শিরোনাম
রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

শিল্পীরা কেন সংগীত পরিচালক...

আলী আফতাব

শিল্পীরা কেন সংগীত পরিচালক...

একটা সময় ছিল, যখন একটি গান করা মানে বিশাল এক আয়োজন। একটি স্টুডিওতে গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও শিল্পীদের মিলন মেলা। এখন একটি গান হচ্ছে কিন্তু কারও সঙ্গে কারও দেখা হয় না। এখন অনেক শিল্পীর ঘরেই গড়ে উঠেছে গানের স্টুডিও। প্রযুক্তির উন্নয়নে এখন নিজেদের ব্যবস্থাপনায় অনেক সংগীতশিল্পীই নিজের ঘরে গানের স্টুডিও স্থাপন করেছেন। এসব স্টুডিওতে অডিও থেকে শুরু করে সিনেমার গানও রেকর্ড হচ্ছে। বাপ্পা মজুমদার, বালাম, হাবিব, হৃদয় খান, ইমরান, বেলাল খান, কিশোর, প্রতিক হাসান, তানজীব সারোয়ারসহ অনেক সংগীতশিল্পীই নিজেদের ব্যক্তিগত হোম স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এই মানুষগুলোকে আমরা প্রকৃতপক্ষে চিনি কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। একসময় চলচ্চিত্র কিংবা অডিও গানে মানুষের প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছেন সত্য সাহা, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দীন আলী, শেখ সাদী খান, আলম খান, আনোয়ার পারভেজ, সুবল দাশ, সমর দাশের মতো সংগীত পরিচালকরা।

এ প্রসঙ্গে বরেণ্য সংগীত পরিচালক আলম খান বলেন, ‘আমার মনে হয় যার যে কাজ তাকে ওই কাজটি ভালো করে করা প্রয়োজন। একজন শিল্পীকে শুধু গানই করা উচিত। একজন গীতিকারকে শুধু গানই লেখা উচিত। একজন শিল্পী যখন একটি গান সুর কিংবা সংগীত পরিচালনা করবেন, তখন তার গানগুলো একরকম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ শিল্পী তার নিজের পছন্দমতো সুর কিংবা পরিচালনা করবে। তাই অনেক সময় দেখা যায়, ওই শিল্পীর করা প্রায় সব গানই এক।’ এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও সুরকার শেখ সাদী খান বলেন, ‘আমাদের সংগীতে একটা অনিয়ম চলছে। এখন এসব সত্য কথা বলতে গেলে অনেকের হয়তো খারাপ লাগবে। সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম। একজন ভালো মিউজিশিয়ান তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু একটা ভালো গান বা সুন্দর সৃষ্টির জন্য একজন ভালো মিউজিশিয়ান ছাড়া সম্ভবই নয়। গান হচ্ছে কানে শোনার, হৃদয়ে অনুভব করার। কিন্তু এখন গান হয়ে গেছে চোখে দেখার। আমরা যারা এই সেক্টরে কাজ করছি তাদের চিন্তাভাবনায় সবসময় আগামী দিনের পরিকল্পনা থাকা উচিত। আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি। আমাদের একটা নিজস্বতা থাকবে। তা ঠিক রেখে একেকজন একেকভাবে কাজ করবে, এটাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হলো না। যার ফলে বর্তমানে যে গানগুলো হচ্ছে সেগুলোর স্থায়িত্ব একেবারেই কম।

এ বিষয়ে দেশবরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান বলেন, এটা তো বাস্তব অবস্থা। কথা, সুর, পরিমিত সংগীত, সুন্দর গায়কি ও সেই গানে সঠিকভাবে দেশীয় যন্ত্রের ব্যবহার একটি গানকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যায়। সেই গান টিকেও থাকে বহুদিন। কিন্তু এখন গানগুলো স্থায়ী হচ্ছে না ভালো সংগীত পরিচালকের অভাবে। খুব অল্পসংখ্যক সংগীত পরিচালকই বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করছেন। সবাই সফটওয়্যার ব্যবহার করেই গান বানিয়ে ফেলছেন। আর এর মাধ্যমে আমাদের গুণী বাদ্যযন্ত্রীরা এদিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, আগে একটা গানের পেছনে আমরা অনেক সময় দিতাম। বাণিজ্যিক স্টুডিওতে দুই-তিন দিন ধরে একটি গানের রেকর্ডিং হতো। গান রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে গীতিকার, সুরকার ও ছবির পরিচালক থাকতেন। থাকতেন মিউজিশিয়ানরা। এক টেকে সে সময় রেকর্ডিং হতো। তখন এক লাইন করে করে রেকর্ডিং হতো না। একটা গান রেকর্ডিং করতে দেখা যেত সারা রাত চলে গেছে। কিন্তু সেই গানটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য কারও মধ্যে ক্লান্তির ছাপ থাকত না। এ কারণেই গানের মান ভালো ছিল। সেসব গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এখন তো ঘরে ঘরে স্টুডিও। যে কেউ সংগীত পরিচালক বনে যাচ্ছেন! যেন খুব সোজা বিষয়টি। এটা কিন্তু আমাদের সংগীতের জন্য ভয়াবহ একটি ব্যাপার। এ বিষয়ে সংগীত পরিচালক ইমন সাহা বলেন, যার কাজ তারই করা ভালো। একজন শিল্পী তো আর সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে কিংবা বোঝেন না। এখন অনেক তরুণ শিল্পী গান পরিচালনা করছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ভালো করছেন। কিন্তু তার সংখ্যা কম। অন্যদিকে আমাদের চলচ্চিত্রের গানের সার্বিক পরিস্থিতি এখন দারুণ উন্নতি হয়েছে। এ বিষয়ে সংগীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, একজন শিল্পীর প্রথম পরিচয় হওয়া উচিত, তিনি একজন শিল্পী। তারপর তিনি যা পারেন তা করা উচিত। কিন্তু কষ্ট লাগে যখন দেখি ভালো ভালো শিল্পী সংগীত পরিচালনা করতে গিয়ে গানটা কমিয়ে দিয়েছেন। এখন ঘরে ঘরে হোম স্টুডিও করছেন শিল্পীরা। কিন্তু বাণিজ্যিক স্টুডিওতে যে কাজ হতো তা কখনো হোম স্টুডিওতে সম্ভব নয়। আর আগের মতো গানে এখন বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। এ কারণে গানের মান আগের মতো নেই। একজনই গাইছে, লিখছে, সুর-সংগীত ও মিক্স-মাস্টার করছে। তাহলে মান থাকবে কীভাবে! যারা জেনে-বুঝে ও শিখে করছেন তাদের বিষয় আলাদা। বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বাপ্পা মজুমদার। ‘মিউজিক স্টেশন’ নামে তারও একটি স্টুডিও আছে।

তিনি বলেন, ‘একজন শিল্পীর ঘরে নিজের স্টুডিও থাকতেই পারে। তবে অবশ্যই যেন সেটি মানসম্পন্ন হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধু একটি সাউন্ড কার্ড আর একটি কম্পিউটার বসিয়ে স্টুডিও বানিয়ে ফেললে হবে না। শিল্পীকে প্রথমে তার গানের প্রতি নজর দিতে হবে।’ একসময় পেশাদার স্টুডিওগুলোতে সুরকার, গীতিকার, যন্ত্রশিল্পী ও কণ্ঠশিল্পী মিলে গান তৈরি হতো। এর মাধ্যমে সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একটা পারিবারিক যোগাযোগ তৈরি হতো। সেই জায়গার অভাব অনুভব করেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে বাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘অবশ্যই সে অভাব অনুভব করি, করছি। এখন হোম স্টুডিও হওয়ায় সবাই নিজস্ব জায়গা থেকে সবকিছু ভাবছেন। এতে সবার সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে। কারণও আছে। এখন তো অডিও থেকে কোনো আয় নেই। খরচটা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। হোম স্টুডিও হওয়ায় গানের টিমওয়ার্ক কমেছে। একটি গান টিমওয়ার্ক করে তৈরি করলে যেমন হবে, হোম স্টুডিওতে বসে করলে সে রকম হবে না। আগে বড় বড় স্টুডিওতে বেশির ভাগই টিমওয়ার্ক করে কাজ হতো।’

এই সময়ের তরুণ সংগীত পরিচালক ও শিল্পী ইমরান মাহমুদুল ‘মিউজিক ল্যাব’ নামে নিজের ঘরে স্টুডিও  তৈরি করেছেন। ইমরান বলেন, আমার প্রথম পরিচয় হচ্ছে আমি গানের মানুষ। আমি গান করতে ভালোবাসি। তারপরের পরিচয় হচ্ছে আমি একজন সংগীত পরিচালক।’ নিজের স্টুডিও প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঘরে স্টুডিও হওয়ায় কাজের সুবিধা হয়েছে, মুড এলেই গান নিয়ে স্টুডিওতে বসতে পারছি। প্রযুক্তির কল্যাণেই এই সুবিধাটা হয়েছে। তবে হোম স্টুডিওগুলো হওয়ার কারণে অ্যাকুয়াস্টিক যন্ত্রের ব্যবহার কমে গেছে। বড় বড় স্টুডিওতে আগে যেভাবে পারিবারিক পরিবেশে কাজ হতো, বিশেষ করে সবাই একসঙ্গে বসে অনুশীলন করে গান রেকর্ডিং হতো, এখন তার অভাব তৈরি হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর