শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

জমে উঠছে সংস্কৃতি অঙ্গন

জমে উঠছে সংস্কৃতি অঙ্গন

ফের সচল হয়ে উঠছে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন। করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যম ও নব-আনন্দে নিজ ভুবন আলোকিত করতে ফিরছেন সংস্কৃতিশিল্পীরা। আস্তে আস্তে হয়তোবা আগের সেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে সংস্কৃতি জগতে, সেই অপেক্ষায় সবাই। সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

কভিড-১৯ এর কারণে সারা বিশ্ব আজ থমকে গেছে। সমগ্র বিশ্বের মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও হয়ে পড়েছে গৃহবন্দী। এক অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে থমকে গেছে সংস্কৃতিশিল্পীদের যাবতীয় অনুষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনুশীলন ও পরিবেশনার ক্ষেত্রগুলো। এতে পেশাদার ও নবীন শিল্পীরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিশেষত শিল্পীদের একটি অনিশ্চয়তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। জীবন ধারণের জন্য তারা দীর্ঘদিন করেছেন বিকল্প চিন্তা। তবে এই হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন সবাই। ফিরছেন আলোর পানে, নবউদ্যমে। করোনার মাঝেও নীরবতা ভেঙে ক্রমশ সচল হয়ে উঠছে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন। সেই চিরচেনা জৌলুসে ফিরতে চলেছে সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন মাধ্যম। দীর্ঘদিন থেমে থাকা নাট্যমঞ্চ, যাত্রা, নৃত্য, আবৃত্তি আর চিত্র প্রদর্শনীর জগৎ ব্যস্ত হতে চলেছে। চলছে চর্চা, পরিকল্পনা ও পরিবেশনার উদ্যোগ।

 

থিয়েটার অঙ্গন

ফের প্রাণ ফিরে পাওয়ার আভাস মিলছে মঞ্চপাড়ায়। ছুটির দিনের সন্ধ্যায় আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশের মঞ্চগুলো। নাটক প্রদর্শনীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন নাটকের দলগুলো। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় ছয় মাস বন্ধ ছিল থিয়েটার কার্যক্রম ও প্রদর্শনী। তবে সরকারি নতুন নির্দেশনা না এলেও স্বাস্থ্যবিধির শর্তারোপ মেনেই গত ২৮ সেপ্টেম্বর মহিলা সমিতি মিলনায়তনে শূন্যন রেপার্টরি প্রযোজিত ‘লালজমিন’ প্রদর্শনী করেন মোমেনা চৌধুরী নিজেই। এই নাটকটির আরও কয়েকটি প্রদর্শনী হয় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। নাটকটি লিখেছেন মান্নান হীরা ও নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। মোমেনা চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি, এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নয়। আমাদের আরও বহুদিন করোনা নিয়ে বাঁচতে হবে। তাই নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে।’ মূলত, এ নাটকের মাধ্যমেই করোনার বিরুদ্ধে অন্যরকম লড়াইয়ে নেমেছেন মঞ্চকর্মীরা।’ লালজমিনের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে করোনা-পরবর্তী সময় শুরু হয় নাটক মঞ্চায়ন স্রোতধারা। নাট্যদল ‘প্রাচ্যনাট’ অভিনব এক ভাবনা নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছে। সাপ্তাহিক দুই ছুটির দিনকে কেন্দ্র করেই ৪ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুরু করেছে মাসব্যাপী ‘মহলা মগন’ উঠান নাটকের মেলা।’ ‘অবসাদবিরুদ্ধ স্রোত’ স্লোগান নিয়ে মাসব্যাপী এ আয়োজন চলছে কাঁটাবনের প্রাচ্যনাটের নিজস্ব মহড়া কক্ষে। পাঁচটি নাটক দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রাচ্যনাটের এ ভিন্নধর্মী আয়োজনটি। এ উঠান নাট্যোৎসবে উদ্বোধনী সন্ধ্যা থেকে শুরু করে পরপর দুই সন্ধ্যায় শুক্রবার ও শনিবার মঞ্চস্থ হয় ’দ্য জু স্টোরি’। অ্যাডওয়ার্ড অ্যালবির লেখা থেকে এ নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেন আশফাকুল আশেকীন। নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। এ ছাড়া গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় ‘দ্য ডাম্ব ওয়েটার’। হ্যারল্ড পিন্টারের রচনা থেকে এটি অনুবাদ করেছেন রবিউল আলম এবং নির্দেশনা দিয়েছেন মো. শওকত হোসেন সজীব। ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় ‘হানড্রেড বাই হানড্রেড’। এটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন সাইফুল জার্নাল। একইভাবে ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস অবলম্বনে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ নাটকটি। এটির নাট্যরূপ দিয়েছেন মো. শওকত হোসেন সজীব। নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। আজ ও কাল সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হবে ‘ফাউস্ট অথবা অন্য কেউ’। গ্যোটের শ্রুতিনাট্য ‘ফাউস্ট’ অবলম্বনে এটি তৈরি করা হয়েছে। নাটকটির তত্ত্বাবধানে আছেন তানজিকুন। ঢাকা থিয়েটার ও দেশনাটক যৌথভাবে নতুন একটি নাটক মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নাটকের নাম ‘পেন্ডুলাম’। মাসুম রেজার রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিচ্ছেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। অনলাইনে প্রায় দুই মাস ধরে নাটকটির মহড়া চলছে। তবে শিল্পকলা মঞ্চায়নের অনুমতি দিলেই এ নাটকটি মঞ্চে আসবে। গত ১১ সেপ্টেম্বর মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় জাগরণী থিয়েটারের নাটক ‘রাজার চিঠি’। ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চায়িত হয় নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর নাটক ‘আওরঙ্গজেব’। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের রচনায় এ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন অনন্ত হীরা। আগামী ৩০ অক্টোবর এ দলটি মঞ্চে প্রদর্শন করবে তাদের ১২তম প্রযোজনা নাটক ‘কনডেমসেল’। চলতি বছরই প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চে আনছে আরও দুটি নতুন নাটক। এর একটির নাম ‘মেজর’। এর রচনা ও নির্দেশনা দিচ্ছেন অনন্ত হীরা। অন্যটি অনন্ত হীরার রচনা ও নুনা আফরোজের নির্দেশনায় নাটক ‘পতাকা পাগল’। মান্নান হীরার রচনায় ‘ইনডেমনিটি’ নাটকটি সারা দেশে মঞ্চস্থ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে দেশজুড়ে মঞ্চস্থ হবে এই নাটক। আরণ্যক নতুনদের নিয়ে নতুন নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত রয়েছে। এদিকে অনলাইনে নিজেদের কার্যক্রম সচল রেখেছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, বাতিঘর, মণিপুরী থিয়েটার, লোকনাট্যদল, থিয়েটার, নাগরিক নাট্যাঙ্গনসহ বেশির ভাগ নাট্যদল।

 

নৃত্যাঙ্গন

অন্যান্য অঙ্গনের মতো নৃত্যাঙ্গনও মুখর হচ্ছে। চলছে অনুশীলন, পরিকল্পনা, অনলাইন ওয়ার্কশপ, অনলাইনে নৃত্য প্রদর্শন। প্যান্ডোমিকের শুরু থেকেই মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকার জন্য বিনা পয়সায় অনলাইন প্ল্যাটফরমে নৃত্যবিষয়ক কিছু অনুষ্ঠান করেন নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ। ‘রেওয়াজ পারফরমার্স স্কুল’-এর ব্যানারে কত্থক নৃত্যের মূলধারায় শিক্ষার্থীরা সরাসরি তার কাছ থেকে নিয়মিত তালিম নিচ্ছে। অনলাইনেই হচ্ছে নৃত্যশিক্ষা, নৃত্যচর্চা। তবে নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ, শামীম আরা নীপা আর লায়লা হাসান এখনো তেমনভাবে শুরু করেননি নৃত্য নিয়ে আয়োজন। হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও ফিরবেন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে। মণিপুরী নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাব নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। মাঝে তিনি মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকার জন্য অনলাইনে বিনা পয়সায় অনুষ্ঠান করেছেন। তবে সম্প্রতি তার ধৃতি নর্তনালয়ের নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে কিছু অনুষ্ঠান করেছেন। বিটিভিতে নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করেছেন। নৃত্যশিল্পী আনিসুল ইসলাম হিরু ও তার সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার করোনার মধ্যেও হয়েছেন সচল। শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়েও এসেছেন। শিল্পীরা অলস হয়ে যাবে সৃষ্টির উদ্যোগে প্রথম ক্লাস শুরু করেছেন তিনি। শিল্পকলাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নৃত্যশিল্পীরাও অনলাইনে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। নিয়মিতভাবেই লেকচার ওয়ার্কশপের আয়োজন করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

 

আবৃত্তি অঙ্গন

এই করোনাকালীনে সংস্কৃতি জগতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সচল ছিলেন দেশের আবৃত্তিশিল্পীরা। তারা নিয়মিত অনলাইনে করেছেন আবৃত্তি আয়োজন। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের আয়োজনে সারা দেশের আবৃত্তিশিল্পীদের অংশগ্রহণে হয় অনলাইনভিত্তিক আবৃত্তি অনুষ্ঠান। এছাড়াও দেশের প্রথিতযশা আবৃত্তিশিল্পী, বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরম, জাতীয় ও আঞ্চলিক আবৃত্তি সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে শিল্পীদের উদ্যোগে হয়েছে বিভিন্ন আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন। চলতি মাসে সরাসরিও কিছু অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন বিভিন্ন দলের আবৃত্তিশিল্পীরা।

 

যাত্রাশিল্প

মূলত দুর্গাপূজার সময়কালটিই হলো যাত্রা মঞ্চায়নের মৌসুম। তবে যাত্রাশিল্প এখন চরম সংকটে রয়েছে। অস্তিত্ব সংকটে যাত্রাপালা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে নিবন্ধন পেয়েছে ১১৭টি যাত্রা সংগঠন। এর মধ্যে কিছু দল নিবন্ধন নবায়ন করেনি। আর ৪টি দল-ভোলানাথ, চৈতালি, ডায়মন্ড ও স্বদেশ অপেরার অশ্লীল যাত্রা মঞ্চায়নের কারণে নিবন্ধন বাতিল করেছে শিল্পকলা একাডেমি। যাত্রাপালার মৌসুম অক্টোবরে শুরু। সীমিত পরিসরে যাতে নির্ধারিত সময় রাত ১১টা পর্যন্ত যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করা যায় সরকারের কাছে সেটিই চাওয়া যাত্রা-সংশ্লিষ্টদের। এদিকে করোনার কারণে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি অনলাইনে যাত্রার আয়োজন করেছে। প্রথমে ৪টি দলকে ১০ মিনিট ও পরবর্তী ৪টি দলকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যাত্রাপালার জন্য ১৫ মিনিট করে সময় দেওয়া হচ্ছে।

 

চিত্র প্রদর্শনী ও অন্যান্য

করোনা আতঙ্কে থমকে রয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী। বেঙ্গল গ্যালারি, গ্যালারি কায়া, গ্যালারি চিত্রক, এলিয়েস ফ্রসেন্স, গ্যালারি কসমস, চারুকলা, শিল্পকলাসহ বিভিন্ন গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী আপাতত হচ্ছে না। তবে শিল্পীরা এ বিষয়ে আয়োজন করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে আড্ডা আয়োজন। শিগগিরই বিভিন্ন গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী শুরু হবে বলে আশা করছেন চিত্রশিল্পীরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর