একসময় পারিবারিক নাটকের জোয়ার বেশি ছিল। সেসব নাটকে প্রধান অভিনেতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানতালে অভিনয় করতেন পার্শ্বচরিত্রের শিল্পীরা। তারা মূল চরিত্রকে বেগবান করতেন। এখনকার বেশির ভাগ নাটক দেখলে মনে হয়, পৃথিবীতে শুধু দুজনই বাস করে। আশপাশে আর কেউ নেই। নাটকে ক্রমেই পার্শ্বচরিত্রের অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে। দেশীয় নাটকের পালাবদলে সেই সহ-অভিনেতাদের নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল
অনেকে বলেন পার্শ্বচরিত্র বলতে তেমন কিছু নেই। কিন্তু নাটকের টার্মের খাতিরে হলেও নাটকবোদ্ধাকে এটা স্বীকার করে নিতেই হবে। পারিবারিক নাটকের ক্ষেত্রে পূর্বে যা হতো, ফুল ফ্রেম ভর্তি অভিনয়শিল্পী থাকতেন। যা এ সময় একেবারে নেই বললেই চলে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে কুত্তাওয়ালি রেবেকা ম্যাডামের পক্ষের উকিলের কথা মনে আছে? যার বুদ্ধির কারণে বদি বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়েছিল! শেষ পর্যন্ত বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয় যে উকিলের কারণে তিনি হলেন আশি-নব্বই দশকের শোবিজ জগতের অতি পরিচিত মুখ অভিনেতা আবুল খায়ের। ‘আজ রবিবার’ নাটকে দাদার চরিত্রে অভিনয় করেও তিনি সবার মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। ‘তাইলে আমি ওষুদ বানামু কি দিয়া, মানুষ বাঁচব ক্যামনে, গাছ অইল অক্সিজেন ফ্যাক্টরি, আল্লাহর দেওয়া দান আমগো জীবন।’- বিটিভির জনসচেতনতামূলক নাটকে তার এই সংলাপটি বেশ বিখ্যাত হয়। সে সময় প্রতিটি নাটকে সহ-অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করে দর্শক মুগ্ধ করেছেন। একসময় নাটকের চিত্রনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন পার্শ্বচরিত্ররা। পর্দায় দাপুটে অভিনয় করে দর্শক নজর নিজের দিকে টেনে নিয়ে গেছেন তারা। সে সময় পার্শ্বচরিত্র করে ছোট পর্দা কাঁপিয়েছেন খলিল, মোজাম্মেল হক, আমিরুল হক চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, মিরানা জামান, আরিফুল হক, মাহমুদা খাতুন, মিনু রহমান, নাজমা আনোয়ার, সালেহ্ আহমেদ, গোলাম হাবিবুর রহমান মধু, রওশন আরা, জামাল উদ্দিন হোসেন, চ্যালেঞ্জার, মাসুদ আলী খান, ইনাম আহমেদ, সাজ্জাদ মাহমুদ, নরেশ ভূঁইয়া, মজিবুর রহমান দিলু, জহির উদ্দিন পিয়ার, এস এম মহসিন, কেরামত মওলা, আবদুল কাদের, আফজাল শরীফ, আবদুল আজিজ, আহসানুল হক মিনু, শবনম পারভীন, সিতারা বেগম প্রমুখ। অনেকে বলেন পার্শ্বচরিত্র বলতে তেমন কিছু নেই। কিন্তু নাটকের টার্মের খাতিরে হলেও নাটকবোদ্ধাকে এটা স্বীকার করে নিতেই হবে। পারিবারিক নাটকের ক্ষেত্রে পূর্বে যা হতো, ফুল ফ্রেম ভর্তি অভিনয়শিল্পী থাকতেন। যা এ সময় একেবারে নেই বললেই চলে। ‘বহুব্রীহি’ নাটকে কাজের বুয়া রহিমার মা চরিত্রে মাহমুদা খাতুন আর কাজের ছেলে কাদের চরিত্রে আফজাল শরীফ যেন ছিলেন বিনোদনের প্রাণ। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের সহযোগী বদি চরিত্রে আবদুল কাদের এবং মজনু চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জের অভিনয় এখনো মানুষ মনে রেখেছে। ‘অয়োময়’ নাটকের ছোট মির্জার লাঠিয়াল হানিফের চরিত্রের মধ্য দিয়েই ছোট পর্দায় মোজাম্মেল হকের আসন পোক্ত হয়। ছোট মির্জার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই হানিফের কেশে নেওয়ার ভঙ্গিটি বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই সময় ‘খাদক’ নাটকের খাদক চরিত্রে অভিনয় করেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে সুবর্ণার মামা চরিত্রসহ হুমায়ূন আহমেদের নাটক মানেই ছিলেন মোজাম্মেল হক। টেলিভিশনের শক্তিমান অভিনেতা মমতাজউদ্দিন আহমেদকে নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ নাটকে দেখা গেছে। তবে শঙ্খনীল কারাগারের বাবার চরিত্রেই দর্শক দীর্ঘদিন তাকে মনে রাখবেন। শিলা আহমেদ অভিনয় ছেড়েছেন বহুদিন। হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে হলেও চরিত্র আর অভিনয়ের কারণেই দর্শক আজো তাকে মিস করেন। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বাঁধা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। পেয়েছেন অসম্ভব জনপ্রিয়তা। আজ রবিবারের তিতলী কিংবা কোথাও কেউ নেইতে মিমির ছোট বোন, সবটায়ই দারুণ অভিনয় করতেন তিনি। আগুনের পরশমণিতে যেমন অভিনয় করেছেন অসাধারণ, তেমনি নিম ফুল নাটকে তার একলার অভিনয় ছিল উপভোগ করার মতো। হুমায়ূন আহমেদ যে কজন অভিনেতার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম দুজন ছিলেন সালেহ্ আহমেদ ও চ্যালেঞ্জার। সব চরিত্রেও তাদের সাবলীল অভিনয় মনে রাখার মতো।
হুমায়ূন আহমেদ ডা. এজাজুল ইসলামকে ভিন্ন আঙিনা থেকে এনে একের পর এক দুর্দান্ত চরিত্রে অভিনয় করিয়ে দর্শকের হৃদয়ে বসিয়ে দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ যত কাজ করেছেন তার পঁচানব্বই শতাংশ নাটক-সিনেমায়ই ডা. এজাজ, ফারুক আহমেদ ও স্বাধীন খসরুর অসাধারণ উপস্থিতি রয়েছে। অন্যদিকে পার্শ্বচরিত্রে শক্তিমান অভিনেত্রী হিসেবে বলা যায় শামীমা নাজনীন, মনিরা মিঠু ও হোসনে আরা পুতুলের নাম। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় যে কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য ছিল ভিন্ন মাত্রার এক অভিজ্ঞতা। বহু তারকার জন্ম হয়েছে তার নাটকে অভিনয় করে। তিনি হাতে ধরে তুলেছেন অনেক অভিনয়শিল্পীকেই। এসব চরিত্রের সংলাপগুলো একসময় আওড়েছে জনগণ। চরিত্রগুলোও সময় পেরিয়ে দর্শকপ্রিয়তার নতুন নতুন নজির তৈরি করেছে। এসব চরিত্রে অভিনয় করেই ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী হয়ে গেছেন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী।
তবে প্যাকেজ নাটক-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর আবির্ভাব হয়েছে। তারা সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। তবে এই দুঃসময়ের মধ্যেই নিজ প্রতিভাগুণে পার্শ্বচরিত্র করে কেউ কেউ চলে এসেছেন লাইমলাইটে। তাদের অভিনয় দর্শক পছন্দ করছে। ভিউয়ের সময়ে তারা নতুন-পুরনো নির্মাতাদের কাজ করে কিছুটা হলেও দর্শককে মুগ্ধ করছেন। এ সময় বহুদিন ধরে যারা পার্শ্বচরিত্র করে নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বৃন্দাবন দাস, বড়দা মিঠু, শহীদুল্লাহ সবুজ, প্রাণ রায়, আরফান আহমেদ, মুকিত জাকারিয়া, আনন্দ খালিদ, শামীম জামান, জিয়াউল হক পলাশ, ফখরুল বাশার মাসুম, মিলি বাশার, শামিম হাসান সরকার, সিদ্দিকুর রহমান, চাষী আলম, শিশুশিল্পী আরিয়া অরিত্রা, এ কে আজাদ সেতু, জামিল হাসান, এম এন ইউ রাজু, সুজাত শিমুল, মুকুল সিরাজ, তারিক স্বপন, নীলা ইসলাম, সুমন পাটোয়ারী, সিয়াম নাসির, তানজিম অনিক প্রমুখ।
নাটক বা ধারাবাহিক শুধু দুজন শিল্পীর খাতিরেই হিট হয় না; তার পেছনে রয়েছে পার্শ্বচরিত্রগুলোর অসামান্য অবদান। তবে ইদানীং পার্শ্বচরিত্রে কেবল নামকাওয়াস্তে কাউকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নাটকের মান ক্রমশ দুর্বল করা ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না।