে কখনো সময় দিতে পারেননি। দিনের পর দিন না খেয়ে শুটিং করেছেন। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে শুটিং ফ্লোরের মেঝে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার এ পরিশ্রম চলচ্চিত্রকে করেছে সমৃদ্ধ। তার এ অবদানের কথা একদিকে দেশবাসী যেমন ভুলেননি তেমনি মনে রেখেছে সরকার। তাই রাষ্ট্র নায়করাজকে দিয়েছে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’।

 

অভিনয়ে অভিষেক

টালিগঞ্জের ফিল্মপাড়ার কাছেই ছিল রাজ্জাকদের পৈতৃক বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই কানন দেবী, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাসদের দেখে দেখে বড় হয়েছেন। তাদের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবতেন ‘এক দিন আমি তাদের মতোই বড় অভিনেতা হব।’ টালিগঞ্জের বড় বড় স্টুডিও ছিল তাদের এলাকায়। সেখানে নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতেন তিনি। এভাবেই পীযূষ বোসের নজরে পড়া এবং অভিনয়ে নিয়মিত হওয়া। ঢাকায় আসার পর তিনি যোগাযোগ করেন ঢাকার প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে। তিনিই আবদুর রাজ্জাককে ওই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মসে চাকরি নিয়ে দেন। পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারীর কাজ করতে থাকেন তিনি। সহকারী পরিচালক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘উজালা’। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওয়াস্তাগার লেন’, ‘আখেরি স্টেশন’ ও ‘ডাকবাবু’ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি। এভাবে হঠাৎ সুযোগ আসে নায়ক হওয়ার। জহির রায়হান ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রের নায়ক বানিয়ে দেন তাকে। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় এবং এতে রাজ্জাকের অভিনয় খুবই প্রশংসিত হন। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজায় মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহী’তে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। কলেজজীবনে মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘রতন লাল বাঙালি’ নামক চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাড়ি জমান। প্রথমদিকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয় হন। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাতা আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওয়াস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে কার বউ, ডাকবাবু, আখেরি স্টেশনসহ আরও বেশকটি ছবিতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।

১৯৬৬ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়ক হন। নায়ক চরিত্রে প্রথম ছবিতেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। তিনি তিন শতাধিক বাংলা ও উর্দু ছবিতে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন ১৬টি চলচ্চিত্র।

 

প্রযোজক পরিচালক রাজ্জাক

অভিনয়ের পাশাপাশি রাজ্জাক প্রযোজক, পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গড়ে তোলেন প্রযোজনা সংস্থা ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন’। নির্মাণ করেন আকাক্সক্ষা, পাগলা রাজা, জোকার, অনন্ত প্রেম, অভিযান, বদনাম, প্রফেসর, উত্তর ফাল্গুনী, প্রেমশক্তি, ঢাকা ৮৬, জিনের বাদশা, চাঁপাডাঙার বউ, বাবা কেন চাকর, সৎ ভাই, সন্তান যখন শত্রু, প্রেমের নাম বেদনা, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে প্রভৃতি। ১৯৭৭ সালে রাজ্জাক আত্মপ্রকাশ করেন পরিচালক হিসেবে। নির্মাণ করেন অনন্ত প্রেম। তার পরিচালিত অন্য ছবির মধ্যে চাঁপাডাঙার বউ, বদনাম, বাবা কেন চাকর উল্লেখযোগ্য।

 

বিভিন্ন সংস্থার সদস্য

চলচ্চিত্রশিল্পীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজ্জাক। এ ছাড়া তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজ্জাক বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেন।

 

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করে যান রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক খেতাব। অর্জন করেন একাধিক সম্মাননা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পাঁচবার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন রাজ্জাক। ৫০ বছরের চলচ্চিত্রজীবনে তিনি পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। এ ছাড়া জাতীয় চলচ্চিত্র মেলা ২০০৯-এ চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য রাজ্জাক পরিবারকে সম্মাননা জানানো হয়। নায়করাজ যে পাঁচ ছবির জন্য নায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান সেগুলো হলো ‘কী যে করি’ (১৯৭৬), ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮), ‘বড় ভালো লোক ছিল’ (১৯৮২), ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯৮৪) ও ‘যোগাযোগ’ (১৯৮৮)। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নায়করাজকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

এক নজরে রাজ্জাক

প্রকৃত নাম : আবদুর রাজ্জাক।

বাবা-মা : আকবর হোসেন ও নিসারুন্নেসা।

জন্ম : ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। কলকাতার টালিগঞ্জে।

মৃত্যু : ২১ আগস্ট, ২০১৭ সাল।

বিয়ে : ১৯ বছর বয়সে, ১৯৬২ সালে। বিয়ে করেন খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীকে।

সন্তান : তিন পুত্র ও দুই কন্যা।

বাংলাদেশে আগমন : ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন।

অভিনয়জীবন : স্কুলে পড়ার সময় ‘বিদ্রোহী’ নাটকে, কলেজজীবনে ‘রতন লাল বাঙালি’ ছবিতে তার প্রথম অভিনয়। ১৯৫৯ সালে বোম্বের ফিল্মালয়ে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার ‘পংকতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়। ১৯৬৪ সাল থেকে ঢাকার ছবিতে অভিনয়।

প্রথম ছবি [নায়ক] : ১৯৬৬ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’।

 শেষ অভিনীত ছবি : বাপ্পারাজের ‘কার্তুজ’ ২০১৪ সাল।

সর্বশেষ খবর