সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
বদলে যাচ্ছে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ধারা

বাংলাদেশের ছবিও মুক্তি পাচ্ছে অনলাইনে

আলাউদ্দীন মাজিদ

বাংলাদেশের ছবিও মুক্তি পাচ্ছে অনলাইনে

বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশও এখন চলচ্চিত্র প্রদর্শনে আধুনিকতা ও সময়ের পথে হাঁটছে। হলিউড, বলিউড, টলিউড অনেক আগে থেকেই নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তি দিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে দর্শক আগ্রহও বাড়ছে। এবার এই ধারায় যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে এ দেশে ছবি মুক্তির জন্য নির্মিত প্রথম অনলাইন প্ল্যাটফরম ‘আই থিয়েটার’-এ আসছে শীর্ষ অভিনেতা শাকিব খান, মাহিয়া মাহী ও স্পর্শিয়া অভিনীত ছবি ‘নবাব এলএলবি’। গত বৃহস্পতিবার এই ওটিটির উদ্বোধন করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। ছবিটি পরিচালনা করেছেন অনন্য মামুন। এরপর মুক্তি পাবে ‘মেকআপ’ ও ‘সাইকো’ ছবি দুটি। এর আগে অবশ্য এ দেশে বঙ্গ ও আইফ্লিক্স নামে দুটি অনলাইন প্ল্যাটফরম থাকলেও সেগুলো নতুন ছবি মুক্তিনির্ভর নয়।

অশ্লীলতা, পাইরেসি, সিনেমা হলের পরিবেশ সহায়ক না থাকায় নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে এ দেশের দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা ছেড়েই দিয়েছেন। দর্শকরা তখন থেকে ঘরে বসে টেলিভিশনের মাধ্যমে স্যাটেলাইট চ্যানেলে দেশি-বিদেশি ছবি দেখার প্রতি ঝুঁেক পড়েন। অন্যদিকে হলিউড, বলিউড ‘আধুনিকতা’ হিসেবে ছবি মুক্তির জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বেছে নেয়। এ দেশের দর্শক তখন স্যাটেলাইট চ্যানেলের পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরম যেমন নেটফ্লিক্স, জি ফাইভ, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই, ডিজনি প্লাস-এ দেশি-বিদেশি ছবি দেখা শুরু করেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকাল দেখা দিলে এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। তখন শুধু দেখা নয়, করোনার কারণে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনলাইন প্ল্যাটফরমকে ছবি মুক্তির নতুন অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয় হলিউড, বলিউড। অনলাইনে মুক্তি পাওয়া নতুন ছবি দেখতে দর্শকও মুখিয়ে থাকেন। এখন বৈশ্বিক এই ছবি মুক্তির নতুন ধারায় যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।

চলতি বছর ‘এক্সট্র্যাকশন’ ছবিটি অনলাইনে মুক্তি পেলে এর প্রতি দর্শক আগ্রহই প্রমাণ করে দিয়েছে মানুষ কী পরিমাণে ঝুঁকছে অনলাইনে কনটেন্ট-এর প্রতি। এরপর ভারতে সুজিত সরকার পরিচালিত ‘গুলাবো সিতাবো’ ছবিটি ১২ জুন বিশ্ব উদ্বোধনী প্রদর্শনী করে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে। অমিতাভ বচ্চন ও আয়ুষ্মান খুরানার মতো দুই তারকা অভিনেতার ছবি অনলাইনে মুক্তি পেয়ে ব্যাপক সাড়া জাগায়। আরেক তারকাবহুল সিনেমা ‘শকুন্তলা দেবী’ও অ্যামাজনে মুক্তি পেয়েছে। এই ছবিতে শকুন্তলা দেবীর চরিত্রে অভিনয় করেন বিদ্যা বালান। এ ছাড়াও অক্ষয় কুমার ও কিয়ার আদভানির ‘লক্ষ্মী’, জাহ্নবী কাপুর অভিনীত ‘গুঞ্জন সাক্সেনা : দ্য কারগিল গার্ল’ হয়ে গেছে ওটিটি প্ল্যাটফরমনির্ভর। ২১ মে জি ফাইভে মুক্তি পায় নওয়াজউদ্দিন ও অনুরাগ ক্যাশপ অভিনীত ‘ঘুমকেতু’ ছবিটি। ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের জন্য প্রথমবার অভিনয় করতে যাচ্ছেন মাধুরী। এর আগে তিনি নেটফ্লিক্সের জন্য ‘ফিফটিন্থ আগস্ট’ নামে একটি ছবি প্রযোজনা করেছেন। সেই সঙ্গে ‘মোংলি’ নামে একটি সিরিজে নিশা নামের চরিত্রের জন্য কণ্ঠও দিয়েছেন মাধুরী। মাধুরী বলেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফরমে নাচের শিক্ষার্থীরা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেখান থেকেই অনুভব করেছি যে, এখন থেকে ওটিটি প্ল্যাটফরমেই বেশি কাজ করতে হবে। কারণ সিংহভাগ দর্শক এখন এই প্ল্যাটফরমে।’

যদিও সিনেমা হলে মুক্তি না দিয়ে সরাসরি ওটিটি প্ল্যাটফরমে মুক্তি দেওয়ায় বিতর্ক উঠছে বলিউডে। নাখোশ হচ্ছেন পরিবেশক, সিনেমা হল ও মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে আইনক্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সিনেমা হল মালিকদের মধ্যে একটা নিজস্ব ব্যবসায়িক সম্পর্কও থাকে। যেখানে উভয় পক্ষই লাভবান হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটাই হয়ে এসেছে। আর আজ যখন একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার সময় তখন অপর পক্ষ সেই সম্পর্ক থেকে সরে গেল। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে বলিউডে চলচ্চিত্র মুক্তির ধারা বদলে গেছে।

এদিকে অনলাইনে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো কতটা ব্যবসায়িক সাফল্য পাচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আশার আলোই দেখা গেছে এ পর্যন্ত। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি মুক্তি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও অনেক প্রযোজকই লাভজনক হিসেবে দেখছেন একে। অনলাইন প্ল্যাটফরমে এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া সবগুলো ছবিই ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য পেয়েছে। বলিউড সিনেমার মধ্যে সব থেকে বেশি টাকায় বিক্রি হওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘লক্ষ্মী’। অক্ষয় কুমার এবং কিয়ারা আদভানি অভিনীত এই সিনেমাটি বিক্রি হয়েছিল ১২৫ কোটি রুপিতে। ৬০ কোটি বাজেটের এ সিনেমার আয় ৬৫ কোটি রুপি। তালিকায় এর পরই রয়েছে ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা অজয় দেবগন, সঞ্জয় দত্ত, নোরা ফাতেহির ‘ভুজ’ সিনেমাটি। প্রায় ৮০ কোটি বাজেটের এ ছবি ১১০ কোটি রুপিতে বিক্রি হয়েছে। অমিতাভ বচ্চন এবং আয়ুষ্মান খুরানার ৩০ কোটি রুপির কমেডি সিনেমা ‘গুলাবো সিতাবো’ বিক্রি হয়েছিল ৬৫ কোটি রুপিতে। আর আয় প্রায় ২০ কোটি রুপি। বিদ্যা বালানের ‘শকুন্তলা’ ৪০ কোটিতে বিক্রি হয়েছে। যার নির্মাণ ব্যয় ৩০ কোটি রুপি। আলোচিত সিনেমা ‘গুঞ্জন সাক্সেনা’ বিক্রি হয়েছে ৫০ কোটি রুপিতে। ৩০ কোটি রুপি বাজেটের এই সিনেমা আয় করেছে ২০ কোটি রুপি।

করোনাকালীন পরিস্থিতিতে অনেক সিনেমাই ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে মুক্তি পাচ্ছে। আর একেই নিরাপদ ভাবছেন প্রযোজকরা। তাতে সিনেমা হলের মতো বিশাল লাভের আশা না থাকলেও বিনিয়োগের টাকাটা উঠে আসছে বলে অনেকেই ভরসা পাচ্ছেন।

এদিকে এ দেশের চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, আধুনিকতার পথে এ দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের নতুন ধারার সূচনা করবে। তবে ছবির মানের সঙ্গে আপস করা চলবে না। ছবিটি নির্মাণ, গল্প, অভিনয়, লোকেশন, গান, নাচ সবই যেন হয় বিশ্বমানের। কারণ উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগ মানে তুমুল প্রতিযোগিতার বাজার। এখানে টিকতে হলে অশ্লীলতা আর মানহীনতাকে এড়িয়ে চলতে হবে। তবেই হলিউড, বলিউডের মতো আমাদের দেশের ছবির স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠবে অনলাইন প্ল্যাটফরম।

 

সর্বশেষ খবর