বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোতে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি

আলাউদ্দীন মাজিদ

অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোতে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি

গণমাধ্যমে অশ্লীলতা সমাজকে কি পরিমাণ কুলষিত করে তার আঁচ আমরা নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকেই পেয়েছিলাম। তখন এ দেশের চলচ্চিত্রে শুরু হয়েছিল লাগাম ছাড়া অশ্লীল ছবির ছড়াছড়ি। যার পরিণাম দাঁড়িয়েছিল যুবসমাজের মধ্যে চরম অবক্ষয়। ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণহীন। নানা অপরাধ প্রবণতা বাড়ে উদ্বেগজনক হারে। এরপর শুরু হয় ছোট পর্দায় ভিনদেশি সিরিয়াল দেখার ধুম। এসব সিরিয়ালের মুখ্য বিষয় পারিবারিক কোন্দল ও পরকীয়া। এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলল আমাদের সমাজে। পরকীয়া আর কথায় কথায় ডিভোর্সকে রীতিমতো কালচারে পরিণত করে ফেলা হলো। দেশ ও সমাজে এমন দৈন্যদশার পর এবার শুরু হলো অনলাইন প্লাটফর্মে অশ্লীলতায় ভরা ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ফিল্মের মহোৎসব। যুবসমাজ এখন এসব দেখতে রীতিমতো নেশাগ্রস্ত। উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের ভবিষ্যৎ যুবসমাজ যদি এসব দেখে অনৈতিকতার পথে পা বাড়ায় তাহলে দেশের আগামীটা কী হবে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গবেষক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক মতিন রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আসলে এমন, এখন প্রযুক্তির স্বাধীনতার যুগ। এই স্বাধীনতার কারণে বিশ্বময় চিন্তা ভাবনা বদলে গেছে। এই বৈশ্বিক বদলের সঙ্গে বাংলাদেশও যদি একাত্ম হতে চায় তাহলে বলার কিছু নেই। কারণ এখন প্রতিযোগিতার যুগ। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় অনুধাবণ করা জরুরি, আর তা হলো সব দেশেরই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। এখানে ভাবতে হবে, কোন দেশের শিল্প-সংস্কৃতির ভাবনা কেমন। কোনো কিছুকে আমরা চিহ্নিত করে দিতে পারছি না। কিন্তু আমাদের নৈতিকতা কী বলে সেটিই আগে ভাবতে হবে। আমরা তো এসব ছবিকে সেন্সরের আওতায় আনতে পারব না। আরেকটি বিষয় হলো, এটি আমরা পরিবার নিয়ে দেখছি না। একাকী দেখছি। এখানে বয়স ও দেখার স্বাধীনতাই মুখ্য। তারপরও বলব আমাদের নিজ দেশ ও সংস্কৃতির বিষয়টি নৈতিকভাবে ভেবে এ ক্ষেত্রে এগুতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো কিন্তু এসব দেখে বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে না। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকের মধ্যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে। সবশেষে বলতে চাই সুস্থ নাগরিক হিসেবে সবার দায়িত্ব হচ্ছে যুবসমাজকে আমরা কোন পথে নেব সেই চিন্তা করা।’ এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক  রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আসলে অশ্লীলতা ও যৌনতা এক নয়। যৌনতা হচ্ছে পার্ট অব লাইফ। এটি না থাকলে কারও জন্ম হতো না। যৌনতাকে আমি স্বাভাবিকভাবেই দেখি এবং স্বাগত জানাই। তবে অশ্লীলতা কখনই সমর্থন যোগ্য নয়। এসব ওয়েব ফিল্ম বা সিরিজের বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমত রেইট, মানে বয়স অনুযায়ী রেইটিং নির্ধারণ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত এটি কতটা শৈল্পিক সেদিকে নজর রাখতে হবে। ওয়েব ফিল্ম বা সিরিজ যেন কোনোভোবেই যেন ভালগার না হয়-লক্ষ্য রাখতে হবে।’

এদিকে, অনেকের মন্তব্য ‘শয্যাদৃশ্যের প্রয়োজনে কাহিনি, নাকি কাহিনির প্রয়োজনে শয্যাদৃশ্য-কিছু ওয়েব ফিল্ম বা সিরিজের ক্ষেত্রে এটিই বোঝা মুশকিল।’ হালের কিছু ওয়েব সিরিজকে ঘিরে ফেসবুকে এখন এমন অসংখ্য

মন্তব্যের ঝড়। বাংলাদেশের দর্শক কখনো কল্পনা করেননি, নাটক দেখতে গিয়ে তাদের পর্নো সদৃশ কিছু দেখতে হবে। কখনো ভাবেননি, শালীন-কুলীন প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন নগ্ন ও অশালীনরূপে তাদের সামনে হাজির হবেন। আর তাদের ভাষার কি শ্রী! কী অশ্লীল-অশ্রাব্য শব্দবাক্য! সংলাপ নয়, এ যেন মুখে ‘খিস্তি-খেউড়ের খই’! ‘বুমেরাং’, ‘সদর ঘাটের টাইগার’, ‘১৪ আগস্ট’ নামের ওয়েব সিরিজ দেখতে গিয়ে দর্শকরা এমনই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। অবশ্য তাতে বিব্রত নন শিল্পী-কুশীলব কিংবা নির্মাতা। তাদের কাছে সব কিছুই নাকি ‘গল্পের প্রয়োজনে’! কী সেলুকাস! ভিডিওগুলোয় যৌনতার বাণিজ্যিক সমীকরণ খুব সুস্পষ্ট। সুস্পষ্ট অশ্লীলতার ব্যাকরণ। নাটকের ভিউ পাওয়ার ট্রেন্ড কি তবে পাল্টে যাচ্ছে? অবশ্য ওয়েব সিরিজ নিয়ে এমন বিতর্ক নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে জনপ্রিয় ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘ট্রিপল এক্স’র প্রযোজকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। ২০১৮ সালে নেটফ্লিস্ক, আমাজন প্রাইম ভিডিওসহ আরও কিছু অনলাইন প্ল্যাটফরমের অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ওয়েব সিরিজ সরাতে দিল্লির হাই কোর্টে মামলা হয়। মামলা হয় জনপ্রিয় সেক্রেড গেমস, হাসমুখ বেতাল, পাতাল লকসহ বিভিন্ন ওয়েব সিরিজের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও বিতর্ক আর ওয়েব সিরিজ যথারীতি হাত ধরাধরি করেই চলছে। নব্বই দশকে আমেরিকায় ওয়েব সিরিজের জন্ম। আমেরিকান লেখক ট্রেসি রিড লিখিত ‘কোয়ান্টামলিঙ্ক সিরিয়াল’ (১৯৮৮-৯৯) দিয়ে এর যাত্রা। বিশ শতকের শেষ দিকে স্কট জাকারিনের সৃষ্টি ‘দ্য স্পট’ দিয়ে জনপ্রিয়তার সিঁড়িতে ওয়েব সিরিজের উত্থান। একুশ শতকে এর বিশ্বভ্রমণ, বিনোদনের প্রভাবশালী বিকল্প মাধ্যম হয়ে ওঠা। পার্শ্ববর্তী ভারতেও এর যাত্রা শুরু অনেক আগে। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের যাত্রা ২০১৭ সালে। ওই বছর ঈদুল ফিতরে টিভির পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রচার হয়। এর মধ্যে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে ৭ পর্বের ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই’ ও ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’, ‘এল আমোর টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ‘টেস্টিং সল্ট’, বাংলা ঢোলের উদ্যোগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম বাংলাফ্লিক্সে প্রচার হয় বিশেষ নাটক ‘উপহার’। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা মূলত তখন। এরপর ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহায়ও প্রচার হয় একাধিক নাটক। সমালোচনা ও বিতর্ক দিয়েই বাংলাদেশে ‘ওয়েব সিরিজ’-এর যাত্রা। ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক দিয়েই ওয়েব সিরিজের দৃষ্টি আকর্ষণ। ওয়েব সিরিজগুলোয় অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক যৌনতার সুড়সুড়ি, অশালীন সংলাপ ও অঙ্গভঙ্গি, মাদক গ্রহণের দৃশ্যবলীর কারণেই মূলত এ সমালোচনা। বিষয়বস্তু বা শিল্পগুণের বদলে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ দৃশ্যের বন্দুকে সস্তা ও দ্রুত জনপ্রিয়তা বা বিপুল ভিউয়ার বা সাবস্ক্রাইবার শিকারের চেষ্টা, নাটকগুলোয় খুব দৃষ্টিকটুভাবে পরিলক্ষিত হয়। আর সেই চেষ্টায় এখন যোগ হয়েছে পর্নোগ্রাফি।  ‘বুমেরাং’-এর ‘তোমার ঘরে বাস করে কয়জনা’ পর্বটি শুরুই হয় অভিনেতা আদনান ফারুক হিল্লোল ও অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষার দীর্ঘ বেডসিন দিয়ে। দেশীয় নাটকে এমন পর্নো দৃশ্যের সংযোজন সম্ভবত এই প্রথম। এমন ভিডিওতে দেশের প্রথম সারির নির্মাতা বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাবলীল অংশগ্রহণ অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। পুরো নাটকে প্রিয় পাত্র-পাত্রীদের এমন খোলামেলা ও রগরগে উপস্থিতি-সত্যিই প্রথম দেখাতে চোখ কপালে ওঠার মতো। অন্যদিকে ‘বুমেরাং’-এর ‘ঝড়ো হাওয়া লেগে তার শিখা নিভে যাবে’ পর্বটি আরও বেশি রগরগে ও যৌন উত্তেজক। এমন নাটকে পরিচিত মুখ মৌটুসী বিশ্বাস, ইমি, শ্যামল মাওলা ও তানভীরদের দেখে সত্যি লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছা হয়। আর ‘সদরঘাটের টাইগার’কে নাটক না বলে ‘গালি ব্যাংক’ বললে অত্যুক্তি হবে না। এমন ‘অশ্লীল গালিময়’ নাটক দেশে আর হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। অন্যদিকে ‘১৪ আগস্ট’ সিরিজটিতে যৌনতা, সহিংসতা, মাদক, অশ্লীল সংলাপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বখে যাওয়া ঐশীর কাহিনি। অশালীন বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৬৩ এর একটি জায়গায় কেবল অশ্লীলতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে-অশ্লীলতা হচ্ছে তাই, যা সুস্থ ও সাধারণ মানুষের মনে ইন্দ্রিয় ভোগবাসনা ও অন্যায় চিন্তা জাগানোর কারণ হতে পারে এবং নৈতিক চরিত্র কলুষিত করে তাদের মনকে এমন সব নীতিবিরুদ্ধ কাজে প্রবৃত্ত করতে পারে, যাকে সাধারণভাবে নৈতিকতার পরিপন্থী ভাবা হয় এবং তা জনগণের চারিত্রিক অধঃপতন ও লাম্পট্যের মতো ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে (ধারা-২)। অন্য সব ক্ষেত্রে হিকলিন টেস্ট অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কেউ অশ্লীল বার্তা প্রেরণ করলে তাকে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদন্ড বা ৫ কোটি অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে হবে (ধারা-৬৯)। এখানে ‘পর্নোগ্রাফি’ মানে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য; যা চলচ্চিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিক্স বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। এ সংজ্ঞামতে, ‘বুমেরাং’-এর মতো ওয়েব সিরিজগুলো ‘পর্নোগ্রাফি’র কাতারে পড়ে। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্টরা পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর আওতায় অপরাধের মাত্রানুযায়ী সর্বোচ্চ দুই থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ এক থেকে দুই লাখ টাকা অর্থদন্ডে  দন্ডিত হবে [ধারা-২, ৮]। উল্লেখ্য, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সালে পর্নোগ্রাফির অভিযোগে ‘নেশা’ নামক একটি মিউজিক ভিডিওর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে পর্নোগ্রাফি মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার নাজমুল আহসান। এ ধরনের মামলা বাংলাদেশে প্রথম।

 

সর্বশেষ খবর