রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পথ দেখায় হানিফ সংকেতের ইত্যাদি

শোবিজ প্রতিবেদক

পথ দেখায় হানিফ সংকেতের ইত্যাদি

করোনার কারণে দীর্ঘদিন দেশের মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরাজমান নীরবতা ভেঙে দেশবরেণ্য নির্মাতা হানিফ সংকেত দীর্ঘ ৭ মাস পর দর্শকদের সামনে হাজির হলেন ভিন্ন রূপে-ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মিত নতুন ইত্যাদি নিয়ে। এই হিসাবে বলা যায় ইত্যাদি হলো করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শক উপস্থিতিতে ধারণ করা প্রথম অনুষ্ঠান। প্রায় ৪ হাজার দর্শক নিয়ে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে রাজশাহীর সারদায় অবস্থিত দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান পুলিশ একাডেমিতে ২৫০ বছরের প্রাচীন প্রত্ননিদর্শন নীলকুঠির সাহেবদের বাসভবন ছোটকুঠির সামনে অনুষ্ঠিত হয় এবারের এই রাজশাহী পর্ব। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সব দর্শকের মুখেই ছিল ইত্যাদি লেখা মাস্ক। ৭০ মিনিট ব্যাপ্তিকালের এই পর্বটি শিক্ষা, তথ্য ও বিনোদনের পাশাপাশি মানবিক আদর্শিকতায় ছিল উজ্জ্বল। ফেসবুকে অনেকে লিখেছেন, ‘দেশে পরিবার নিয়ে দেখার মতো কিছুই নেই। তাই করোনার সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের সামনে ইত্যাদি যেন ছিল পরম পাওয়া।’

এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে নান্দনিক ও সুস্থ বিনোদন মানুষের মনে যে কী প্রভাব ফেলে-ফেসবুক, ইউটিউবে লাখ লাখ শেয়ার, লাইক আর কমেন্ট পেতে পারে ইত্যাদিই হচ্ছে তার অনন্য উদাহরণ। প্রতিবারের মতো এবারও ইত্যাদির বিষয় বৈচিত্র্য, নির্মাণ সবকিছুতেই ছিল মুনশিয়ানা।

এবারের ইত্যাদির মাধ্যমেই দর্শক দেখলেন অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা উপমহাদেশের সেরা প্রাচীন গৌরবে ভাস্বর বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি। সম্ভবত এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দর্শক প্রায় দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্যের অংশগ্রহণে উপভোগ করলেন রাজশাহীকে নিয়ে করা অসাধারণ একটি পুলিশ নৃত্য। যেখানে নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে দেখা গেছে কয়েক হাজার পুলিশ সদস্যের কুচকাওয়াজও। আর এই সাড়ম্বর নির্মাণ কেবল হানিফ সংকেতের দ্বারাই সম্ভব। রাজশাহীকে নিয়ে করা প্রতিবেদনে খুব স্বল্প সময়ে হানিফ সংকেত বুঝিয়ে দিলেন সিল্ক কাপড়ের অজানা রহস্য। দেশের মানুষের কাছে পুলিশ একাডেমিকে তুলে ধরলেন নান্দনিক উপায়ে। সমাজের নানান অসঙ্গতিকে তুলে ধরার পাশাপাশি এবারের ইত্যাদিতে ছিল অনেকগুলো শিক্ষা, তথ্য, সচেতনতা ও মানবিক প্রতিবেদন। ছিল অনেকগুলো চোখ-ভেজা প্রতিবেদন। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে একটি পুরনো সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে মানুষের পারাপারের সুবিধার জন্য সাঁকো নির্মাণ করছেন বগুড়ার দিকদাইড় গ্রামের জাহিদুল ইসলাম। এ পর্যন্ত বানিয়েছেন পাঁচ শতাধিক সাঁকো। অনেকেই তাকে নিয়ে ইতিপূর্বে লিখেছেন, কেউ কেউ তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন কিন্তু জাহিদুলের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সহযোগিতার হাত বাড়াননি কেউ, বরং ভিডিও নির্মাণ করে জাহিদুলকে নিয়ে ব্যবসা করেছেন। তবে ইত্যাদিতে এসে জাহিদুল খুব খুশি। কারণ তার কাজকে গতিশীল করার জন্য ইত্যাদি তাকে একটি মোটরসাইকেল দিয়েছে। সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদনের এক অসাধারণ প্রতিবেদন দেখালেন হানিফ সংকেত। এতিম শিশুদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য যে দম্পতি ভিক্ষাও করেছেন। শুধু তাই নয়-শমেস ডাক্তার ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা বর্তমানে ২৩৫ সদস্যের শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে এক পাকে খাবার খান। যা আমাদের বর্তমান সমাজে অকল্পনীয়। প্রতিবেদনটি অনেকের চোখেই পানি এনে দিয়েছে। আমরা অনেকেই শকুনকে অশুভ বলে জানি কিন্তু শকুন যে কতটা শুভ তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবারের ইত্যাদি দেখে। এই উপকারী প্রাণীটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। অর্থাৎ ৪ কোটি থেকে এখন মাত্র ২৬০টি। ইত্যাদির এই অনুসন্ধানী রিপোর্টটি শকুন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রবল প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিয়ে হানিফ সংকেত গেছেন সীমান্তবর্তী চরখিদিরপুরে। ভাঙনের কবলে এখানে ৪টি গ্রামের ৩টিই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিনিয়তই এখানে ভাঙছে নদী, কাঁদছে মানুষ। নদী ভাঙা মানুষগুলোর যাওয়ার আর জায়গা নেই, পাশেই সীমান্ত। ভাঙনকবলিত এই মানুষগুলোর কান্না দেখে দর্শকদের চোখেও পানি এসে গেছে। হানিফ সংকেতের সঙ্গে আমরাও একমত, এই মানুষগুলোর পুনর্বাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগিয়ে আসা উচিত। এবারের ইত্যাদির চিঠিপত্র বিভাগটিও ছিল বেশ ব্যতিক্রমী। চিঠিপত্রের মাধ্যমে দর্শকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধানমন্ডি লেকের অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা পরিবেশ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে অবহিত করা হয়। ইত্যাদির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আকস্মিকভাবে তিনি লেক পরিদর্শনেও যান। ইত্যাদির সাফল্য হচ্ছে, অনুষ্ঠানটি প্রচারের পরদিন থেকেই ধানমন্ডি লেকে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করা হয়েছে। সেজন্য মাননীয় মন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুষ্ঠানের শেষে ইত্যাদির প্রায় নিয়মিত শিল্পী, রাজশাহীরই সন্তান কণ্ঠ সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের সমাধিতে হানিফ সংকেতের বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন দেখে নিজের অজান্তেই দর্শকদের চোখ ভিজে গিয়েছিল। দীর্ঘ তিন দশকে এমনি অনেক সাফল্য গাঁথা রয়েছে ইত্যাদির ঝুলিতে। ইত্যাদি সবসময় শিকড়ের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। দেশের ভালো মনের মানুষগুলো ইত্যাদির মাধ্যমে আলোর সন্ধান খুঁজে পায়। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয় ইত্যাদির তীক্ষ দৃষ্টি। ইত্যাদির চোখে মানুষ দেখে আজ ভালো আর আলোর প্রতিচ্ছবি। ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের মানুষ তাদের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হন। অনুসরণ করেন তাদের আদর্শ, আর এখানেই ইত্যাদির জনক হানিফ সংকেতের কৃতিত্ব। তাই বলা যায় মানুষকে ভালো মানুষ হওয়ার আলোর পথ দেখানোর সুন্দর কাজটিই করে যাচ্ছে ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে। আর এসব ভালো কাজের মধ্যেই ইত্যাদি বেঁচে থাকবে চিরকাল। ধন্যবাদ হানিফ সংকেত। উল্লেখ্য, আজ রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের পর বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে একযুগে প্রচার হবে ইত্যাদির পুনঃপ্রচার।

সর্বশেষ খবর