বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ছবির খবর নেই, নেতৃত্ব নিয়েই ব্যস্ত

আমরাও সমিতিতে ছিলাম। ছবির কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে, সমিতি ছিল গৌণ। এখন সমিতি নিয়ে যতটা মনোযোগ দেখি, সিনেমা নিয়ে ততটা চোখে পড়ে না - ইলিয়াস কাঞ্চন

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবির খবর নেই, নেতৃত্ব নিয়েই ব্যস্ত

‘চলচ্চিত্র জগতের দীর্ঘদিনের মন্দাবস্থার কথা বাদই দিলাম। করোনার কারণে গত মার্চ থেকে প্রায় সাত মাস সিনেমা হল বন্ধ ছিল। গত ১৬ অক্টোবর নতুন করে সিনেমা হল খোলার পর সিনেমা হল মালিকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। ছবি আছে কিন্তু মুক্তি দিচ্ছেন না প্রযোজক। প্রযোজক সমিতির সর্বশেষ নির্বাচিত সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলছেন, প্রযোজকরা ছবি মুক্তি দেবেন ঠিকই কিন্তু তার আগে প্রদর্শকদের ছবির অর্থ ফেরতের গ্যারান্টি দিতে হবে। প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ কুমার দাস এর জবাবে বলছেন, প্রযোজকদের কাছে বর্তমানে মুক্তি দেওয়ার মতো যেসব ছবি রয়েছে তার সবই যে মানসম্মত এবং ব্যবসা করবে সেই গ্যারান্টি কি তারা দিতে পারবেন? চলচ্চিত্রবোদ্ধারা সমিতিগুলোর এমন কাদা ছোড়াছুড়িতে চরম নাখোশ। তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে চলচ্চিত্রের মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সবাই ব্যস্ত সমিতি আর নেতৃত্ব নিয়ে। এক সমিতি আরেক সমিতিকে কীভাবে ঘায়েল করবে সেটিই এখন কালচারে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায় ছবি নির্মাণ বা মুক্তি চলচ্চিত্রকারদের কাছে এখন মুখ্য বিষয় নয়, তাদের প্রধান চিন্তা হলো কীভাবে সমিতির নেতা হওয়া যায়, নেতৃত্বে গিয়ে কতটা ফায়দা হাসিল করা যায়। একটি সমিতির এক কর্মকর্তা সমিতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে নানা আয়োজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা তুলে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন বলেও প্রচার আছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর প্রদর্শনের জন্য সমিতির প্রয়োজন কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশে, এমন কি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো এত বড় একটি রাষ্ট্রেও সমিতির কোনো অস্তিত্ব নেই। ভারতজুড়ে চলচ্চিত্রের স্বার্থরক্ষায় রয়েছে একটি মাত্র সংগঠন। যার নাম ‘ইন্ডিয়ান মোশান পিকচার অ্যাসোসিয়েশন’ (ইমপা)। আর আমাদের মতো ছোট একটি দেশে রয়েছে চলচ্চিত্রের কম করে হলেও ২০টি সমিতি। এফডিসিতে প্রদর্শক সমিতি ছাড়া অন্য সব সমিতির অফিস রয়েছে। এগুলোর ভারে সংস্থাটি এখন জর্জরিত। সেখানে চলচ্চিত্রকাররা   গালগল্প, এক সমিতি অন্য সমিতির বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি, একে অন্যকে বয়কট, পিকনিক, ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে চাঁদা উত্তোলনের মতো স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যস্ত। এফডিসিতে এখন কোনো চলচ্চিত্র- সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ‘কী কাজ করছেন’ এমন প্রশ্ন করা হলে জবাব পাওয়া যায়, ‘নারে ভাই, হাতে কোনো কাজ নেই, এখানে এসেছিলাম অমুক সমিতিতে যাওয়ার জন্য, সেখানে বসে একটু গল্প করব, সময় কাটাব, এই আর কি?’ এ কারণে এফডিসিকে এখন চলচ্চিত্রপাড়ার পরিবর্তে সমিতিপাড়া নামেই আখ্যায়িত করছেন অনেকে। অনেকের প্রশ্নÑ এফডিসি হলো কেপিআইভুক্ত এলাকা। কেপিআইভুক্ত এলাকায় কী করে সমিতি থাকতে পারে? সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব কেন? সিনিয়র চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এফডিসিতে আসলে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর চলচ্চিত্রের আলাপ- আলোচনার জন্য ‘স্টাডি রুম’ করা যায়, সমিতি নয়। আশির দশকে স্টাডি রুম করতেই পরিচালক, শিল্পী, প্রযোজকসহ অনেককে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে স্টাডির কোনো নাম-গন্ধ নেই। দিব্যি ‘সমিতি’ নাম ব্যবহার করে নির্বাচনসহ অন্য সব কাজ করলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা দেখেও না দেখার ভান করে আসছে। এফডিসিতে অফিস বানিয়ে বছরের পর বছর ঘর ভাড়াও বকেয়া রেখেছে বলে এফডিসি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ রয়েছে। এফডিসি যে এখন চলচ্চিত্রের মানুষের কাছে শুধুই ‘সমিতিনির্ভর’ হয়ে পড়েছে তার প্রমাণ ফের মিলল সম্প্রতি। শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং প্রযোজক সমিতির সদস্য জায়েদ খানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রযোজক সমিতির বর্তমান কমিটির অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসার প্রমাণ পেয়ে ১৬ নভেম্বর কমিটি বাতিল করে তাতে প্রশাসক নিয়োগ করে। এর আগে মামলা আর বৈধ-অবৈধের প্রশ্নে প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির নির্বাচিত কমিটির পরিবর্তে দায়িত্ব পালন করে প্রশাসক। গত জুলাই মাসে শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের বিরুদ্ধে সমিতির নিয়মনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে প্রযোজক সমিতি। আর অক্টোবর মাসে এই দুজনকে বয়কট করে প্রযোজক সমিতিসহ চলচ্চিত্র- সংশ্লিষ্ট অন্য সমিতিগুলো। এর আগে প্রদর্শক সমিতির অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বৈধতার প্রশ্ন তুলে সমিতির কয়েকজন সদস্য আইনের আশ্রয় নেয়। ফলে জানুয়ারিতে বাতিল হয়ে যায় প্রদর্শক সমিতির নির্বাচিত কমিটি। সরকার সেখানে নিয়োগ দেয় প্রশাসক। বাতিলকৃত কমিটির কর্মকর্তারা পরে আপিল করে আবার ফিরে আসেন ক্ষমতায়। এ অবস্থায় প্রদর্শকদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে বিভাজন। সাবেক সভাপতি ইফতেখার নওশাদের সঙ্গে বর্তমান সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ, প্রধান উপষ্টো সুদীপ কুমার দাস, ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দীনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গেছে। সমিতি নিয়ে অবৈধ নির্বাচন, মামলা, আপিল, প্রশাসক নিয়োগ, দ্বন্দ্ব, বয়কট গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এভাবেই ছবি নির্মাণ বা প্রদর্শনে নজর না দিয়ে নেতৃত্ব ও সমিতিসর্বস্ব হয়ে পড়ায় চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব এখন বিপন্নের পথে। করোনাকালাীন বন্ধের পর ১৬ অক্টোবর ফের সিনেমা হল খুললেও প্রায় ৬ সপ্তাহ ধরে প্রযোজকরা নতুন ছবি মুক্তি দিচ্ছেন না। এতে আবারও বন্ধের হুমকিতে পড়েছে সিনেমা হল। সমিতি নিয়ে এর কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলোÑ সমিতির কাজ চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা করা। এমন কথায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সাধারণ সদস্যরা বলছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর প্রদর্শনই যদি না থাকে তাহলে সদস্যদের স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষণ সম্ভব। ভিক্ষাবৃত্তি করে আর কত চলা যায়, এতে তো চলচ্চিত্রকারদের মান-সম্মান বজায় থাকে না।

এদিকে তিন বছরের চলচ্চিত্র মুক্তির হার যদি দেখা হয় তাতে নিম্নগামী চিত্রই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে মুক্তি পায় ৫৬টি দেশীয় ছবি। ২০১৮ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫টিতে। ২০১৯ সালে মুক্তি পায় ৪৭টি দেশীয় ছবি। এর মধ্যে ব্যবসাসফল হয় একমাত্র শাকিব খান অভিনীত ও প্রযোজিত ছবি ‘পাসওয়ার্ড’। চলতি বছরের ১১ মাস অতিক্রম হতে চললেও এখন পর্যন্ত ১২টি ছবিও মুক্তি পায়নি। অথচ সত্তরের দশক থেকে মাসে সিনেমা নির্মাণের গড় সংখ্যা ছিল ৬০টিরও বেশি। চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, ‘সমিতির কাজ ছবি নির্মাণ করা নয়। সংগঠনের সদস্যদের স্বার্থরক্ষা ও সেবা দেওয়া। এর পরও শিল্পী সমিতি চলচ্চিত্রকে ঘুরে দাঁড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। সব সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পী সমিতি বাংলা ছবিকে বাঁচাতে কাজ করছে।’ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের কথায়, ‘দিন শেষে ছবি নির্মাণ করতে হবে, এটাই একমাত্র সত্যি। তবে এটা মানতে হবে, সমিতিগুলো নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে। চলচ্চিত্রের সংকট দূর করতে সমিতিগুলোর নিজ নিজ জায়গা থেকে চেষ্টা করতে হবে। সমিতির সদস্যরাই তো চলচ্চিত্রের অংশ।’ চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, ‘এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে সমিতিগুলো বরাবরই ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সমিতি না থাকলে শিল্পটি অনেক আগেই অস্তিত্বশূন্য হয়ে পড়ত।’  চলচ্চিত্রের খোঁজখবর রাখেন এমন অনেকে বলছেন, শিল্পীদের মূল কাজ অভিনয়টা কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। অভিনয়ের পরিসর কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, তা নিয়ে শিল্পীদের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত। বরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ববিতার মতে, চলচ্চিত্র উন্নয়নের জন্য যে এফডিসি, সেখানে নেই চলচ্চিত্রের ব্যস্ততা। এফডিসিতে এত সমিতি, তাতে লাভ কী? চলচ্চিত্রই যদি না থাকে, এত সমিতি দিয়ে কী হবে? প্রখ্যাত অভিনেতা ও নির্মাতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘ছবির কাজ নেই। তাই বেশির ভাগ শিল্পী সমিতি নিয়ে মেতে আছেন। দেশে এখন যে নগণ্য পরিমাণ সিনেমা তৈরি হচ্ছে, তাতে সব শিল্পী তো কাজ করতে পারছেন না। আমরাও সমিতিতে ছিলাম। ছবির কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে, সমিতি ছিল গৌণ। এখন নির্বাচনে যতটা মনোযোগ দেখি, সিনেমা নিয়ে ততটা ব্যস্ততা চোখে পড়ে না।’ ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, ‘এমনও শুনেছি, নেতা হওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকাও খরচ হয়। এই টাকা যদি সবাই মিলে একটি সিনেমার পেছনে বিনিয়োগ করতেন, তাতে সিনেমা- সংশ্লিষ্ট সবারই লাভ হতো।’ চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি শাকিব খান বলেন, ‘সমিতি দিয়ে চলচ্চিত্রশিল্প টিকে থাকবে না। শিল্পীকে বাঁচতে হলে কিংবা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ছবির কাজ নিয়ে ভাবতে হবে। মানসম্মত কাজ দিয়ে দর্শকের মন জয় করতে হবে।’ চিত্রনায়িকা চম্পা বলেন, ‘সবাইকে সিনেমার কাজে মনোযোগী হতে অনুরোধ করব। শিল্পী বাঁচে তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে। ছবিই যদি না হয়, এসব সমিতি দিয়ে কী হবে?’ শিল্পী সমিতির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য চিত্রনায়ক রিয়াজ মনে করছেন, সিনেমার কাজের চেয়ে সমিতি নিয়ে অনেক শিল্পী বেশি মেতে আছেন। তিনি বলেন, ‘শিল্পীদের প্রধান কাজ হচ্ছে সিনেমার কাজ করা। সমিতির ব্যাপারটা সেকেন্ডারি। সিনেমা কমে গেছে, অনেক শিল্পীর কাজও কমে গেছে, তাই শিল্পীদের অনেকে সমিতি নিয়ে অনেক বেশি সময় দিতে পারছেন। এটাকে ভালো বলব না খারাপ বলব, তা নিয়ে আমিও সন্দিহান।’ বেশির ভাগ সিনিয়র চলচ্চিত্রকার বলছেন, ‘এফডিসিতে কাজের চেয়ে সবাই সমিতি আর একে অপরের ওপর রেষারেষি নিয়েই ব্যস্ত। বলতে গেলে বলা যায়, কর্মশূন্য এফডিসিতে সবাই এখন ব্যস্ত সমিতি আর নেতৃত্ব নিয়ে। স্বাধীনতা লাভের পর এখানে কাজের পরিধি যত বেশি ছিল সমিতি তত কম ছিল। এখন হয়েছে উল্টো, ছবি কম সমিতি বেশি।’ প্রকৃত চিত্র আসলেই তাই, চলচ্চিত্র নির্মাণ না হলেও এফডিসিতে বাড়ছে সমিতির সংখ্যা। আগে ছিল ১৮ সংগঠন এবং তার নাম ছিল ‘চলচ্চিত্র পরিবার’। তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০টিতে।

এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘চলচ্চিত্রশিল্পী অধিকার রক্ষা ফোরাম’।  চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের বরাবরই প্রশ্নÑ ‘আসলেই কি এতে চলচ্চিত্র এবং শিল্পীদের অধিকার রক্ষা হচ্ছে?

সর্বশেষ খবর