সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

এক মহাযুগের অবসান

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলা চলচ্চিত্রের অমর অধ্যায়। ভারতবর্ষের কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে তার শেকড়। তার মহাপ্রয়াণে এপার বাংলার মানুষও সমব্যথি। তাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও আলী আফতাব

এক মহাযুগের অবসান

৪০ দিনের লড়াই শেষে ৮৬ বছরে শেষ হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মময় পথচলা। মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলেন এই ডাকসাইটে অভিনেতা। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। করোনাই যেন অনুঘটকের মতো সৌমিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেল না-ফেরার দেশে। গতকাল দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই অভিনেতা। শুধু সিনেমা নয়, সাহিত্য, রাজনীতি, কবিতা- সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি।

১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ জন্ম হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কয়া গ্রামে। তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠাকুরদার সময় থেকেই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। বাবার বদলি চাকরির কারণে ক্লাস ফাইভের পর হাওড়ায় চলে আসেন সৌমিত্র। সেখানেই স্কুলে পড়াশোনা। প্রথম থেকেই কবিতা, আবৃত্তি, সাহিত্য, বাম রাজনীতির দিকে ঝোঁক ছিল প্রচুর। তাই সৌমিত্র মানেই যে শুধু অভিনেতা তা নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন সংস্কৃতির নানা দিকে।

ছিপছিপে চেহারা, উজ্জ্বল চোখ ও মন খোলা হাসি। সৌমিত্র মানেই দীর্ঘাঙ্গি সু-পুরুষ নায়ক। উত্তমের পর সে সময় মেয়েদের মনে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন সৌমিত্রই। বাংলা-ঘটির লড়াইয়ে সব সময়ই উত্তম-সৌমিত্র কেন্দ্রবিন্দু। ফ্যানেরাও দুই ভাগ। একদিকে যখন উত্তমের নামে বক্স অফিসে দৌড়াচ্ছে, অন্যদিকে সৌমিত্রও তাঁর স্টাইলে চমক দেখিয়েছেন। তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দি’ ছবিতে উত্তম-সৌমিত্রের অভিনয়ের লড়াই তাক লাগিয়েছিল সবাইকে। পর্দায় যেন অভিনয়ের যুদ্ধ। তবে শুধুই ঝিন্দের বন্দি নয়, দেবদাস, স্ত্রী, যদি জানতাম ছবিতেও উত্তম-সৌমিত্রকে একই সঙ্গে অভিনয় করতে দেখেছে সিনেমাপ্রেমী মানুষ। কখনো রোমান্টিক, কখনো লড়াই করা মধ্যবিত্ত যুবকের চরিত্রে সৌমিত্র বাঙালির ঘরে জায়গা করে নিয়েছেন। বাণিজ্যিক ছবি থেকে অন্য ধারার ছবিতেও সমানভাবে ছাপ ফেলেছিলেন সৌমিত্র। তবে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয়ই তাঁকে গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় করেছিল।

১৯৫৯ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অপুর সংসার ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র বলেছিলেন, অপুর সংসার ছবিতে প্রথমবার নাকি সৌমিত্রকে নিতেই চাননি সত্যজিৎ রায়। পরে অবশ্য সৌমিত্রকেই সবচেয়ে পছন্দ হয় তাঁর। গল্পের বই থেকে সোজা যেন সিনেমার পর্দায় এসে দাঁড়ান সৌমিত্র। সত্যজিতের তৈরি ফেলুদা চরিত্র যেন তাঁকে ভেবেই লিখেছিলেন। সত্যজিতের আঁকা ফেলুদার ইলাস্ট্রেশনও অবিকল যেন সৌমিত্রের মতোই।

তাই তো বাঙালি সৌমিত্র ছাড়া ফেলুদা হিসেবে কাউকেই মানিয়ে নিতে পারে না। সিনেমাটা বড্ড ভালোবাসতেন তিনি। তাই হয়তো করোনাকালেও শুটিং ফ্লোরে যাওয়ার জন্য ছটফট করতেন। এই বয়সেও ভালো ছবিতে অভিনয় করার জন্য খিদে ছিল ষোলোয়ানা। তাই তো এই বয়সেও একের পর এক বক্স অফিসে সুপারহিট সব ছবি। ‘বেলাশেষে’, ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘বসু পরিবার’, ‘সাঁঝবাতি’, তার প্রমাণ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় সিনেমার এই অধ্যায়ের শেষ। বাংলা সিনেমার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

 

এপার বাংলার ছেলে সৌমিত্র

উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে। বিখ্যাত চ্যাটার্জি পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি।

চ্যাটার্জি পরিবারের প্রধান ছিলেন মধুসূদন চ্যাটার্জি। তিনি এলাকার সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। ভূপতি হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা। কয়ায় যে জায়গাটিতে বর্তমানে বাঘা যতীন কলেজ, ঠিক এই জায়গাটিতে বিশাল এলাকাজুড়ে চ্যাটার্জি পরিবারের বসতভিটা ছিল। কয়ার চ্যাটার্জি বাড়ির পরিচিতি শুধু কুষ্টিয়া নয়, ভারতবর্ষেও বিশেষ পরিচিতি আছে।

 

‘আমি বাংলাদেশের মানুষ’

বেশ কয়েক বছর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন। একটা নামি দৈনিকে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিল। সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম-আপনাকে যদি লালন সাঁই চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেওয়া হয়, আপনি কি তা গ্রহণ করবেন? উত্তরে তিনি কয়া গ্রামকে নিজের গ্রাম উল্লেখ করে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। উত্তরটা এরকম ছিল ‘প্রস্তাব পেলে সেটা তো আমার জন্য সম্মানের। আমার শরীরে তো কয়া গ্রামের মাটি। আমার পূর্বপুরুষরা কয়া গ্রামের মানুষ। কয়া আর ছেঁউড়িয়া তো পাশাপাশিই। তাই আমাকে বাংলাদেশের মানুষ ভাবতে ভালোবাসি। আমি তো লালন চরিত্র  সবচেয়ে ভালো আত্মস্থ করতে পারব। কিন্তু আমার যে বয়স, সেটাও তো ভাবতে হবে আমাকে।’ এতেই অনুভূত হয় কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চেতনে মননে কয়া গ্রামের সন্তান, তাঁর শেকড় তো গ্রোথিত কয়ার মাটিতেই।

 

শিক্ষা ও ব্যক্তিজীবন

সৌমিত্রের মাতা আশালতা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন গৃহিণী। পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় আইনজীবী। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জনস বিদ্যালয়ে। তারপর পিতার চাকরি বদলের কারণে তাঁর বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং তিনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জেলা স্কুল থেকে। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি ও পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাসের পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অব আর্টসে পড়াশোনা করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়। পুত্র সৌগত চট্টোপাধ্যায় ও কন্যা পৌলমী বসু।

 

যেভাবে অভিনয়ে

‘পারিবারিক স্মৃতি’ নামের একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সৌমিত্র পরিবারের গভীরতম সম্পর্কের কথা। সৌমিত্রের পিতামহ মধুসূদন ভালো অভিনয় জানতেন। বাবার কাছ থেকে এটা পেয়েছিলেন পুত্র মোহিতকুমার চ্যাটার্জি। তিনিও বাবার মতো অভিনয় করতে ভালোবাসতেন এবং অসাধারণ কবিতা আবৃত্তি করতেন। পুত্র সৌমিত্র পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন এসবের হাতেখড়ি। ভারতবর্ষের কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

 

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতে অভিনয় করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করেন। সত্যজিৎ রায় যেমন সৌমিত্রকে গড়ে তুলেছেন, তেমনি সৌমিত্রও সত্যজিৎকে প্রকাশিত হতে সাহায্য করেছেন। তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় তাঁকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লেখা হয়। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সব থেকে জনপ্রিয় হলো ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তাঁর অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তি পাওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারত না। তিনি সত্যজিৎ রায় ছাড়াও বাংলা ছবির প্রায় সব মননশীল পরিচালক- সেই সময় থেকে এই সময়ের, সবার ছবিতেই অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি নাটক, যাত্রা এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন। একজন খুব উঁচুদরের আবৃত্তিকারও ছিলেন।

 

যেভাবে জাঁদরেল অভিনেতা

সৌমিত্রের একবার টাইফয়েড হয়েছিল। ৬৩ দিন উচ্চতাপমাত্রার জ্বর নিয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও চিকিৎসক আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুকে স্পর্শ করেই যেন তিনি আবার নতুন জীবন পেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সৌমিত্র বলেছিলেন, সৃষ্টিকর্তার ইশারায় আমি কীভাবে রক্ষা পেলাম। সুস্থ স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরে দেখলাম আমার স্বাস্থ্য ভেঙে একাকার। চেহারা কুৎসিত। দেহ শক্তিহীন। মনের সঙ্গে লড়তে লাগলাম। যা এখন আছি তার ওপর আমাকে নতুন চরিত্র আরোপ করব। কুৎসিত আমি সুশ্রী হব। ভগ্নস্বাস্থ্যের বিপরীতে স্বাস্থ্যবান হব। কর্মহীনের বিপরীতে কর্মে সক্ষম হব। আমি ব্যক্তি চরিত্রের ওপর আরাধ্য চরিত্র উপস্থাপন করব। আর তার জন্য আমাকে কর্মক্ষম হতে হবে। লড়তে হবে। প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই, অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই। এই দৃঢ় প্রত্যয়ই তাঁকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় করে তুলেছিল।

 

যত সম্মাননা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘Officier des Arts et Metiers’ পেয়েছেন। সত্তরের দশকে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ পান কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে পান সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার। দুবার চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান, ২০০১ ও ২০০৮ সালে। ২০১২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে লাভ করেন।

 

সৌমিত্রের নায়িকা

ববিতা শোকাহত

অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই- এ খবরে মন খারাপ তাঁর সহশিল্পী বাংলাদেশি অভিনয়শিল্পী ববিতার। ববিতা বললেন, ‘তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। এ খবরে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। কত স্মৃতি আমাদের।’ ১৯৭৩ সাল ববিতার অভিনয়জীবনের সেরা বছর। ওই বছরই ববিতা অভিনীত অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ মুক্তি পায়। এই সিনেমায় তিনি সৌমিত্রের স্ত্রী ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রশংসিত হন দেশ-বিদেশে। ‘অশনি সংকেত’ ছবির শুটিং সময়ের স্মৃতি মনে করে ববিতা জানালেন, ‘অশনি সংকেত’ ছবির পরও সৌমিত্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ বেশ আন্তরিক ছিল। যখনই বাংলাদেশে কোনো কাজে আসতেন, কথা হতো। দেখাও হতো। খুব অসাধারণ সময়ও কাটত। ববিতা বলেন, ‘শুধু একটা কথাই বলব, যেখানেই থাকুন চির শান্তিতে থাকুন সৌমিত্র দা। শারীরিকভাবে আপনি আর আমাদের মাঝে নেই, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এ দেশের মানুষের অন্তর থেকে কখনো আপনার বিনাশ হবে না। আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন চিরকাল, চিরদিন। অমর হয়ে থাকবেন এ বাংলার মাটিতে, মননে আর মানুষের মগজে।’ তিনি বলেন, মনের দিক দিয়ে সৌমিত্র দা বেশ শক্ত ছিলেন। আমি তো শুনলাম, এই করোনার মধ্যেও নাকি তিনি সপ্তাহ দু-এক আগে কীসের যেন শুটিং করছিলেন। ববিতা সৌমিত্রের আত্মার সদগতি ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, এ হারানোর কষ্ট কখনো ভোলার নয়।

 

অপুর সংসার থেকে বেলাশেষে

‘অর্থ, কীর্তি বা সচ্ছলতা নয়। ভিতর থেকে সার্থকতার বোধ না এলে অভিনেতা ফুরিয়ে যান।’ সৌমিত্র নিজেই লিখেছেন এ কথা। চরিত্রের জন্য আজীবন লোভ ছিল তাঁর। নানা চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছাটুকুকে জিইয়ে রেখেছিলেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। খুব গর্ব করে বলতেন, মানিকদা অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় তাকে বারবার নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন। তপন সিনহাও তাই। এমনকি তরুণ মজুমদারের কাছেও ভিন্ন চরিত্রই পেয়েছেন তিনি। তাই নিজের অভিনয় ক্ষমতার ভার্সাটিলিটি নিয়ে এক ধরনের তৃপ্তি ছিল সৌমিত্রের। অথচ জীবনের প্রথম স্ক্রিন টেস্টেই ফেল। ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ ছবিতে স্ক্রিন টেস্ট দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে নেওয়া হয় অভিনেতা অসীম কুমারকে। ‘অপরাজিত’র স্ক্রিন টেস্ট করছেন তখন সত্যজিৎ রায়। মানিক বাবুর চিফ অ্যাসিসট্যান্ট সৌমিত্রকে নিয়ে গেলেন তার কাছে। তাকে দেখেই মানিক বাবু বলে ওঠেন, ‘ইশ, আপনার বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে’। এরপরের কথা সৌমিত্র গেছেন সত্যজিতের ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং দেখতে। ছবি বিশ্বাসের কাছে ধরে নিয়ে যান সত্যজিৎই। বলেন, তার পরের ছবি ‘অপুর সংসারে’ সৌমিত্রই নায়ক। ব্যস, বাঙালি পেয়ে গেল তার ফ্যাসিনেটিং টপিক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকেও অপু, ফেলুদা, ক্ষিতদা, উদয়ন মাস্টাররা বেশি করে থেকে গেছেন দর্শকের মনে। সৌমিত্রের জীবনে কোনো সেকেন্ড ইনিংসের প্রয়োজন হয়নি। বয়স যত বেড়েছে, তত বেশি করে চওড়া হয়েছে কাঁধ। বক্স অফিস বৈতরণী পার করেছেন ডেভিড গাওয়ারের মতো নান্দনিক কভার ড্রাইভে। ‘বেলাশেষে’ থেকে ‘বরুণ বাবুর বন্ধু’, পথে অবশ্য এক ‘ময়ূরাক্ষী’ পার করেছেন। ‘বসু পরিবার’-এর সেটে সত্যিকারের কর্তা। পোস্ত-র দাদু, ‘বিদেহী’, ‘নামজীবন’, ‘নীলকণ্ঠ’ দেখার জন্য বারবার পূর্ণ হয়েছে প্রেক্ষাগৃহ। ‘বেলাশেষে’ নিঃসঙ্গ এক সৌমিত্র হেঁটে চলেন নতুন অজানা দিগন্তে। ছিয়াশিতেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন ছাব্বিশের অহংকার। বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। জীবনের শেষ অভিনয় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বায়োপিক করতে রাজি হওয়ায় চমকেই গিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু বোধহয় মনের কোণের সেইটুকু বাস্তব হলো। ছবির সব দৃশ্যের শুটিং শেষ করলেন বটে, কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না। তার আগেই জীবনমঞ্চ থেকে প্রস্থান এই মহা নটের।

 

শোকাচ্ছন্ন সোশ্যাল মিডিয়া

নির্মাতা সৃজিত লেখেন ‘ভালো থেকো’। এরপর তার নির্মিত ‘ফেলুদা ফেরত’ পোস্ট করে আরেকবার লেখেন, ‘তিনি ছিলেন আমার প্রথম হিরো।’

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় স্মৃতিকাতর হয়ে লেখেন, ‘ভালো থেকো জেঠু’। ‘প্রাক্তন’ ছবির গায়িকা ইমান চক্রবর্তী লেখেন, ‘এই নক্ষত্রের পতন হয় না, এই নক্ষত্র সর্বত্রই উজ্জ্বল। তুমি ভালো থেকো ওপারে।’

ওস্তাদ আশীষ খাঁ লেখেন, ‘প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পাঁচ সপ্তাহের লড়াই শেষ।’ অভিনেত্রী তানভীন সুইটি লেখেন, ‘বিদায় ফেলুদা! বিনম্র শ্রদ্ধা। সৌভাগ্য হয়েছিল এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার। অসাধারণ একজন মানুষ এবং মুগ্ধ হয়েছি তাঁর ব্যবহারে। আপনার আত্মœার শান্তি কামনা করি।’ বিবি রাসেল লেখেন, ‘মেনে নিতে পারছি না...আর কত হারাব...সৌমিত্র দা আপনি আমার হৃদয়ে থাকবেন অনন্তকাল।’ সায়ন্তনী দত্ত লেখেন, ‘আপনি আমাদের মধ্যে সারা জীবন বেঁচে থাকবেন স্যার! মৃত্যুর কাছে পরাজিত ‘অপরাজিত’ অপু।’

জয়া আহসান লেখেন, ‘পর্দায় তিনি যখন অভিনয়ের গরিমা ঝেড়ে ফেলে চরিত্রের আচরণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন, প্রথম সারিতেই তাঁর স্থান। পরমব্রত লেখেন, ‘অনেকে উনাকে গুরু মানেন, শিক্ষক বলেন, আমার কাছেও অবশ্যই তাই। আমার নিজের একান্ত নিজের উদয়ন মাস্টার। কিন্তু সব ছাড়িয়ে উনি ছিলেন একজন পরম বন্ধু। আজ জীবনের একটা অংশ চলে গেল। চারদিকে শুধু অসীম শূন্যতা। এটি পূরণ হওয়ার নয় কখনো। অভিনেতা দেব  লেখেন, তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো, তোমাকে খুব মিস করব দাদু।

অভিনেতা আবির চ্যাটার্জি লেখেন, একজন কিংবদন্তির প্রস্থান। আমরা তোমাকে মিস করব, সিনেমা তোমাকে মিস করবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর