বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সরকারি অনুদান নিয়ে আর কত নয়ছয়

গত ১০ বছরে অনুদান পেয়েছে ৭৪ ছবি ॥ ৪৯টির খবর নেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

সরকারি অনুদান নিয়ে আর কত নয়ছয়

চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান মানেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাকাটা মেরে দেওয়া। সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ। তদারকির কোনো বালাই নেই। মাঝে একবার সময়মতো অনুদানের ছবি নির্মাণ করতে না পারা কয়েকজন নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল, ব্যস ওই পর্যন্তই, খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে পার পায় অভিযুক্তরা। গত মাসে এক নির্মাতাকে গ্রেফতার করা হয় পরে আবার তাকে জামিনও দেওয়া হয়। সম্প্রতি অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণে নতুন কিছু শর্ত আরোপ করেছে সরকার। চলচ্চিত্রকাররা বলছে শুধু শর্ত আরোপ করে বসে থাকলে চলবে না। যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা না করলে চলচ্চিত্র নির্মাণে দেওয়া সরকারি অর্থ মেরে খাওয়া চলতেই থাকবে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনুদানের পরিমাণ জেনেই ছবি নির্মাণে অনুদানের জন্য আবেদন করে। পরে আবার এই অর্থ যথেষ্ট নয়সহ নানা অজুহাত দেখিয়ে ছবি নির্মাণে বিলম্ব করে এবং অনেকেই আবার ছবি নির্মাণ না করেই অনুদানের অর্থ আত্মসাৎ করে। এই অসাধু প্রবণতা বন্ধ না হলে সরকারি অনুদানে ছবি নির্মাণ বা নির্মাণের প্রকৃত লক্ষ্য ব্যাহত হবে।

বাংলাদেশ সরকার মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৭৬-৭৭ সাল থেকে চলচ্চিত্রে অনুদানের প্রথা চালু করে। এ পর্যন্ত ১৪১টি ছবি অনুদান পায়। এর মধ্যে অর্ধশতাধিকেরও বেশি ছবি আলোর মুখ দেখেনি। কমপক্ষে ১০ বছরের চিত্রে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে অনুদান দেওয়া হয়েছে ৭৪টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে। মুক্তি পেয়েছে মাত্র ২৫টি, মুক্তি পায়নি ৪৯টি।

চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালায় বলা আছে, অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে ছবির কাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় অনুরোধ সাপেক্ষে পরিচালক ওই সময় বৃদ্ধি করতে পারেন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক নির্মাতা ছবি নির্মাণে বছরের পর বছর সময় পার করছেন। মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশের কারণে তারা এ ধরনের কাজ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে নির্মাতাদের কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হয় না। অনুদানের অর্থ নিয়ে সময়মতো ছবি নির্মাণ না করায় গত মাসে টোকন ঠাকুরসহ বেশ কজন নির্মাতার নামে মামলাও হয়েছে এবং গ্রেফতার হয় টোকন ঠাকুর। তাকে ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে ‘কাঁটা’ ছবির জন্য অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছবিটির নির্মাণ কাজ শেষ করেননি তিনি। পরে অবশ্য আবার জামিনও পেয়ে যান। অনুদান নিয়ে ছবি জমা না দেওয়ার রেওয়াজটা শুরু হয় প্রথম অর্থ বছর থেকেই। চারটি ছবির একটিও সময়মতো মুক্তি দিতে পারেননি নির্মাতারা। মসিহ্উদ্দিন শাকের-শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে, বাদল রহমানের শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ মুক্তি পায় ১৯৮০ সালে। কবির আনোয়ারের ‘তোলপাড়’ মুক্তি পায় অনুদান পাওয়ার এক দশক পর, ১৯৮৮ সালে। বেবী ইসলামের ‘মেহেরজান’ আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

২০১১-১২ অর্থবছরে ‘নেকড়ে অরণ্য’র জন্য প্রথম কিস্তির টাকা গ্রহণ করার পরও ছবির কাজ শুরু করতে না পারায় মারুফ হাসান আরমানের বিরুদ্ধে মামলা করে তথ্য মন্ত্রণালয়। অভিযোগ রয়েছে, অনুদানের টাকা দিয়ে তিনি জমি কিনেছেন। শিশুতোষ ছবি ‘একা একা’র জন্য অর্থ বরাদ্দ পেয়েছিলেন সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। ছবি নির্মাণ না করায় গুণী এই নির্মাতার বিরুদ্ধেও অর্থ আদায়ের জন্য মামলা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে নির্মাতা তারেক মাসুদ ‘কাগজের ফুল’-এর জন্য অনুদান পান। প্রথম কিস্তির অর্থ পাওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। পরে প্রযোজক ক্যাথরিন মাসুদ অর্থ ফেরত দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় ছবিটি নির্মাণের অনুরোধ করে ক্যাথরিনকে। সেই ছবি আজও নির্মাণ হয়নি। একই বছরে অনুদান পাওয়া নারগিস আক্তারের ‘যৈবতী কন্যার মন’, টোকন ঠাকুরের ‘কাঁটা’ মুক্তির মুখ দেখেনি এখনো। ‘কাঁটা’ নির্মাণ না করায় টোকন ঠাকুরের বিরুদ্ধে ও ‘যৈবতী কন্যার মন’-এর জন্য নারগিস আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। পরে নার্গিস আক্তার সময় চেয়ে গত বছর ছবিটির নির্মাণ কাজ শেষ করলেও করোনার কারণে এখনো ছবিটি মুক্তি দিতে পারেননি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মুক্তি পায়নি ড্যানি সিডাকের ‘কাসার থালায় রূপালী চাঁদ’ ও জাঁ নেসার ওসমানের শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘পঞ্চসঙ্গী’। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মুক্তি পায়নি ‘বিউটি সার্কাস’। এর পরিচালক মাহমুদ দিদার ও নুরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মুক্তি পায়নি সারা আফরীনের ‘শঙ্খধ্বনি’। এটি বর্তমানে ‘শিকলবাহা’ নামে নির্মিত হচ্ছে।  পরিচালনা করছেন কামার আহমাদ সাইমন। অন্যদিকে লোরা তালুকদার প্রযোজিত ‘বৃদ্ধাশ্রম’ সেন্সর ছাড়পত্র পেলেও এখনো মুক্তি পায়নি। নির্মাতা পান্থ প্রসাদ ‘সাবিত্রী’র শুটিংই শেষ করেননি এখনো। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে কিছু শুটিং হয়েছে শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব সুন্দর’ ছবিটির। এ ছবির নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘আজব কারখানা’। শুটিং শুরু হয়নি কমল সরকারের ‘দায়মুক্তি’ ছবিটির। সোহানুর রহমান সোহানের ‘প্রিয় জন্মভূমি’ ও ফেরদৌস আলম সিদ্দিকীর প্রামাণ্যচিত্র ‘একজন মরিয়ম’ নির্মাণ আটকে আছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছে গাজী রাকায়েতের  ‘গোর’, মানিক মানবিকের আজব ছেলে, আবিদ হোসেন খান  (অবলম্বন), সাইদুল আনাম টুটুল (কালবেলা) ও হাবিবুর রহমানের (অলাতচক্র)। ‘অবলম্বন’ শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রের জন্য অনুদান পান রুবাইয়াত হোসেন। গোর ছাড়া অন্যগুলোর খবর নেই। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এ বছরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে সরকারি অনুদান পেয়েছেন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী ও পরিচালক কবরী, অভিনেতা মীর সাব্বির ও হৃদি হক। এ ছাড়া অনুদান পেয়েছেন আকরাম খান, হোসনে মোবারক রুমি। মীর সাব্বির নির্মাণ করবেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রাত জাগা ফুল’। হৃদি হক নির্মাণ করবেন ‘১৯৭১ সেইসব দিন’। কবরী নির্মাণ করছেন ‘এই তুমি সেই তুমি’ । ‘বিধবাদের কথা’ নামে সিনেমা নির্মাণ করবেন আকরাম খান। হোসনে মোবারক রুমি নির্মাণ করবেন ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’। প্রামাণ্যচিত্র শাখায় হুমায়রা বিলকিস নির্মাণ করবেন ‘বিলকিস এবং বিলকিস’ ও পূরবী মতিন ‘মেলাঘর’।  শিশুতোষ শাখায় আবু রায়হান মোহাম্মদ জুয়েল নির্মাণ করবেন ‘নসু ডাকাত কুপোকাত’। এসবের একটি ছবিও মুক্তি পায়নি এখন পর্যন্ত। তবে মোহাম্মদ জুয়েল ‘নসু ডাকাত কুপোকাত’ নাম পরিবর্তন করে ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ হিসেবে ছবিটির শুটিং প্রায় শেষ করে এনেছেন। অন্যদিকে কবরী তার ছবির শুটিং ফের শুরু করেছেন চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ‘টুঙ্গিপাড়ার দুঃসাহসী খোকা’ শিরোনামে চলচ্চিত্রের জন্য সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টাকা অনুদান পাচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মুশফিকুর রহমান গুলজার। ‘কাজলরেখা’ শিরোনামে চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান পাচ্ছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম;  নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদ ‘শ্যামা কাব্য’ চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান হিসেবে পাচ্ছেন। তালিকায় আরও আছে প্রদীপ ঘোষের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, এম এন ইস্পাহানির প্রযোজনা ও ইস্পাহানি আরিফ জাহানের পরিচালনায় ‘হৃদিতা’, ফজলুল কবীর তুহিনের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘গাঙকুমারী’, অনুপম কুমার বড়ুয়ার প্রযোজনা ও সন্তোষ কুমার বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘ছায়াবৃক্ষ’, রওশন আরা রোজিনার প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘ফিরে দেখা’, তাহেরা ফেরদৌস জেনিফারের প্রযোজনা ও মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের পরিচালনায় ‘আশীর্বাদ’, ইফতেখার আলমের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘লেখক’, আবদুল মমিন খানের প্রযোজনা ও মনজুরুল ইসলামের ‘বিলডাকিনী’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে অনুদান পেয়েছে পংকজ পালিতের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘একটি না বলা গল্প’, অনম বিশ্বাসের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘ফুটবল ৭১’ ও এস এ হক অলিকের ‘যোদ্ধা’ ছবি তিনটি। শিশুতোষ দুটি চলচ্চিত্রে আমিনুল হাসান লিটুর প্রযোজনা ও আউয়াল রেজার পরিচালনায় ‘মেঘ রোদ্দুর খেলা’ ও নুরে আলমের প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘রাসেলের জন্য অপেক্ষা’ ছবি দুটি অনুদান পেয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু ছবি শুটিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও বেশিরভাগ ছবিরই কোনো খোঁজ নেই।

অনুদানের অর্থে ছবি নির্মাণ করা নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাতা বলেন, ‘একটি ছবি নির্মাণ করতে দেড় বছরের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। অনুদান প্রদান কমিটিতে দুর্বলতা থাকতে পারে। তাই অনুদানের ছবির এই বেহাল দশা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অ্যাকশনে আছি। যে ছবিগুলো এখনো নির্মিত হয়নি, সেগুলো যাতে হয় এ জন্য  নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছি।  তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘নেকড়ে অরণ্য’ ছবির জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত পরিচালক মারুফ হাসান আরমান, একই অর্থবছরে ‘একা একা’ চলচ্চিত্রের জন্য সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘যৈবতী কন্যার মন’ চলচ্চিত্রের জন্য নারগিস আক্তার, একই অর্থবছরে ‘খাঁচা’ চলচ্চিত্রের জন্য খান শরফুদ্দীন মোহাম্মদ আকরাম ও ‘কাঁটা’ চলচ্চিত্রের জন্য টোকন ঠাকুরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, সরকারি অনুদানের ছবি কে দেখে, কোথায় প্রদর্শন হয়, এসবের নির্মাণকাজ কখন শেষ হয়, আদৌ শেষ হয় কিনা এই বিষয়গুলো সরকারসহ কেউই জানে না। মানে সরকারি অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করার এক বিরাট খাতের নাম হচ্ছে ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান প্রথা’। এই  প্রথা বন্ধ করে ওই অর্থ যারা নিয়মিত ছবি নির্মাণ করেন তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জনকে দেড় কোটি টাকা করে দিয়ে শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে তারা সময়মতো মানসম্মত ছবি নির্মাণ করলে এবং সেই ছবি সফল হলে সেই সব নির্মাতাকে নিয়মিত অনুদান দেওয়া যেতে পারে।

চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ সম্প্রতি বলেন, ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান নিয়ে ঠিক সময়ে সিনেমার নির্মাণকাজ শেষ করতে না পারার জন্য অবশ্যই নির্মাতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

সর্বশেষ খবর