শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে শেষ আড্ডা

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে শেষ আড্ডা

ছবি : রাফিয়া

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে থিয়েটার চর্চার পথপ্রদর্শক আলী যাকের। একজন সফল অভিনেতা, নির্মাতা, ব্যবসায়ী, কলামিস্ট এবং বিজ্ঞাপন শিল্পের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দুপুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগের আড্ডা আয়োজনের অতিথি হিসেবে তাঁর সঙ্গে জমে ওঠে প্রাণবন্ত আড্ডা। সেই আড্ডার চুম্বকাংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

 

যানজট আর বৈশাখী উত্তাপের অস্বস্তি উপেক্ষা করেই বনানীর গল্ফ হাইটসের ফ্ল্যাটে খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের সাক্ষাৎকার নিতে ছুটলাম। শুনেছি এই তারকা ঘড়ির কাঁটা মেপে সময়কে আয়ত্তে রাখেন। অবশেষে তাঁর সময় বেঁধে দেওয়ার ১০ মিনিট আগেই এই কিংবদন্তির বাসায় হাজির! ব্যতিব্যস্তের অলক্ষ্যেই রুমে প্রবেশ করলেন অভিনেতা আলী যাকের। গায়ে ব্লু আর কালো রঙের মিশেল চমৎকার ফতুয়া, কালো প্যান্ট আর কালো জুতা, হাতে ছড়ি। লম্বা-চওড়া বিশাল দেহের অধিকারী এই ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটল রাজকীয়ভাবেই। শুরুতেই ফটোসেশনের কাজ কিছুটা সেরে নেওয়া হলো। এরপর আলী যাকেরের সঙ্গে আলাপ হলো শুরু। অজস্র মঞ্চ আর টিভি নাটক তুখোড় অভিনয়ে মাতিয়েছেন তিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি খুবই কম, কেন? এই প্রশ্নটি করার পর কালক্ষেপণ না করেই তাঁর সহজ-সরল উত্তর, ‘আমাকে  তো কেউ ডাকেনি, ডাকলে অবশ্যই অভিনয় করতাম। কোনো মাধ্যমেই কাজের প্রতি আমার কোনো অনীহা ছিল না।’ মজার বিষয় হচ্ছে ছেলে ইরেশ ও বাবা আলী যাকেরের জন্মদিন একই দিনে, ৬ নভেম্বর। তাই প্রতি বছর একই দিনে জন্মদিনের কেক কাটেন তাঁরা। আলী যাকের মজা করে বললেন, ‘দুজনের জন্মদিন একই দিনে হলেও আমি রাত ১০টায় জন্মেছি। সে হিসেবে কিন্তু বাবার চেয়ে ছেলেকে বড় বলা যেতেই পারে... হা হা হা।’ এমনিতে আলী যাকেরকে রাশভারী, গম্ভীর আর রাগী প্রকৃতির মনে হলেও আড্ডায় তাঁর কথাবার্তা উপভোগ্য। হাস্যোজ্জ্বল, সরল, বিনয়ী আর দার্শনিক চরিত্রের মানুষ তিনি। তাহলে কি আলী যাকেরকে গ্যালিলিও বলা যেতে পারে! মৌন সম্মতি দিলেন আলী যাকের। “নাগরিক মঞ্চস্থ ‘গ্যালিলিও’ সৃষ্টি না হলে আজকের আলী যাকের হতো না। আমি ‘গ্যালিলিও’ চরিত্রে অভিনয় করি। নাটকটি আমার পরিচয়।” কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে বললেন আলী যাকের। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের জনপ্রিয় চরিত্র মামার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। মামা চরিত্রটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এর জন্য বহুবার তাঁকে নানারকম বিড়ম্বনার শিকারও হতে হয়েছে। এমনকি থিয়েটার মঞ্চে অভিনয়ের সময়ও অনেকে তাঁকে ‘মামা’ বলে ডাকত। তা অবশ্য তাঁর ‘গ্যালিলিও’ নাটক মঞ্চস্থের সময়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আলী যাকের বলেন, ‘মঞ্চে গ্যালিলিও নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে। দর্শকদের মাঝে পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ দর্শক সারির পেছন থেকে কে একজন বলে উঠল ‘মামা’। পুরো আবহ মুহূর্তেই পাল্টে যায়।’ দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক সমস্যায় ভোগার কারণে অভিনয় থেকে ছিলেন দূরে। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের শূন্যতাকে কেমন অনুভব করেন জিজ্ঞাসা করতেই আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, ‘বাঙালির জীবনকে নিবিষ্টভাবে হুমায়ূন দেখতেন। একটা আঙ্গুল আমরা কীভাবে তুলি তাও তাঁর জানা ছিল। আমাকে দিয়ে যখন মামা চরিত্রটি তিনি করান তখন এই জোকারি চরিত্র দেখে বিরক্ত হই। বলি, কী করছেন আমারে, জোকার বানাইছেন, সবাই দেখলে শুধু হাসে। তখন তিনি বলেন, ‘যাকের ভাই, বলেন তো কোন বাঙালি পরিবারে এরকম একটা মামা নাই? আর কফিন নিয়ে সেই দৃশ্যটা?’ প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আলী যাকের বলতে থাকলেন, ‘কফিনে কিন্তু কর্পূরের গন্ধ ছিল। দৃশ্যটি শেষ হওয়ার পর হুমায়ূন সাহেব আমাকে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ যাকের ভাই, শর্টটি অনেক ভালো হয়েছে। তবে একটা কথা বলতে চাচ্ছি যে, গতকালই এটিতে একটি লাশ ক্যারি করা হয়েছিল।’ ‘এই কথা শুনে আমি তো বাকরুদ্ধ। পরে অবশ্য অনেক হেসেছি।’ অভিনয়ে যাত্রা শুরু? ‘১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবরে প্রথম অভিনয় করি। এরপর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দিই।’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আলী যাকের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করতেন। এখনকার নাটকের মান কেমন জিজ্ঞাসা করতেই সোজা উত্তর, ‘পরিমাণে কম হলেও কিছু ভালো নাটক হচ্ছে।’ আলী যাকের পেইন্টিং ভালোবাসেন। কোথাও বেড়াতে গেলেই পেইন্টিং কিংবা শো-পিস খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসেন। ভালো ফটোগ্রাফিও করেন। তাঁর তোলা ছবি নিয়ে অনেকবার প্রদর্শনীও হয়েছে।  কথা আর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় দুটোর ঘরে।

এবার বিদায়ের পালা।

সর্বশেষ খবর