বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে ব্যান্ড সংগীতের সেই জৌলুস

আলী আফতাব

হারিয়ে যাচ্ছে ব্যান্ড সংগীতের সেই জৌলুস

একটা সময় ছিল ফিতার ক্যাসেটের। সিডি-ডিভিডি, ইউটিউবের এই যুগের কিশোর-তরুণরা হয়তো জানেই না ফিতার ক্যাসেট বলে কিছু ছিল। এমনও সময় গেছে, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা টিফিনের টাকা জমিয়ে রাখত নতুন ক্যাসেট কেনার জন্য। এমনও দেখা গেছে, একটা ব্যান্ডের ক্যাসেট কিনতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে ভক্তকে। অনেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতেন পছন্দের ব্যান্ডের ক্যাসেট কিনতে। যা এই কালে বিরল। কোথাও কোনো ব্যান্ডদল আসছে গান পরিবেশনের জন্য শুনলেই চারদিকে হইহই পড়ে যেত। সে যে কী আলোড়ন- বোঝানো যাবে না। কিন্তু এখন এসব বিষয় যেন কেবলই সোনালি অতীত।

ব্যান্ড সংগীতের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল এবারের করোনাকাল। স্টেজশো আর টিভি লাইভ দিয়ে যতটুকু বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল ব্যান্ড সংগীত, আজ যেন তাও হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে হারিয়ে যাবে ব্যান্ড সংগীতের ঐতিহ্য। ব্যান্ডের গান সম্পর্কে এমন মন্তব্যই শোনা যায় অনেকের কাছ থেকে। এর কারণ কী? অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যান্ডশিল্পীদের একক ক্যারিয়ার এবং অ্যালবামের দিকে বেশি অমনোযোগী হওয়াই এর মূল কারণ। নিজের একক ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী হতে গিয়ে ব্যান্ডের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েছেন ব্যান্ডের শিল্পীরা। অন্যদিকে ব্যান্ড সংগীতের প্রতি শ্রোতাদের অনীহাও অন্যতম আরেকটি কারণ। এ দুইয়ে মিলে অডিওতে ব্যান্ডের দুর্দিন রীতিমতো লক্ষণীয়।

এদিকে ব্যান্ড সংগীতে আলোড়ন তুলতে পারছে না নতুন কোনো ব্যান্ডদল। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের শুরু। আর নব্বইয়ের দশক ছিল ব্যান্ড সংগীতের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। এ সময় বাংলাদেশের কিছু কালজয়ী ব্যান্ডদলের প্রতিষ্ঠা, উত্তরণ ও উন্মেষ ঘটে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই ঐতিহ্যে ভাটা পড়েছে। ভালো কথা, ভালো সুর বা সংগীতায়োজন আজ হাতেগোনা কয়েকটি ব্যান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? কিন্তু কী এমন হলো যে, ব্যান্ডের আধিপত্য কমে যাচ্ছে? সংগীতে যতটুকু দাপট তা ওই সলো ক্যারিয়ারেই। ব্যান্ডের গর্জন কোথায়? একটু পেছনে ফিরে তাকালে ব্যান্ড সংগীত শুধু ঢাকাকেন্দ্রিকই ছিল না, দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে উঠে এসেছে দেশ, সেরা ব্যান্ড। ঢাকা, চট্টগ্রামের পাশাপাশি ব্যান্ড সংগীত চর্চা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য বড় শহরেও, বিশেষ করে খুলনায়। বর্তমানে খোঁজ নিয়ে তেমন কোনো নতুন ব্যান্ডের দেখা মিলবে না।

‘শানাইয়ের সুর নিয়ে যাবে দূর একটু একটু করে তোমায়..., অথবা ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে..., অথবা ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে..., ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে..., ফুল নেবে না অশ্রু নেবে বন্ধু। কী অপূর্ব এবং অসাধারণ গানের কথা। সুলস, এলআরবি, মাইলস, ফিলিংস (বর্তমানে নগর বাউল), আর্ক, ফিডব্যাক, অবসকিওর, চাইম, ডিফারেন্ট টাচ, উইনিং, প্রমিথিউসসহ অনেক ব্যান্ড তাদের গানে তারুণ্যকে ভাসিয়ে নিয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্যান্ড সংগীতে কেমন একটা অচলাবস্থা তৈরি হলো। বেশির ভাগ ভালো ব্যান্ডের মধ্যে দেখা দিল ভাঙন। বর্তমানে যে কয়টি ব্যান্ড কিছুটা হলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম দলছুট, চিরকুট ও জলের গান।

ভেঙেচুরে ‘শিরোনামহীন’, ‘অর্থহীন’, ‘ব্লাক’, ‘আর্টসেল’, ‘বাংলা’, ‘আর্কে’র অস্তিত্ব সংকটে।

বর্তমানে কোনো ব্যান্ডের নামই তেমন একটা শোনা যায় না। কখনো কখনো হয়তো কোনো একটা গান হিট হয়, তারপর সবাই ভুলেও যায় গায়ক এবং ব্যান্ডের নাম। এ ছাড়া পুরনো ব্যান্ডগুলোর নেই নতুন কোনো গান। আর যে গানগুলো প্রকাশ হচ্ছে সেই গানগুলো পাচ্ছে না তেমন কোনো জনপ্রিয়তা। প্রযুক্তির কল্যাণ আর বস্তাপচা কথার বদৌলতে সস্তা দরের গান আর স্পন্সরদের খুশি করাই এখন ব্যান্ডগুলোর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। আগে ব্যান্ড সংগীত কেবল প্রেম, ভালোবাসা, ভালো লাগার কথাই বলত না, সমাজসচেতনতার কথাও বলত। তারা কেন হারিয়ে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর কি আমরা খুঁজেছি কখনো? ব্যান্ড সংগীত কি আবার তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে না? তবে পাওয়ারসার্জ, আরবোভাইরাস, এভোয়েড রাফা, ওল্ড স্কুল, ছাতক, মিনেরেবার মতো নতুন ব্যান্ডগুলো নতুন আঙ্গিকে ব্যান্ড সংগীতের ধারা ক্রমবর্ধমান রাখতে পারছে না। এখন হয়তো পাড়ায় পাড়ায় ব্যান্ড নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকড়া দুই-চারটি ব্যান্ড নেই। তবে একদম কিছুই যে নেই তা ভুল। তবে যা আছে তা তো সারা দেশে আলোড়ন তুলতে পারে না। পুরোটাই কি সিস্টেমের জন্য তারা আড়ালে? নাকি নিজেদেরই নেই স্বকীয় কোনো দক্ষতা? নিজেদের কণ্ঠ ও লেখনীর নেই জোর। ভালো কিছু হলে এখন তো ইন্টারনেটের যুগে ভাইরাল হওয়া আরও সহজ।

একটা সময় বিভিন্ন ব্যান্ডের অ্যালবামগুলো অডিও বাজারকে চাঙ্গা করে তোলে। নব্বই দশকে ব্যান্ড সংগীতে নতুন মাত্রা যোগ করে মিশ্র অ্যালবাম। আর্কখ্যাত সুরকার ও মিউজিক কম্পোজার আশিকুজ্জামান টুলু বিভিন্ন ব্যান্ডের গায়কদের নিয়ে মিশ্র অ্যালবামের প্রচলন শুরু করেন। এরপর ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলেন গীতিকার-সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। প্রিন্স মাহমুদের লেখা ও সুরে প্রতিটি অ্যালবাম ব্যান্ড সংগীতকে সর্বমহলে জনপ্রিয় করে তোলে। সৃষ্টি হয় অসংখ্য কালজয়ী গান। নব্বই দশকের শেষদিকে ভিন্ন ধারার গান নিয়ে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে ব্যান্ড দলছুট। ব্যান্ড সংগীত নিয়ে নানা আয়োজন নব্বই দশককে ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগ করে রেখেছে।  ২০০০ সালের পর থেকে ব্যান্ড সংগীত পড়ে যায় অস্থিরতার মধ্যে। ক্যাসেটের যুগ থেকে সিডির যুগে প্রত্যাবর্তন।  আর ইউটিউবের এই সময় এসে কোনো গানই যেন স্থায়ী হচ্ছে না শ্রোতাদের মনে।

সর্বশেষ খবর