মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

নৃত্যশিল্পীরা বিপাকে, করছেন বিকল্প চিন্তা

নৃত্যশিল্পীরা বিপাকে, করছেন বিকল্প চিন্তা

সারা বিশ্ব আজ থমকে গেছে। পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও হয়ে পড়েছে গৃহবন্দী। এক অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলায় থমকে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিল্পীদের যাবতীয় অনুষ্ঠান। সংগীত, নাটক, নৃত্যচর্চাও বেশ সংকটে আছে। পেশাদার ও নবীন নৃত্যশিল্পীরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিশেষত শিল্পীদের একটি অনিশ্চয়তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। তারা জীবন ধারণের জন্য করছেন বিকল্প চিন্তা। এই অনিশ্চয়তার শেষ কোথায় তা আদৌ জানা নেই। নৃত্যশিল্পীদের এমন দুরবস্থা নিয়ে বিভিন্ন গুণী নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

এখন তো বেঁচে থাকাটাই বড় বিষয়

মুনমুন আহমেদ

প্যান্ডোমিকের শুরু থেকেই মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকার জন্য বিনা পয়সায় অনলাইন প্ল্যাটফরমে নৃত্যবিষয়ক কিছু অনুষ্ঠান করছি। ‘রেওয়াজ পারফরমার্স স্কুল’র ব্যানারে শিক্ষার্থীরা সরাসরি তালিম নিচ্ছে আমার কাছ থেকে। অনলাইনেই হচ্ছে নৃত্যশিক্ষা, নৃত্যচর্চা। আড্ডায় নৃত্যগুরুরা রয়েছেন, তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি ‘নৃত্যের নেপথ্যে’ অনুষ্ঠানে। মূলত নবীনদের জন্যই এই আয়োজন। তবে কোনো স্পন্সর নেই। বিনা পয়সায় পরিশ্রম করে ৮টি শো করেছি। অন্যদিকে যারা শিখতে আসছে তাদের রয়েছে আর্থিক সংকট। অনেক কষ্ট করে তারা নেট কিনে সংযুক্ত হচ্ছে। এদিকে নৃত্যশিল্পীদের বিকল্প চিন্তা তো করতেই হচ্ছে। এখন বেঁচে থাকাটাই বড় বিষয়। এই বিকল্প চিন্তাকে সম্মান করি। আর এককালীন কিছু টাকা দিয়ে তো কিছুই হয় না। কে কাকে সাহায্য করবে? সবাই আছে ক্রাইসিসে। তাই যে যেভাবে পারছে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আমিও মানসিকভাবে খুবই আপসেট। আমার রেস্টুরেন্ট ‘মুনমুন কিচেন’র ভাড়া অনেক। মনে হয় ছেড়েই দিতে হবে এই অবস্থা চলতে থাকলে। তবুও স্বপ্ন দেখি, এক সময় অন্ধকার কেটে যাবে।

 

অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছেন

শিবলী মোহাম্মদ

চারদিকের খারাপ অবস্থা দেখে মনটা কেঁদে ওঠে। অনেকেই অনাহারে আছে। করোনার দুর্যোগে বহু মানুষ ঘরে বসে গেছে, ঘরে বসে আছেন শিল্পীরাও। আমাদের নৃত্যাঞ্চলের ছেলে-মেয়েরা খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বাঁচার তাগিদে অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছেন। নৃত্যশিল্পীদের অনেকেই সবজি বিক্রি করছেন, অনলাইনে বুটিকস ব্যবসা খুলেছেন, খাবার বিক্রি করছেন। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। এক সময় তারা আমাদের আনন্দ দিয়েছেন। এখন তাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। আমাদের উচিত দরিদ্র, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো। পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবারও টাকা রোজগার করা যাবে। অর্থ আঁকড়ে থাকার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষের এত টাকা, তবুও অনেকে তাদের জন্য কিছুই করছে না। যাদের টাকা আছে তাদের বিবেক কি এই সময়ে জাগ্রত হবে না? আমি চাই মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। মানুষের মন উদার হবে, বিবেক জাগ্রত হবে। অভাব ও ক্ষুধার যন্ত্রণা যারা বুঝে, তারা মানুষের প্রকৃত যন্ত্রণা বুঝে। এত অর্থ-সম্পদ কিন্তু একা ভোগের জন্য নয়; সবারই অধিকার আছে।

 

নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে

শামীম আরা নীপা

এমন একটা খারাপ সময় আসবে তা কেউ কোনো দিন চিন্তায় করেনি। এ দেশে তো নৃত্যের সার্বিক অবস্থা ভালোই ছিল। নৃত্যে অংশগ্রহণ করে অনেকেই টিকেছিল। স্টেজ শো, টিভি শো করে ছেলে-মেয়েদের চলত। তবে এখন পরিস্থিতি উল্টো, সব স্থবির। ছেলেদের তো সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়, তারা এখন বেকার বসে আছে। অনেকেই করছে বিকল্প চিন্তা। নাচ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে অন্য কাজে ইনভলব হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কি টিকে থাকা যায়? আমরা তো জীবনে অন্য কিছু করিনি। শুধুই নাচ করেছি। সময় অনুকূলে ছিল বলে আজ আমরা একটা ভালো অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছি। কিন্তু যারা কেবল শুরু করেছে নাচকে ভালোবেসে, তাদের এ অবস্থা দেখলে নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে। খুবই কষ্ট হয়। আর এককালীন সাহায্য যে সবাই পাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। এভাবে টিকে থাকা যায় না। অনেকেই ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া, খাবার সংস্থান করতে না পেরে। অনেকেই অনলাইনে বিকল্প চিন্তা করছেন। কিন্তু এটা ক্ষণস্থায়ী চিন্তা। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা টিকে থাকবে, তবে নতুনদের জন্য টিকে থাকা খুবই কষ্টের। কিন্তু আমি আশাবাদী। এক দিন নতুন আলোর ভোর আসবেই।

 

শিল্পকলাকেই এগিয়ে আসতে হবে

আনিসুল ইসলাম হিরু

নৃত্যশিল্পীরা সত্যিই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে এখনই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু এই স্বল্প অনুদান দিয়ে কাজ হবে না। কাজের বিনিময়ে খাদ্য চালু রাখতে হবে। এক্ষেত্রে শিল্পকলাকেই বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিল্পীকে এ দুঃসময়ে প্রমোট করতে হবে। সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে শিল্পকলাই পারে মাধ্যম হিসেবে সরাসরি যোগাযোগ করতে। প্যান্ডোমিক কমে গেছে। শিল্পকলা এই মুহূর্তে নন্দনমঞ্চে অনুষ্ঠান করে, বাইরের প্রোগ্রামে নৃত্যশিল্পীকে প্রমোট করে নৃত্যের মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আমরা সৃষ্টি থেকে যতটুকু সম্ভব শিল্পীদের জন্য করছি। কিন্তু এটা আর কতদিন? দেশের বড় বড় কোম্পানি, করপোরেট লোকজন যদি এগিয়ে আসত তবে শিল্পীরা বাঁচত। দুটি মাধ্যম এ ব্যাপারে হেল্প করতে পারে-মঞ্চ ও টিভি। অনলাইনে প্রোগ্রাম তো হচ্ছে বিনা পয়সায়। শিল্পকলারও একটা পেজ আছে। তারাও পারে কিছু সম্মানীর বিনিময়ে নৃত্যশিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান করতে। অনুদান কতদিন দেবে, আর শিল্পীরা কতদিন চাইবে! হাতিরঝিলে মঞ্চ খুলে দিয়ে কিছু অনুষ্ঠান করলেও তো শিল্পীরা সমৃদ্ধ হতো।

 

প্রয়োজন কাজের ক্ষেত্র বাড়ানো

ওয়ার্দা রিহাব

নৃত্যশিল্পীরা ভালো নেই। যে যেভাবে পারছে বেঁচে থাকতে বিকল্প চিন্তা করছে। সিনিয়র শিল্পীরা তো একপ্রকার আছেন, তবে বেশি সমস্যায় রয়েছে নতুন নৃত্যশিল্পীরা। তারা টিকে থাকতে অনলাইনে খাবার ডেলিভারি, বুটিকস বিজনেস, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছে। তবে যারা নাচকে পেশা হিসেবে নিয়েছে, তারা পড়েছে বিপাকে। যদিও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা নৃত্যশিল্পীদের এককালীন কিছু অর্থ প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে প্রশ্ন, সেটা কতটা কার্যকরী? আমি মনে করি নৃত্যশিল্পীদের প্রয়োজন কাজের ক্ষেত্র বাড়ানো। শুরু হতে পারে সেটা স্বল্প পরিসরে। এখন নাচের শিল্পীরা অনলাইনে বিনা পয়সায় অংশগ্রহণ করছেন। আমিও করছি মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকার জন্য। তবে যারা অনলাইনে ক্লাস নিতে পারছে না, তারা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। জীবন বাঁচাতে বিকল্প চিন্তা করছে। তাদের এই উদ্যোগকে আমি রেসপেক্ট করি।

তবে এ পরিস্থিতিতে সরকার, শিল্পকলাসহ মিডিয়ার সাপোর্ট খুবই জরুরি। পাঁচ মাস তো পেরোল, শিল্পকলার মঞ্চ খুলছে; নৃত্যশিল্পীদেরও শুরু করতে হবে।

 

 

সর্বশেষ খবর