মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ছবি চলবে কোথায়

পাশের দেশ ভারতে ‘নেটফ্লিক্স’, ‘অ্যামাজন’ এবং ‘জি ফাইভ’-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফরম থাকলেও আমাদের দেশে একটিও নেই। আমাদের এই পিছিয়ে থাকার মানসিকতার কারণে ‘সিনেমা চলবে কোথায়’ এবং ‘বিনিয়োগকৃত অর্থ’ ফেরত আসবে কীভাবে? এই দুশ্চিন্তায় নির্মাতারা ক্রমেই হতাশ হয়ে চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়ছেন

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবি চলবে কোথায়

চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ৭টি সিনেমা হলের মধ্যে দুটি

‘সিনেমা চলবে কোথায়?’ এই প্রশ্ন এখন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। নির্মাতারা বলছেন, এই প্রশ্নের আড়ালে কারণ একাধিক। এর মধ্যে ‘সিনেমা হলের সংখ্যা হ্রাস’ একটি পুরনো বিষয় হলেও একশরও কম সিনেমা হল নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে সেই ছবি হবে স্বল্প বাজেটের। আর স্বল্প বাজেটের ছবির মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই ছবি দেখবে কে? প্রতিবেশী দেশ ভারতেই এখন কয়েকশ কোটি টাকায় একটি ছবি নির্মাণ হয়। আর আমাদের দেশে নির্মাতারা ১ কোটি টাকা বাজেটের ছবি নির্মাণ করার সাহস পান না। কারণ সিনেমা হলের স্বল্পতার কারণে মুনাফা দূরে থাক, মূল টাকাই ফেরত আনা সম্ভব নয়। তাহলে লোকসান গুনে ব্যবসা করতে আসবে কে? সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবরে জানা গেছে, চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে ৭টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু কাপ্তাই নয়, দেশের প্রায় ৩০ জেলা এখন সিনেমা হলশূন্য। ইতিমধ্যে সরকার সিনেমা হল সংস্কারের জন্য ৭০০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে বলে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি সূত্রে জানা গেছে।

চলচ্চিত্রকারদের প্রশ্ন, এই টাকার যথাযথ ব্যবহার হবে তো? এ সন্দেহের পেছনে কারণ হলো সরকারি টাকার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই যথার্থ মনিটরিং বা নীতিমালা থাকে না। থাকলেও নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে সরকারি টাকা লুটের মহাউৎসব শুরু হয়। নির্মাতাদের কথায় এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান এবং এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য সরকার প্রদত্ত অর্থ। সরকারি অনুদান প্রদান শুরুর দীর্ঘ বছর পেরিয়ে গেলেও অনুদানপ্রাপ্ত সিংহভাগ ছবি নির্মাণ হয়নি। আর যেগুলো নির্মাণ হয়েছে তার মধ্যে ‘টাকা মেরে দেওয়ায়’ স্বল্প অর্থে কোনোভাবে নির্মিত ছবিগুলো নাটকও হয়নি। অন্যদিকে এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য বেশ কয়েক বছর আগে সরকারের দেওয়া প্রায় ৫৯ কোটি টাকা নিয়ে ‘নয়ছয়’ হওয়ার কারণে এফডিসি আর পরিপাটি হয়নি। ‘নয়ছয়’ করার পরও সময়মতো কাজ শেষ না করায় বারবার সরকারের কাছে ফেরত গেছে এই প্রকল্পের অর্থ। চলচ্চিত্রকারদের কথায়, সিনেমা হল সংস্কারের জন্য ৭০০ কোটি টাকা পাওয়ার আগেই এর ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে হিসাবনিকাশও শুরু হয়ে গেছে। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, ‘এতে সিনেমা হল সংস্কারের টাকা নিয়ে উৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই।’

অনেক প্রদর্শক ইতিমধ্যে পরিকল্পনায় মেতেছেন সিনেমা হল সংস্কার হলে প্রথমেই কীভাবে বিদেশি ছবি আমদানি করা যায়। মানে দেশি ছবির সুদিন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাদের কোনো মমত্ববোধ নেই। এতে করে এখন যারা ছবি নির্মাণ করছেন তাদের আশঙ্কা হলো এসব ছবি তারা কোথায় চালাবেন। কারণ উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বঙ্গবন্ধুর নিষেধাজ্ঞা এবং আইনগতভাবে এটি নিষিদ্ধ থাকার পরও বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে দেশি ছবির পরিবর্তে বিদেশি ছবি প্রদর্শনের হিসাবনিকাশ করতে শুরু করেছেন প্রদর্শকরা। ছবি ব্যবসার প্রধান মৌসুম হলো উৎসবের দিনগুলো। আর এই দিনে বিদেশি ছবি চললে দেশীয় নির্মাতারা একেবারেই মাঠে মারা পড়বেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্রকাররা।

চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, বিশ্ব প্রতিনিয়ত আধুনিকতার পথে হাঁটছে। আর আমরা পুরনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে পড়ে আছি। এর পেছনে অবশ্যই স্বার্থান্বেষী মহলের হাত রয়েছে। বিশ্বে এখন ছবি নির্মাণ করে অর্থ ফেরত আনার প্রধান তিনটি খাত হলো যথাক্রমে ‘সিনেমা হল’, ‘অনলাইন প্ল্যাটফরম’ এবং ‘টেলিভিশন চ্যানেল’। এখন বিশ্বে ছবি দেখার মাধ্যম বেড়ে যাওয়ায় সবাই আর সিনেমা হলে যায় না। তাই প্রথমে সিনেমা হলে ছবি মুক্তির পর সেটি পর্যায়ক্রমে অনলাইন এবং টিভি চ্যানেলে দেওয়া হলে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা নিশ্চিতভাবে লাভের মুখ দেখবেন এবং ছবি নির্মাণের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। পরিতাপের বিষয় হলো, পাশের দেশ ভারতে ‘নেটফ্লিক্স’, ‘অ্যামাজন’ এবং ‘জি ফাইভ’-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফরম থাকলেও আমাদের দেশে একটিও নেই। আমাদের এই পিছিয়ে থাকার মানসিকতার কারণে ‘সিনেমা চলবে কোথায়’ এবং ‘বিনিয়োগকৃত অর্থ’ ফেরত আসবে কীভাবে? এই দুশ্চিন্তায় নির্মাতারা ক্রমেই হতাশ হয়ে চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়ছেন। একই সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্পী, কলাকুশলীরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে হতাশার অন্ধকারে ডুবছেন।

চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায়, ‘চলচ্চিত্র হলো একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিনোদনের পাশাপাশি দেশ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর বাণী ও চিত্র তুলে ধরা হয়, আপন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচয় ঘটানো যায়। চলচ্চিত্র না থাকলে মানুষ বিনোদন ও বাণীর অভাবে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং দেশীয় চলচ্চিত্র বাঁচাতে সরকারকে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর