শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পাখিটার গান এবং

ফরিদুর রেজা সাগর

পাখিটার গান এবং

টেলিভিশন চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠান চলছিল। শিল্পী- পাপিয়া সারোয়ার। রবীন্দ্রসংগীতের খ্যাতনামা শিল্পী। অনেক দিন টিভি চ্যানেলে পাপিয়া সারোয়ারকে দেখি না।

হঠাৎ তাঁকে দেখে মনে হলো যে- দেখি অনুষ্ঠানটা। জানলাম অনেক গান তিনি পরিবেশন করবেন এ অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানে পাপিয়া সারোয়ার বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যাঁরা শান্তিনিকেতনে গেছেন আমি হলাম প্রথম ছাত্রী।’

দীর্ঘদিনের কথা।

ফিরে এসে পাপিয়া সারোয়ার কত জনপ্রিয় শিল্পী তা প্রমাণ করলেন। রবীন্দ্রনাথকে পাপিয়া শ্রোতাদের কত কাছে নিয়ে গেছেন!

সেই কথা আমাদের আজকের বিষয় নয়। বলতেও চাই না সে কথা। তাহলে চর্বিতচর্বণ হয়ে যাবে সবার কাছে।

রবীন্দ্রসংগীতের বাইরেও পাপিয়া সারোয়ারের অন্য ধাঁচের কিছু গান সেই সময়ে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এটা খুব কম শিল্পীর ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। পাপিয়া সারোয়ারের যে দুটি গানের কথা শ্রোতাদের এখনো মনে আছে তার একটি- ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম’ আর অন্যটি হলো ‘পাপিয়া রে পাপিয়া’। পরের গানটি নিয়ে প্রায় ৩০ বছর আগের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ল। সেই ঘটনাটা একটু পরে বলি।

আলোচিত সেদিনের অনুষ্ঠানেও পাপিয়া সারোয়ার গান দুটি গাইলেন।

উপস্থাপক বললেন, ‘একসময় তিনি যে শুধু রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করতেন তা নয়, তিনি আধুনিক গানও গাইতেন।’

উপস্থাপক বলার পর হারমোনিয়াম ধরে পাপিয়া রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি ওই গান দুটিও পরিবেশন করলেন।

আজকাল টেলিভিশনের গানের অনুষ্ঠানে ‘ডিজল্ভ’ শব্দটা উঠেই গেছে।

দর্শক-শ্রোতার চোখে ধাক্কা না লাগে মসৃণভাবে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর ঘটানোটাই হলো ডিজল্ভ।

কিন্তু এই ব্যাপারটা উঠেই গেছে, এখন শুধু কাট টু কাট দেওয়া হয়। এর বাইরে কোনো কিছু সচরাচর ব্যবহার করা হয় না।

আমি জানি না কারণ।

হয়তো ব্যবহারের ব্যাকরণ পাল্টায়- এ জন্যই এ নিয়ম!

সেই বিতর্কেও না যাই। আমাদের লেখার বিষয়টাও তা নয়। বলতে চাই একেবারেই এক অন্য প্রসঙ্গ। সেটা হলো- পাপিয়া সারোয়ারের পরিবেশনায় এই যে গানের অনুষ্ঠানটি হচ্ছে, যা আমি দেখছি তাতে আধুনিক প্রযুক্তির অনেক সুবিধা, ধরন আর ঢং এসেছে।

আমার মনে আছে, আমরা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটা মিউজিক ভিডিও করেছিলাম। ভিডিওটিতে অনেক দৃশ্যের সমাহার ঘটেছিল।

গল্প সাজিয়ে সুশোভন চিত্রনাট্যের দৃশ্য দিয়ে গানটা করি।

দেখার পর টেলিভিশনের আইকন মোস্তফা মনোয়ার বলেছিলেন, ‘তুমি রবীন্দ্রনাথের গানে একি অবস্থা করেছ?’

আমি বললাম, ‘কেন স্যার? সেটা তো মিউজিক ভিডিও করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানে!!’

মোস্তফা মনোয়ার হেসে বললেন, ‘না, না, গান তো লোকে শুনবে চোখ বন্ধ করে! একটা আরাম কেদারায় বসে চোখ বুজে আধো জাগা, আধো ঘুমে গান তার কানে ঢুকবে। আর সেখানটায় তুমি এত তাড়াতাড়ি এত দৃশ্য এত ব্র্যাকগ্রাউন্ড চটাচট বদলে দেখাবে?!’

হয়তো তার সেই মন্তব্যের সঙ্গে আমার ধারণা মেলেনি।

এ রকম হতেই পারে। কারণ, ভালো লাগার ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। কারও কোনো নিরীক্ষা ভালো লাগবে। কারও লাগবে না!

আমি যে কথাটা আজকে বলতে চাচ্ছি সেটা হলো, বর্তমান টেলিভিশনের এত এত সুযোগ-সুবিধা, তরুণ প্রযোজকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং সৃজনশীলতা থাকা সত্ত্বেও সেই সময়ের রেকর্ডিংয়ের কলাকৌশল ও অভিনবত্বের মতো এখন কতটা পাচ্ছি।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে আজ থেকে ৩০ বছর আগে একটা অনুষ্ঠান হতো- যার নাম ‘মালঞ্চ’। 

অনুষ্ঠানটি ছিল একজন শিল্পীর একক গানের অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানটির প্রযোজক ছিলেন সদ্য প্রয়াত বরকত উল্লাহ।

নানা রকম ক্যারিশমা করতেন তিনি গানের মধ্যে।

শিল্পীকে কীভাবে উপস্থাপন করা যায় টেলিভিশনের সামনে।

একই প্রোগ্রাম নিয়ে অনেক রকম ব্যস্ত থাকতেন বরকত উল্লাহ।

অভিনব সব ব্যাপার-স্যাপার ঘটে যেত।

একবার বরকত উল্লাহ বিদেশে গেলেন অথবা অসুস্থ হলেন।

অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পড়ল প্রযোজক আলী ইমামের কাছে। আলী ইমামের পেছনে তখন আমি, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন- আমরা সবাই।

আলী ইমাম বললেন, এত বড় অনুষ্ঠান!

কী করা যায়?

আমরা সবাই তখন নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত। সময়ও কম।

অনুষ্ঠান করা লাগবে।

রবীন্দ্রসংগীত থাকলে পাপিয়া সারোয়ার গাইবেন।

কিন্তু এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতের বাইরেও পাপিয়া সারোয়ার পরিবেশন করবেন, ‘পাপিয়া রে পাপিয়া’।

আলী ইমাম বললেন, কী করা যায় এখানে?

রুস্তম আলী বলে একজন লোক ছিলেন বিটিভিতে। যিনি সব প্রপস সাপ্লাই দিতেন। লোকজন বলত, ‘রুস্তম আলীর কাছে যদি বাঘের চোখ চাওয়া যায় তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

রুস্তম আলীকে রিকুইজিশন দেওয়া হলো, ‘ওই গানে বড় একটা আয়না দরকার।’ রেকর্ডিংয়ের সন্ধ্যায় বলা হলো।

রুস্তম আলী আগুন! সে বলল ‘এই সময়ে, এত চটজলদি কোত্থেকে আয়না জোগাড় হবে?’

রাগলেও যত বলা হোক, অনুষ্ঠানের প্রতি সবার সঙ্গে ভালোবাসাও ছিল অটুট।

টিমওয়ার্ক ছাড়া টিভি অনুষ্ঠান ভালো করা যায় না।

পরে জেনেছি রুস্তম আলী নিজের বাড়ি থেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়না খুলে এনে সেটে দিয়েছিলেন।

আয়না যথারীতি সেটে লাগিয়ে দেওয়া হলো।

প্রযোজক আলী ইমাম শট ধরলেন। আয়নায় এক পাপিয়া, সেটে আরেকজন পাপিয়া।

দুজন পাপিয়া সারোয়ার মুখোমুখি দাঁড়ানো।

তখন প্রযুক্তিগত সুবিধা নেই।

আয়নার সামনে দাঁড়ানো দুজন পাপিয়া সারোয়ারের রূপ ফুটে উঠতে দেখা গেল।

গান হিট।

দর্শকের কাছে গান হিটের বড় রকম কারণ ছিল, এই আকর্ষণীয় পরিবেশনা।

এই অভিনবত্ব মনে করিয়ে দিল, আজ থেকে ৩০ বছর আগের সেই সৃজনশীলতার কথা!

হিট গানটি আজও দর্শক-শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে।

এত আধুনিকতা আর অভিনবত্ব- আমরা কি জানি এখন আর!?

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর