মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত পার্শ্বচরিত্র...

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত পার্শ্বচরিত্র...

১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল ঢাকার প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। এতে নানা চরিত্রের উপস্থাপনায় চলচ্চিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। যেমন এ ছবিতে ডাকাত চরিত্রে ইনাম আহমেদের দুর্দান্ত অভিনয় এখনো দর্শকমনে শিহরণ জাগায়। একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো- নানা, নানী, দাদা, দাদি, মা, বাবা, ভাই, বোন, প্রেমিক, প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। আর এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এতে দর্শক কোনো না কোনোভাবে নিজেদের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে উপভোগ করত ছবিটি। এ কারণেই ৫০ থেকে আশির দশকের চলচ্চিত্রের ছিল সোনালি সময়। যা এখন নেই বললেই চলে। এ সময় ফোক, নারীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিত্র, প্রেম, গ্রাম্য মোড়লের আধিপত্য থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকের মনে চলচ্চিত্রকে চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হতো। নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত হলেও এখানে পরিবারের বিভিন্ন চরিত্র মর্মস্পর্শীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে আলোরূপী ববিতা ছিল নানা নারায়ণ চক্রবর্তীর আদরের নাতনি। যে কিনা ভোরে জেগে সবার মুখে চা তুলে দিয়ে ঘুম ভাঙাত। একসময় যুদ্ধের দামামা প্রাণ কেড়ে নেয় আলোর। এ ছবিতে আলো তার প্রাণ দিয়ে নতুন করে দেশ গড়ার মিছিলের অনুপ্রেরণা জোগায়। চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হলেও এই ছবিতে কয়েকটি পরিবারের যন্ত্রণার চরিত্র স্থান পায়। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একজন বীরাঙ্গনা নারীর গল্প বলে থেমে যায়নি। এখানে সাংবাদিকরূপী আনোয়ার হোসেনের বিবেকের দহন দর্শকের মন পুড়িয়েছে। খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ শুধু একটি ছবি ছিল না, এটি ছিল সমাজ সংস্কারের দর্পণ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় অভাব-অনটনে পোড়-খাওয়া সমাজে হতাশ মুক্তিযোদ্ধারা যখন অপরাধ করতে অস্ত্র হাতে তুলে নেন তখন তাদের কলেজের অধ্যক্ষ খান আতাউর রহমান তাদের মানুষ হওয়ার মন্ত্রণায় দীক্ষিত করে হতাশামুক্ত করে। আমজাদ হোসেন এগিয়ে এলেন গ্রাম্য কুসংস্কার আর মোড়লের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক তরুণের প্রতিবাদী গল্প নিয়ে। এ ছবিতে জাঁদরেল মোড়লরূপী এ টি এম শামসুজ্জামানের দুর্ধর্ষ অভিনয়ের কথা এখনো ভোলেনি দর্শক। ছবির নাম ‘নয়নমণি’। কঠিন জীবনযাত্রার গল্পে নির্মিত এই ছবিতে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে হালকা করতে কৌতুক চরিত্রে নির্মাতা হাজির করেন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদকে। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নারীর দুঃখপ্রধান চলচ্চিত্র হলেও এখানে মোড়লের অত্যাচার, সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র দর্শকদের এসব বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই ছবিতে জীবন সংগ্রামে পোড়-খাওয়া তিন নারী রওশন জামিল, আনোয়ারা ও ববিতার চরিত্রকে মর্মস্পর্শীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একইভাবে এই নির্মাতার ‘ভাত দে’ ছবিটিতে সমাজপতি মজুদদাররূপী খলঅভিনেতা রাজীবের অনবদ্য অভিনয় কখনো ভোলার নয়। একই সঙ্গে ছবির নায়িকা শাবানার বাবারূপী গায়েন চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের অসহায় জীবনকাহিনি দর্শকের অশ্রু ঝরিয়েছে। সেরা শিশুশিল্পীর সম্মাননা পায়। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে স্বৈরাচার শাসকের প্রতীকী চরিত্রে অসাধারণ হয়ে ওঠেছেন রওশন জামিল। আর স্বৈরাচারের হাতে নিষ্পেষিত জনতার আরেক প্রতীকী চরিত্রের নাম ছিল খান আতাউর রহমানের হৃদয় টলানো অভিনয়। যে কিনা এই দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য লুকিয়ে গেয়ে চলেন ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’। কামাল আহমেদের ‘অশ্র“ দিয়ে লেখা’, ‘পুত্রবধূ’, ‘অনুরাগ’, ‘উপহার’, নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’, কাজী জহিরের ‘বধূ বিদায়’ ‘ময়নামতি’, ‘মধূমিলন’, সাইফুল ইসলাম কাশেমের ‘সোহাগ’, ঘর সংসার, বৌরানী ছবিগুলোতে প্রেম, পরিবার, বিনোদন দর্শকদের বিমোহিত করেছে। নায়করাজ রাজ্জাকের ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বদনাম’, ‘সৎভাই’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’, ‘বাবা কেন চাকর’সহ তার নির্মিত ছবির গল্প ও চরিত্র এখনো সমাজ আর পরিবারের কথা বলে। আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ ছিল নিরক্ষতার অভিশাপমুক্ত হওয়ার গল্পে নির্মিত ছবি। এখানে ছোট্ট শিশু মাস্টার সুমন গ্রামের লেখাপড়া না জানা রহমত (রাজ্জাক) দারোয়ানকে অক্ষরজ্ঞান শিখাতে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তা সত্যিই শিক্ষণীয়। মতিন রহমানের ‘লাল কাজল’ ছবিটিতে সন্তানের জন্য একজন মায়ের হাহাকার তীব্র হয়ে ওঠেছে। এখানে মা চরিত্রে শাবানার অনবদ্য কাজ এখনো দর্শকের অশ্রু ঝরায়। আশির দশক পর্যন্ত এ জাতীয় সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র প্রচুর পাওয়া গেছে। চলচ্চিত্রে অনেক দিন ধরেই পার্শ্বচরিত্রের অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে। পার্শ্বচরিত্রের ক্ষেত্রে প্রথমেই বাবাদের কথা বলতে হয়। একটা সময় সিনেমার চিত্রনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাবার চরিত্র। পর্দায় দাপুটে বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফতেহ লোহানী, খলিল, গোলাম মুস্তাফা, শওকত আকবর, নারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখ। আদর্শবাদী বাবার ভূমিকায় মানানসই ছিলেন আনোয়ার হোসেন, প্রবীর মিত্র, রাজ্জাক, আলমগীর, খান আতা। বাবার মতো মায়ের চরিত্রও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কখনো কখনো নায়ক-নায়িকাকে ছাপিয়ে ‘মা’ হয়ে যান গল্পের মধ্যমণি। অনেকে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। দরিদ্র-খ্যাপাটে, মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন রানী সরকার। তেমনি সাদাসিধা মধ্যবিত্ত পরিবারের শহুরে মা কিংবা গ্রামের মায়ের ভূমিকায় মিনু রহমানের অভিনয় ছিল অনবদ্য। আবার অভিজাত ঘরের অহংকারী মায়ের চরিত্র মানেই ছিলেন মায়া হাজারিকা। কূটচাল, ষড়যন্ত্র এবং ছবির শেষে বরাবরই নিজের ভুল বুঝতে পারা রুপালি পর্দার মা ছিলেন মায়া হাজারিকা। বাংলার স্নেহময়ী মায়ের চরিত্র পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্য আয়েশা আখতার ছিলেন অনবদ্য। সারল্য, মমতা, সন্তানের জন্য আকুতির ক্ষেত্রে অনবদ্যভাবে মায়ের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আয়েশা আখতারের বিকল্প ছিল না। বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় মা ছিলেন রোজী আফসারী। বোনের চরিত্রেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। কয়েক দশক ধরে রওশন জামিল মন্দ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন। আনোয়ারার কথা আলাদা করে কিছু বলার নেই। শুধু মা নন। দাদির চরিত্রেও তিনি অনবদ্য। সহজ-সরল, সাদাসিধা, আটপৌরে, মধ্যবিত্ত মায়ের চরিত্রে রেহানা জলি মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। রেবেকা, ডলি জহুর, সুমিতা দেবী, রিনা খান, সুচন্দা, শর্মিলী, দিলারা জামান, মিরানা জামান, সুলতানা জামান, শবনম, শাবানা, ববিতা, সুচরিতা, সুজাতাসহ অনেকেই মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক ভালোবাসা ও জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। শুধু যে মা-বাবার চরিত্র শক্তিশালী ছিল তা নয়, একটা সময় গল্পের খাতিরে ভাই-বন্ধুসহ আরও অনেক ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সৃষ্টি ছিল গল্পে। সিনেমা শুধু নায়ক-নায়িকার খাতিরেই হিট হয় না। পার্শ্বচরিত্রগুলোও শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। তবে দুই হাজার সালের প্রথমদিকে সালাউদ্দিন লাভলু নির্মিত ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, গিয়াসউদ্দীন সেলিমের ‘মনপুরা’, এস এ হক অলিকের ‘হৃদয়ের কথা’, হাসিবুর রেজা কল্লোলের ‘সত্তা’য় যাপিত জীবন ও সমাজের নানা চরিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন আমাদের দেশের দর্শক ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু করে। আর কতিপয় নির্মাতা এসব মৌলিক গল্পবিবর্জিত ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে অ্যাকশন ছবির নামে মারদাঙ্গা গাঁজাখোরি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তির উদ্রেক করে। এই অবস্থা এখনো চলছে। মাঝে মধ্যে দুই-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। তিনি বলেন আমার প্রযোজনা সংস্থা থেকে ‘আগুন’, ‘দূরদেশ’সহ অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যা গল্প ও নানা চরিত্রে সমৃদ্ধ বলে দর্শকের মনে এখনো বেঁচে আছে। তিন কন্যা, কালো কোট সবুজ চশমা, প্রেম প্রীতি, হাজার বছর ধরে ছবির নির্মাতা চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছবিতে পরিবার আর গল্প খুঁজে পাওয়া যেত। আর তাতে নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে দর্শক সিনেমা হলে ভিড় করত। এখনকার ছবিতে গল্প আর চরিত্রের সংকট। এখন ছবিতে নানা-নানী, দাদা-দাদি তো দূরে থাক মা- বাবাই থাকে না। কমেডির নামে ভাঁড়ামি আর জোর করে দর্শক হাসানোর অপচেষ্টা চলে। আগে কমেডিয়ানরাও ছিল রীতিমতো তারকা। ছবিতে চরিত্র কমে গেছে। একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আর একজন খলনায়কও আইটেম গান থাকলেই নাকি ছবি হয়ে যায়। এসব ছবি দর্শক কখনো গ্রহণ করবে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, এখনকার ছবিতে গল্প তো নেই-ই, চরিত্র থাকবে কীভাবে। বর্তমানে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছেন তাতে যাপিত জীবনের চরিত্র নেই। এসব চরিত্র, গল্প ও জীবনবোধের ছায়াহীন ছবি দর্শক কেন দেখবে।

 

সর্বশেষ খবর