শিরোনাম
শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাড়ছে অনলাইনভিত্তিক আবৃত্তি চর্চা

নব্বই দশকের পরই মূলত আবৃত্তি সাংগঠনিক রূপ নেয়। এখন আবৃত্তি প্রতিষ্ঠিত একটি শিল্প ও সাংগঠনিক চর্চার জায়গা। তবে করোনাকালে জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। আবৃত্তি চর্চা হয়ে পড়েছে অনলাইনভিত্তিক। এই নতুন মাধ্যমে আবৃত্তিশিল্পের প্রচার ও প্রসার নিয়ে লিখেছেন -পান্থ আফজাল

বাড়ছে অনলাইনভিত্তিক আবৃত্তি চর্চা

অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের মতো আবৃত্তিশিল্প চর্চাও দিন দিন হয়ে পড়ছে অনলাইননির্ভর। মাধ্যম হিসেবে সহজ ও সুবিধাজনক হওয়ায় এখন দলের আবৃত্তি চর্চা, প্রতিযোগিতা, সাংগঠনিক মিটিং, প্রশিক্ষণ ও উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে।

বাংলা ভাষায় আবৃত্তির নবতর প্রসার ঘটে বিশ শতকের গোড়ার দিকে। আবৃত্তির মোড় ঘুরে যায় আধুনিক বাংলা কবিতার উন্মেষ পর্বে। আবৃত্তি সব শাস্ত্রের বোধের চেয়েও গৌরবের। প্রয়োগ শিল্পের কনিষ্ঠতম হলেও আবৃত্তি সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম বাচিকশিল্প। একজন আবৃত্তিশিল্পী নৈপুণ্যময় আবৃত্তির মাধ্যমে শ্রোতাদের শ্রুতি-অনুভবে এবং চোখের সামনে কবিতার রূপায়িত দৃশ্যকে উপস্থাপন করতে পারেন। সৃজনশীলতার কারণেই আবৃত্তিকার একজন শিল্পী এবং আবৃত্তি একটি শিল্প। ১৯৮৫ সালে আবৃত্তি ফেডারেশন ও ১৯৯২ সালে আবৃত্তি শিল্পী সংসদ গড়ে ওঠার পর বৃহত্তর প্রয়োজনে ১৯৮৯ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের। সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চার ফলে আবৃত্তিশিল্পী, প্রশিক্ষক, সাংগঠনিক কর্মী, সংবাদ উপস্থাপক, রিপোর্টার, অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং নাট্যকর্মীসহ অন্য মাধ্যমে অনেক বাচিক শিল্পী সৃষ্টি হয়েছে। এরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে মেলবন্ধনে আবদ্ধ রাখতে সব সময় সচেষ্ট। আবৃত্তির প্রতি টিনএজাররাও ঝুঁকছে এখন। আবৃত্তি শিখে অনেকে বেশ নামও কুড়িয়েছে এবং কুড়াচ্ছে। আবৃত্তিচর্চা এখন শুধু আবৃত্তি শিল্পীই তৈরি করে না, বেশ কিছু বাচিক শিল্পী তৈরিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে আবৃত্তিচর্চা। শুধু তা-ই নয়, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুটনেও আবৃত্তিচর্চা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি, সঙ্গে ভাবের একটু সঠিক ব্যবহার একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অসাধারণ করে তোলে। তিন দশকের অধিক বাংলাদেশে সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা চলছে। সংখ্যার বিচারে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের চেয়ে আবৃত্তি অনেকটাই এগিয়ে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়তে এর সাংগঠনিক শক্তির যথাযথ ব্যবহার আমরা করতে পারছি না। অভিযোগ রয়েছে, সংগঠনগুলো মানসম্মত প্রযোজনা মঞ্চায়নের মাধ্যমে আবৃত্তির দর্শক তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর এখন চলছে করোনাকাল। তবে থেমে নেই আবৃত্তিচর্চা। ফিজিক্যালি একত্রিত না হতে পারলেও দেশের ছোট-বড় আবৃত্তি দলগুলো এখন নিয়মিত আবৃত্তিচর্চা, মিটিং, প্রশিক্ষণ, প্রতিযোগিতা বা উৎসব করছে অনলাইনে। অনলাইনে বাড়ছে আবৃত্তি চর্চা।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের (ঢাকা জোন) সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান উল্লাহ তমাল বলেন, ‘করোনাকালে দল ও সংগঠনগুলোর একসঙ্গে বসা না হলেও নিয়মিত চলছে অনলাইনে আবৃত্তি চর্চা। সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা হচ্ছে, তবে বিকল্প এ মাধ্যমে। যেহেতু ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখাটা জরুরি সেহেতু আবৃত্তির দলগুলো জুম বা স্টিমইয়ার্ডে আয়োজন করছে তাদের অনুষ্ঠান। মোট ৩০০টির মধ্যে ঢাকাতে রয়েছে ৯০টি আবৃত্তি সংগঠন। তাদের মধ্যে বড় দল থেকে ছোট দলগুলোই বেশি সরব। অনলাইন মাধ্যম সুবিধাজনক। কারণ, এখানে মঞ্চ ভাড়া, মিউজিসিয়ান, কস্টিউম, লাইট লাগছে না। যারা আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, নিয়মিত আবৃত্তি চর্চার সুযোগ ছিল না-তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে নিয়মিত আবৃত্তি চর্চা করছে। তবে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ করোনাকালের শুরু থেকেই দেশের সব আবৃত্তিশিল্পীদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ঠিক রাখতে নিয়মিত আয়োজন করে চলেছে ‘ছুটির বিকেলে’, ‘জ্বালাও আলো আপন আলো’, এই তো জীবন এই তো মাধুরী’র মতো আবৃত্তি আয়োজনের।’

জানা যায়, এই কঠিন সময়েও সিলেটের মৃত্তিকার মহাকাল, চট্টগ্রামের কণ্ঠনীড় ও নির্মাণ আবৃত্তি অঙ্গন, খুলনার আবৃত্তি স্কুল, সিলেটের শ্রুতি, ফরিদপুরের অঙ্কুর, রাজবাড়ীর প্রিয়তমাসু আবৃত্তি নিকেতন, ঢাকার কিংবদন্তি আবৃত্তি পরিষদ, কণ্ঠশীলন, স্বরশ্রুতি, স্বরব্যঞ্জন, মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, মাদারীপুরের মাত্রা ও উদ্ভাস, ঢাকা স্বরকল্পন, হরবোলাসহ বেশ কিছু দল নিয়মিত আয়োজন করছে আবৃত্তির আয়োজন। 

অনলাইন আবৃত্তি চর্চার অন্যতম প্ল্যাটফরম ‘আবৃত্তি অনলাইন’। প্রোথিতযশা আবৃত্তিশিল্পীদের নিয়ে নিয়মিত লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করে চলেছে এটি। ভার্চুয়াল এই প্ল্যাটফরমটি প্রতি সপ্তাহে আবৃত্তির লাইভের পাশাপাশি আবৃত্তি বিষয়ক আলোচনা ‘আবৃত্তি কথন’ এবং অডিও পডকাস্ট ‘হ্যালো নিশুতি’ প্রচার করছে পাক্ষিকভাবে। অনুষ্ঠানের মডারেটর জাকিয়া জেসমিন, ‘দেশের ও দেশের বাইরের পরিচিত আবৃত্তিকারদের নিয়ে আবৃত্তি অনলাইন’-এর ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ এবং ইউটিউব চ্যানেলে আয়োজনটি সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে নিয়মিত।’ আবৃত্তি অনলাইনে কাজ করছেন সিঙ্গাপুর থেকে জাকিয়া জেসমিন, কানাডা থেকে কামরান করিম ও মেরি রাশিদিন, সুইজারল্যান্ড থেকে সোহেল আজাদ, বাংলাদেশ থেকে জয়দেব সাহা, ফারহানা তৃণা, নুসরাত রাইসা এবং সোলায়মান রিপন।

সোশ্যাল ডিসট্যান্সের কারণে অনলাইনে আবৃত্তি চর্চা বেড়ে যাওয়ার ফলে তবে কি টিএসসিকেন্দ্রিক আবৃত্তি চর্চা ব্যাহত হচ্ছে! সাংগঠনিক চর্চা স্থবির হয়ে যাচ্ছে! এ বিষয়ে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আবৃত্তি চর্চার প্রসারে সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন মূলত বিভিন্ন আবৃত্তি সংগঠনগুলো দায়িত্ব নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আবৃত্তিকে একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ।’

আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একটা স্তর অতিক্রম করার পর ব্যক্তিগত চর্চা খুবই জরুরি। কারণ, তখন নিজেকে এবং এই শিল্পকে জনপ্রিয় করতে ব্যক্তিগত চর্চার দরকার হয়। শুরুটা সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চায় হোক, এরপর নিজের বিকাশের জন্য ব্যক্তিগত চর্চা। সেটা এই সময় হচ্ছে।  এটা ভালো দিক।’

সর্বশেষ খবর