রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

আটাত্তরেও চিরতরুণ বলিউড শাহেনশাহ

আটাত্তরেও চিরতরুণ বলিউড শাহেনশাহ

আজ জীবনের ৭৮ বসন্তে পা রাখছেন বলিউড শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। বয়সটা অঙ্কে বুড়িয়ে গেলেও এখনো টগবগে যুবকের মতো কর্মক্ষেত্রে শুদ্ধ ছন্দের হিসাব কষেন। প্রচন্ড ঝড় তোলেন অভিনয় আর উপস্থাপনায়। বলিউডের ‘ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি’ খ্যাত বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের জীবনের সাতসতেরো তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ইনকিলাব থেকে বিগ বি

যার নামই ‘ইনকিলাব’, মানে যার মন আর মননে শুধু অগ্নিঝরা কর্ম আর ব্যক্তিত্ব তিনিই তো বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। প্রকৃত নাম ইনকিলাব শ্রীবাস্তব। সিনেমায় তার সম্মানসূচক নাম বিগ বি, অর্থাৎ বড় বচ্চন। এখনো যার কর্মমুখর অসাধারণ মনের জোরের কাছে বয়স হার মানে তিনিই বলিউডের প্রকৃত শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। অমিতাভ বচ্চন প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি বিশ্বে মিলিনিয়ামের সেরা সুপারস্টার। বলিউডের এই শাহেনশাহ একাধারে একজন অতি সফল চলচ্চিত্র অভিনেতা, চলচ্চিত্র প্রযোজক, কণ্ঠশিল্পী ও টেলিভিশন উপস্থাপক।

 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের এক হিন্দু-শিখ পরিবারে অমিতাভ বচ্চনের জন্ম। তার পিতা হরিবংশ রায় বচ্চন একজন নামকরা হিন্দি কবি ছিলেন। তার মা তেজি বচ্চন ফয়সালাবাদের (এখন পাকিস্তানে) এক শিখ-পাঞ্জাবি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় স্লোগান ইনকিলাব জিন্দাবাদের অনুপ্রেরণায় অমিতাভের প্রথম নামকরণ হয়েছিল ইনকিলাব। পরে তার নাম বদলে রাখা হয় অমিতাভ অর্থাৎ ‘যে আলো কখনো নিভে যায় না।’ এলাহাবাদের জ্ঞান প্রবোধিনি বয়েজ হাইস্কুলে (বিএইচ এস)-এ তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। পরে ননিতালের শেরউড কলেজে কলা বিভাগে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কিরোরিমল কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন।

 

কর্মজীবন ও অভিনয়

অমিতাভ বচ্চন কলকাতার ব্ল্যাকার অ্যান্ড কোং নামে একটি জাহাজ কোম্পানিতে প্রথমে চাকরি নেন। বেতন ছিল ৩০০ রুপি। পরে অভিনেতা হওয়ার উদ্দেশ্যে ২০ বছর বয়সে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন। ১৯৬৯ সালে ‘সাত হিন্দুস্তানি’ ছবি দিয়ে রুপালি পর্দায় তার অভিষেক। এ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ নতুন অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৭৩ সালে ‘জঞ্জির’ ছবিতে রাগী যুবক রূপে নিজেকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করে অর্জন করেন ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ অর্থাৎ রাগী যুবক খ্যাতি।

 

সহস্রাব্দের সেরা তারকা

দক্ষ কর্মযজ্ঞ দিয়ে দ্রুত সময়ে বলিউডের শাহেনশাহ ও সহস্রাব্দের সেরা তারকা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন অমিতাভ বচ্চন। পাঁচ দশকের অধিক সময়ের  কর্মজীবনে ১৯০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অমিতাভকে ভারতীয় চলচ্চিত্র তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ও প্রভাবশালী অভিনেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক ও পরিচালক ফ্রঁসোয়া ত্রাফো তাকে ‘একক-ব্যক্তি চলচ্চিত্র শিল্প’ বলে অভিহিত করেন।

 

যত সম্মাননা

৫টি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে পদ্মশ্রী, ২০০১ সালে পদ্মভূষণ, ২০১৫ পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে লেজিওঁ দ্য নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক ও পরিচালক ফ্রঁসোয়া ত্রাফো তাকে ‘ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি’ মানে একক-ব্যক্তি চলচ্চিত্র শিল্প বলে অভিহিত করেন।

 

সফল টিভি উপস্থাপক

মার্কিন টিভি গেম শো ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ হু ওয়ান্টস টু বি অ্যা মিলিয়নিয়া’র-এর ভারতীয় সংস্করণ ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানের একজন সফল সঞ্চালক তিনি। এই অনুষ্ঠান এখনো শুরু হলে অমিতাভের জাদুকরী উপস্থাপনা দেখতে শুধু ভারত নয় বিশ্বের অনেক দেশেরই রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে।

 

রাজনীতিবিদ

১৯৮০-এর দশকে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ভারতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন।

 

টার্নিং পয়েন্ট ১৯৭৫

১৯৭৫ সালেই তাকে দুটি ছবিতে দেখা গিয়েছিল যা হিন্দি ছবির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যশ চোপড়া পরিচালিত ছবি ‘দিওয়ার’-এ তাকে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যায়। এই ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পান। ১৯৭৫-এ ছবিটি বক্স অফিসে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায় এবং চতুর্থ স্থান লাভ করে। ইন্ডিয়া টাইমস মুভিসের তালিকা অনুযায়ী দিওয়ার প্রথম ২৫টি অবিস্মরণীয় বলিউড ছবির মধ্যে একটি। একই বছর মানে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত শোলে (অর্থাৎ অগ্নিশিখা) চলচ্চিত্রটি ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্র হিসেবে অভিহিত হয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করেও এই ছবির আয় হয় ২৩৬ কোটি ৪৫ লাখ রুপি। এ ছবিতে অমিতাভ জয় চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। ১৯৯৯ সালে বিবিসি ইন্ডিয়া এই ছবিটিকে ‘সহস্রাব্দের সেরা ছবি’ বলে ঘোষণা দিয়েছিল। ইন্ডিয়া টাইমস মুভিস দিওয়ার ছবির মতো এই ছবিটিকেও প্রথম ২৫টি অবিস্মরণীয় বলিউড ছবির তালিকায় রেখেছে। একই বছরে ৫০তম ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের বিচারকরা এই ছবিটিকে ‘ফিল্মফেয়ার ৫০ বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি’র সম্মানে ভূষিত করেন। বক্স অফিসে শোলের অভাবনীয় সাফল্যের পর অমিতাভ বচ্চন মুম্বাই ফিল্ম জগতে তার অবস্থান পাকা করে নেন।

 

গায়ক অমিতাভ

১৯৭৯ সালে মিস্টার নটবরলাল ছবিতে প্রথমবার প্লেব্যাক করেন। এরপর লাওয়ারিশ, সিলসিলা, ম্যায় আজাদ হু, মহান, বাগবান, শামিতাভসহ বেশকিছু ছবির গানে কণ্ঠ দেন এবং গায়ক হিসেবেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

 

১৯৮২-তে নবজন্ম

১৯৮২ সালে কুলি ছবির একটি মারামারির দৃশ্যে তিনি অন্ত্রে মারাত্মক আঘাত পান। প্রায় তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন। মৃত্যুর আশঙ্কাও দেখা দিয়েছিল। সুস্থ হয়ে নবজন্ম লাভ করেন। এ দুর্ঘটনার কারণে পরিচালক মনমোহন দেশাই ‘কুলি’র শেষাংশটি বদলে দেন। এতে বচ্চনের চরিত্রটি ছবির শেষে মারা যাবে। কিন্তু চিত্রনাট্য বদলিয়ে তাকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়। দেশাই বলেন, যে মানুষটি সদা মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় করেছে, তাকে পর্দায় মেরে ফেলা উচিত হবে না।

 

দরাজ কণ্ঠের খ্যাতি

অমিতাভ বচ্চন তার গম্ভীর, ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরের জন্য বিখ্যাত। তাকে অজস্র অনুষ্ঠানে সূত্রধর, নেপথ্য গায়ক এবং উপস্থাপকের ভূমিকায় দেখা গেছে। প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বচ্চনের কণ্ঠস্বর শুনে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তার ছবি ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে তাকে ভাষ্যকারের ভূমিকা দিয়েছিলেন।

 

শাহেনশাহর সাতকাহন

► অমিতাভই প্রথম এশিয়ান অভিনেতা, যার মোমের প্রতিকৃতি লন্ডনের মাদাম তুসো মিউজিয়ামে স্থান পায়।

► ঘড়ি এবং কলম সংগ্রহ করা তার অন্যতম শখ। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১১টি গাড়ি আছে তার সংগ্রহে।

► অমিতাভ দুই হাতেই সমানভাবে লিখতে পারেন।

► ৫ ঘণ্টায় ২৩টি দৃশ্যের ডাবিং করেছেন, যা বলিউডের চলচ্চিত্র ইতিহাসে রেকর্ড।

► ব্যক্তিজীবনে খুবই বিনয়ী। ১৯৭৩ সালে জয়া ভাদুড়ীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।  মেয়ে শ্বেতা নন্দা, ছেলে অভিষেক বচ্চন।

সর্বশেষ খবর