বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বিনোদন

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বিনোদন

বিলুপ্তিতে বাঙালির একসময়ের ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলো। গ্রামীণ জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের চিরচেনা সেসব অনুষঙ্গ গভীর অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। সৃজন ও মননচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা লোকঅনুষঙ্গগুলো এখন শুধুই ইতিহাস। সেসব হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যম সম্পর্কে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

পুতুলনাচ

‘হেলায় সুযোগ হারাবেন না। চলে আসুন আমাদের প্যান্ডেলে। এক্ষুনি শুরু হবে ‘জব্বর’ পুতুলনাচ। পুতুলনাচ দেখে আনন্দচিত্তে বাড়ি ফিরে যান।’ গ্রামবাংলার চিরচেনা এমন সংলাপ এখন আর শোনাই যায় না। বসে না কোথাও পুতুলনাচের তেমন কোনো প্যান্ডেল। ঐতিহ্যবাহী এই পুতুলনাচ বাঁচাতে নেই কোনো উদ্যোগ। দুই একটা স্থানে কালেভদ্রে হলেও এখন আর পুতুলনাচে লোকসমাগম নেই। তাই পুতুলনাচের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই জীবন বাঁচাতে বেছে নিয়েছেন বিকল্প ব্যবস্থা। কেউ মুদির দোকানে ব্যস্ত, কেউ আচার বা ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন, আবার কেউ বেকার বসে আছেন। জীবনের সব সম্বল হারিয়ে এখন পুতুলনাচের উদ্যোক্তারা অসহায় জীবনযাপন করছেন। বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যমন্ডিত পুতুলনাচকে আধুনিক রূপ দেবে এমন উদ্যোগী এখন আর কেউ নেই। মৃতপ্রায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেই বলে জানিয়েছেন পুতুলনাচ শিল্পীরা। শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, ঢাবি ও জাবি নাট্যকলা বিভাগ দীর্ঘদিন যাবৎ এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করলেও মাঠপর্যায়ের শিল্পীরা আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে পুতুলনাচ। পুতুলনাচের দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় না আনা এবং শিল্পী-কলাকুশলীদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা না করা হলে পুতুলনাচ বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

গাজীরপট

গাজীরপট একপ্রকার লোকচিত্রকলা। এতে গাজী পীরের উপাখ্যানের বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রায়িত হয় এবং সংগীতযোগে পটুয়ারা এগুলো পরিবেশন করেন। গাজীরপটের পাশাপাশি মনসাপট, রামায়ণপট, কৃষ্ণপট ইত্যাদিও একসময় প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বিনোদনের বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যম প্রচলিত হওয়ায় এ মাধ্যমটি বিলুপ্তপ্রায়। দু-একটি দৃষ্টান্ত ব্যতিরেকে ওইসব পটের নিদর্শন আজ পাওয়া দুষ্কর। পটশিল্পীদের সবাই বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত এবং  ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। গাজীরপট সাধারণত গ্রামে-গঞ্জে বাড়ির উঠানে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। কুশীলবরা জুড়ি, ঢোল, চটি প্রভৃতি বাজিয়ে গান গায় আর পট প্রদর্শন করে।

 

যাত্রাপালা

এখন সন্ধ্যা নামলেই মেলা থেকে লাউড স্পিকারে আর ভেসে আসে না ‘হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার... অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ...’। যাত্রাপালা দেখার জন্য দর্শক রাতভর বিনিদ্র থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আর অপেক্ষায় প্রহর গোনেন না। শীতে মেলা বসবে, যাত্রাপালা আসবেÑ সেই প্রতীক্ষায় থাকে না আর গ্রামের মানুষ। যাত্রাশিল্পের এখন ঘোর দুর্দিন। দেশে যাত্রাপালার অনুমোদন অঘোষিতভাবে বন্ধ। যাত্রাপালা আয়োজনে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু যাত্রার কথা শুনলেই প্রশাসন আর অনুমোদন দিচ্ছে না। পালা মঞ্চস্থ না হওয়ায় এসব মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই চলে গেছেন অন্য পেশায়। অনেক দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক, বাদক, পালাকার চলে গেছেন দল ছেড়ে। ফলে ক্রমেই রুগ্ন, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী যাত্রার জৌলুস। অন্যদিকে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আবর্তে পড়ে বাঙালির লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য এই যাত্রাপালা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যাত্রাদলগুলোকে প্রতি বছর শিল্পকলা একাডেমির কাছ থেকে নিবন্ধন নবায়ন করতে হয়, যা ‘দলের লাইসেন্স’ হিসেবে গণ্য। কিন্তু নাম নিবন্ধন করে লাভ কী! পালা তো মঞ্চায়ন করা হয় না। তাই দলও গঠন করা হয় না।

 

সার্কাস

যাত্রা ও পুতুলনাচ প্রদর্শন অনিয়মিত হলেও সে তুলনায় সার্কাস প্রায় বন্ধ। যাত্রার মতোই সার্কাসেও একটি প্রধান সমস্যা প্রশাসনিক অনুমোদন। এই অনুমোদন পাওয়া অতি দুরূহ। সার্কাসের দল টিকিয়ে রাখাও খুব ব্যয়বহুল। সার্কাসের বিভিন্ন কসরতের জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন, তাদের নিয়মিত অনুশীলন জরুরি। সে কারণে দল ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেলে ফের সার্কাসে ফিরে আসা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ দলে থেকে জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। তাই অনেকে দল ছেড়ে গেছেন। অধিকাংশ সার্কাসের দল এভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে। এখন নামে মাত্র তিন-চারটি দল টিকে আছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজবাড়ী জেলায় চর্চা চলত সার্কাসের। এই জেলায় গড়েও উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় এক্রোবেটিক সেন্টার। দেশ-বিদেশে এই জেলার এক্রোবেটিকদের রয়েছে সুনাম। তবে তেমন করে এই মাধ্যমের শিল্পীদের নিয়ে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই বললেই চলে। কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন এই শিল্পীরা। অন্যদিকে সার্কাসের উপযোগী বড় ও স্থায়ী মাঠও নেই।

 

বায়োস্কোপ

একসময়কার গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন ছিল বায়োস্কোপ দেখা। এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। বায়োস্কোপ দেখিয়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমে নিজের সংসার চালাত এই পেশায় নিয়োজিত মানুষ। এই বিনোদনের মাধ্যম আজ বিলুপ্তির পথে। এই পেশার লোকেরা পেশা বদলিয়ে অন্য পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে করছেন অন্য কাজ।

 

নৌকাবাইচ

নৌকাবাইচ শুধু গ্রামবাংলার ঐতিহ্যই নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির অতি প্রাচীন একটি অঙ্গও বটে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব আর আধুনিকতায় ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিযোগিতাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। নৌকাবাইচকে ঘিরে একসময় কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর দুই পাড়ে নামত লাখো মানুষের ঢল। পদ্মা নদীবিধৌত রাজবাড়ীর গোদার বাজারেও নিয়মিত হতো নৌকাবাইচ উৎসব। নদীতে পর্যাপ্ত পানির অভাব ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে বিলুপ্তির পথে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। তবুও থেমে নেই, গ্রামবাসীর উদ্যোগে এখনো হচ্ছে সুস্থ বিনোদনের এই উৎসব।

 

ভাটিয়ালি ও পুঁথিপাঠ

বাংলা লোকসংগীতের শক্তিশালী একটি ‘ঐতিহ্যবাহী ধারা’ ভাটিয়ালি গান। প্রযুক্তির নানা সুবিধার কারণে এবং এসব গান সংরক্ষণের অভাবে এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এসব গান সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। আর লোকসাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পুঁথিপাঠ। সৃজনশীলতা, মানবভাবনা ও কাব্যত্ব না থাকার কারণে এ যুগের পাঠক তা পাঠও করেন না। তবে এখনো কোথাও কোথাও  পুঁথিপাঠের আসর চলে।

সর্বশেষ খবর