রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

আজ মন খারাপের দিন, হৃদয় ভাঙার দিন

আলী আফতাব

আজ মন খারাপের দিন, হৃদয় ভাঙার দিন

এই রুপালি গিটার ছেড়ে, এক দিন চলে যাব দূরে, বহু দূরেÑ এভাবেই গেয়েছিলেন বাংলা ব্যান্ড জগতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। রুপালি গিটার ফেলে চলে যাওয়ার আভাস দিয়েছিলেন অনেক আগেই। তবে সেই সময়টা যেদিন এলো, অশ্রু গোপন করে রাখতে পারেননি তার ভক্তদের কেউই। ২০১৮ সালের আজকের দিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে চিরবিদায়  নেন সুরের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। আজ এই সুরসাধকের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

কয়েক প্রজন্মকে গানের বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই ক্যাসেট-ফিতার কাল পেরিয়ে স্মার্টফোন-ল্যাপটপের যুগে এসেও তার গানের আবেদন কমেনি এতটুকুও। বইয়ের ফাঁকে তার ভিউকার্ড জমানোর সেই উন্মাদনা কখনো কি ভোলা সম্ভব! অটোগ্রাফের জমানা শেষে ফটোগ্রাফের আমলে, বাঙালির চিঠি লেখার অভ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার পরে, ই-মেইল, ফেসবুকের কালে প্রবেশের পরও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এতটুকুও।

কত লক্ষ-কোটি বিরহী প্রেমিক তারা ভরা রাতে তার গানকে সঙ্গী করেছেন, সে হিসাব কেউ কি জানে? ফেরারি মন নিয়ে নিয়ন আলোয় হেঁটে যাওয়া তরুণ-তরুণীর বড্ড আপনজন ছিলেন বাচ্চু। ইট-পাথরের শহর ঢাকাবাসীকে সুরের মূর্ছনায় ভাসাতে মঞ্চে কেবল আইয়ুব বাচ্চুর উপস্থিতি থাকলেই হতো। কী এক অদ্ভুত মায়া, টান ছিল তার গিটারে! গভীর কোনো বেদনা থেকেই কি অমন বিরহের সুর তুলতেন তিনি!

হৃদয় স্পর্শ করে যাওয়া অমন সুরের মোহে আচ্ছাদিত থাকত উপস্থিত সবাই। শুধু কি শহর! মফস্বলেও আইয়ুব বাচ্চুর উপস্থিতি মানেই ছিল রোমাঞ্চকর, সারা জীবন মনে রাখার মতো কিছু মুহূর্ত। তবে সবাইকে দুই হাতে আনন্দে বিলিয়ে বেড়ানো আইয়ুব বাচ্চুর সুরের বুকে লুকিয়ে থাকা কান্নার সন্ধান পেয়েছিলেন ক’জনা? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আকাশে উড়াল  দেবেন কেউ কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন?

বড্ড অচেনা হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এভাবেই কি যাওয়ার কথা ছিল! এভাবে কি যেতে হয়! মঞ্চে সুরের ঝঙ্কার তোলা সুরস্রষ্টার চিরবিদায় বেলায় শীতপ্রকৃতির মতোই নির্জীবতা বিরাজ করছিল সর্বত্র। আইয়ুব বাচ্চু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাংলা গানের জগতের একটি অধ্যায়।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। জনপ্রিয় ব্যান্ড দল এলআরবির দলনেতা ছিলেন তিনি। একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ব্যান্ড জগৎ। ১৯৭৮ সালে তিনি ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে পথচলা শুরু করেন। এরপর ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেন। নব্বইয়ের দশকে তার হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যান্ড দল এলআরবি’।

তিনি অসংখ্য কালজয়ী, জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। ‘চলো বদলে যাই,’ ‘হাসতে দেখো,’ ‘এখন অনেক রাত,’ ‘রুপালি গিটার’, ‘মেয়ে’ ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি,’ ‘সুখের এ পৃথিবী,’ ‘ফেরারি মন,’ ‘উড়াল দেবো আকাশে,’ ‘বাংলাদেশ,’ ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি,’ ‘এক আকাশের তারা,’ ‘সেই তারা ভরা রাতে,’ ‘কবিতা,’ ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি,’ ‘যেওনা চলে বন্ধু,’ ‘বেলা শেষে ফিরে এসে,’ ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি,’ ‘তিন পুরুষ’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি।

বাংলাদেশের শ্রোতাদের রক কিংবা হার্ডরক গান শোনার অভ্যাস তৈরি করেছেন আইয়ুব বাচ্চুর মতো লিজেন্ড। যতদিন গান করেছেন এক্সপেরিমেন্ট করেই গেছেন। একটা প্যাটার্ন নিয়ে কখনো থেমে থাকেননি। শুধু অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। দিন যতই গড়িয়েছে নিজেকে বিশ্বমানের উপযোগী করার চেষ্টা করেছেন। নিরন্তর গবেষণা করেছেন মিউজিক নিয়ে। কখনো সুনীল দের সঙ্গে ভায়োলিনের ব্যবহার আবার কখনো বাঁশি নিয়ে চমৎকার এক্সপেরিমেন্ট। যা করেছেন সবকিছুই নিজস্ব কনসেপ্ট থেকেই করেছেন। দেশীয় প্রেক্ষাপটে প্রথম আনপ্লাগড-এর ব্যবহার আইয়ুব বাচ্চুই করেছেন। আর এই কারণেই জাতীয়ভাবে তার গান সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু মিউজিকের বিষয়েই নয়, তার ড্রেসআপ থেকে শুরু করে কথা বলার স্টাইল সব কিছুর মধ্যে স্বতন্ত্র একটা ভাব ছিল। সব ধরনের গান করার চেষ্টা করেছেন তিনি। রক কিংবা হার্ডরকের পাশাপাশি রোমান্টিক, সফট সেন্টিমেন্টাল এমনকি সমাজের বিভিন্ন সঙ্গতি অসঙ্গতি তথা গণমানুষের গান করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মিউজিশিয়ান হিসেবে আখ্যা দিলে ভুল হবে না।

 

বাবুইকে ছাড়া দুই বছর

সংগীতের এই মহাতারকার মহাপ্রয়াণের দুই দিন আগে (১৬ অক্টোবর) ‘এলআরবি’র অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আবেগঘন এক পোস্ট দেন তার দুই সন্তান ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও আহনাফ তাজওয়া। তারা লেখেন, ‘বাবুইকে (বাবা) ছাড়া চলে গেল দুই বছর, আরও ক’বছর এভাবে যাবে জানি না!’ আমাদের মতো আপনাদেরও (ভক্তদের) অনেক কষ্টের এই ১৮ অক্টোবর। আমাদের বাবুই এর জন্য সবাই মন থেকে দোয়া করবেন। আমরা আমাদের বাবুই (বাবা) এর জন্য তার জন্মদিনে (১৬ আগস্ট) ও গত বছর চলে যাওয়ার এই দিনে যতটুকু করলে আল্লাহ খুশি হন, ততটুকুই করেছি এবং করে যাব ইনশাআল্লাহ। আমরা ঘোষণা দিয়ে কখনই কিছু করিনি। কারণ, আমরা আমাদের বাবুই-এর কাছ থেকেই একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখেছি যে, তোমার ডান হাতে দান করলে তোমার বাম হাত তা জানবে না। নিঃশব্দে কাজ করবা- আল্লাহ পাকও তা পছন্দ করেন। গত বছর আমরা চট্টগ্রামে বিশেষ আয়োজন করেছি তার পছন্দের জায়গাগুলোতে, মাজারগুলোতে। এবার প্যানডেমিকের জন্য সবকিছু একটু থমকে গেছে। গতবারের মতো এবারও আমাদের দুই ভাইবোনের দেশে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু প্যানডেমিকের কারণে আর দেশে ফেরা সম্ভব হলো না। তাই আমরা পারিবারিকভাবে আমাদের বাবুই-এর পছন্দের জায়গাগুলোতেই অর্থাৎ যেখানে উনি আগেও দিতেন সেসব জায়গাতেই দোয়া খায়ের করছি। যেমন, আমাদের বাসার পাশে মসজিদে পুরো মাসজুড়ে কোরআন খতম, পারিবারিকভাবে খতম আর এতিমখানায় খাওয়ানো- যেটা বাবুই নিজেই আমাদের সব সময় করার জন্য শিখিয়েছেন। এ ছাড়া বাবুই-এর পছন্দের কয়েকটা এতিমখানায় কিছু জিনিস দিচ্ছি তার নামে। আল্লাহপাক যেন আমাদের এই দান ও ইবাদত কবুল করে নেন। তার ভক্তদের কাছেও অনুরোধ থাকবে, যারা তাকে অন্তরের গভীর থেকে ভালোবাসেন তারা অন্তত ওই দিন বাবুই-এর জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়ে তার জন্য দোয়া করবেন। বাবুই-এর সব সৃষ্টিকে যেন আমরা রক্ষা করতে পারি। তার জন্য যা যা করার ও যতটুকু করার তা আমরা করেই যাব।

 

সংগীতের জন্য বাচ্চু  নিবেদিতপ্রাণ : জেমস

আশির দশকের কথা। লিড গিটারিস্ট হিসেবে ফিলিংস ব্যান্ডে যোগ দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। এরপর কত আড্ডা-গানের মধ্য দিয়ে কত সময় চলে গেছে, তার হিসাব মেলানো কঠিন। তখনই জেনেছিলাম, সংগীতের জন্য আইয়ুব বাচ্চু কতটা নিবেদিতপ্রাণ। শিল্পী ও সংগীতায়োজক হিসেবে তার পথচলাও মসৃণ ছিল না। অনেক বাধা পেরিয়ে দিনের পর দিন সংগ্রাম করেই শিল্পী হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা। সে ইতিহাস গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। তার কাছেই শুনেছিলাম, গিটারের নেশায় কীভাবে ছুটে গেছেন এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে। জানি, শিল্পীর মৃত্যু নেই। গিটারের বরপুত্র আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।

 

মানুষ তাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে : বিশ্বজিৎ

দেখতে দেখতে বাচ্চু চলে যাওয়ার দুই বছর হয়ে গেল। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে তার শূন্যতা রয়ে গেছে। আমার মনে হয় না এ শূন্যতা কখনো পূরণ হবে। আধুনিক সংগীতাঙ্গনে তার অবদান ভোলার নয়। দেশের ব্যান্ডসংগীতকে জনপ্রিয় করেছেন বাচ্চু। বাচ্চু বাজাতেন, গাইতেন, লিখতেন আবার সুরও করতেন। তার প্রায় প্রতিটি গানই জনপ্রিয়। তার গানগুলো মানুষ শোনেন আর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন সংগীতশিল্পীই নন, তিনি একজন ভালো মনের খুব সাধারণ মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে যাদের ওঠা-বসা ছিল তারাও আমার কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করবেন নিশ্চয়ই। তিনি খুব সহজেই একজনকে আপন করে নিতে পারতেন। গান দিয়ে যেমন শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন, ব্যবহারেও তেমনটি ছিলেন। সহজসুলভ আচরণ ছিল তার।

 

সময় কত দ্রুত চলে যায় : নকীব খান

তার সঙ্গে স্মৃতি তো অনেক রয়েছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি! আমরা একসঙ্গে ব্যান্ড করেছি। ১৯৮২ সালের দিকে সোলসে সে যোগ দেয়। এর আগে সে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে ছিল। তাকে ব্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পিলু খান। দুই বছর হয়ে গেল সে আমাদের মাঝে নেই। আমার মনে হয় এই তো সেদিন তার সঙ্গে কথা হয়েছে। এই সময়ে সবাই মিলে তার আত্মার শান্তি কামনা ছাড়া কিছুই করার নেই! ওপারে ভালো থাকুক-এই কামনাই করি।

 

মানুষ আজীবন তাকে মনে রাখবে : হাসান

মানুষের মনে যে সুর বাজে সেই সুরই কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। নতুন প্রজন্ম তাকে অনুসরণ করবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাকে আজীবন মানুষ মনে রাখবে। আমরা সব সময় তাকে মিস করব। তবে তিনি তার সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না। এটা মনে হলেই মনটা কেঁদে ওঠে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। সবাইকেই যেতে হবে। উনি আজ গেছেন। পরবর্তীতে আমরা সবাই একে একে যাব। আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে নিজের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে হাসান বলেন, ‘বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে যে স্মৃতি রয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।’

সর্বশেষ খবর