রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

৯৩তম অস্কারে এশিয়ান কিছু ছবি...

৯৩তম অস্কারে এশিয়ান কিছু ছবি...

বিশ্বের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল চলচ্চিত্র পুরস্কার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ‘অস্কার’। আগামী বছরের ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে অস্কারের ৯৩তম আসর। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ডলবি থিয়েটারে আয়োজন হবে বিশ্বের সর্বোচ্চ মর্যাদাময় এই চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠান। যথারীতি ২৪টি শাখায় দেওয়া হবে পুরস্কার। এর মধ্যে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতির সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সিনেমারও। অস্কার মনোনয়নে এশিয়ান ছবিগুলো নিয়ে লিখেছেন-   পান্থ আফজাল

 

২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অস্কার আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর প্রভাবের কারণে অনুষ্ঠানটি দুই মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়। নির্ধারিত হয় ২৫ এপ্রিল, ২০২১ সাল। প্রতি বছরের মতো এবারও অস্কার বাংলাদেশ কমিটি ৯৩তম অস্কারে প্রতিযোগিতার জন্য দেশের সিনেমা আহ্বান করে। চলতি বছর ১ অক্টোবরের পর মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের যে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে ধারাবাহিকভাবে অন্তত সাত দিন প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলোই কেবল ইংরেজি সাবটাইটেলসহ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে জানানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অস্কারে ‘বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল ফিচার ফিল্ম’ বিভাগে ছবি মনোনয়নে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের অমনিবাস চলচ্চিত্র ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ এবং খনা টকিজের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ জমা পড়ে। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয়, অস্কারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত অ্যান্থলজি ফিল্ম ‘ইতি তোমারই ঢাকা’। ছবির ১১টি গল্প মূলত ঢাকা শহরে বাস করা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছে। শহরের বুকে তাদের প্রত্যেকের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার যে যন্ত্রণা, তা দেখানো হয়েছে। চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন কাহিনিচিত্র পরিচালনা করেছেন- গোলাম কিবরিয়া ফারুকী, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, নুহাশ হুমায়ূন, মাহমুদুল ইসলাম, মীর মোকাররম হোসেন, রাহাত রহমান, রবিউল আলম, সালেহ সোবহান, সৈয়দ আহমেদ, তামিন নূর ও তানভীর আহসান। এতে অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, ইরেশ যাকের, ইন্তেখাব দিনার, শতাব্দী ওয়াদুদ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, শ্যামল মাওলা, অর্চিতা স্পর্শিয়া, অ্যালেন শুভ্র, মোস্তফা মনোয়ার, মনোজ প্রামাণিক, ইয়াশ রোহান, রওনক হাসান, শেহতাজসহ আরও অনেকে।

এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরেই বলিউডে সিনেমার কোনো দাপট দেখা যাচ্ছে না। একটা সময় বলিউডের তিন খান থেকে শুরু করে অন্য শিল্পীদের ছবিতে মুখরিত থাকত বলিউড ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু করোনার হানায় সবকিছুই যেন বদলে  গেছে। শুধু করোনার জন্যই নয়, করোনার আগের সময়টাও বেশ ভালো যাচ্ছিল না বলিউডের। সেই দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে মালয়ালম ছবিগুলো। ৯৩তম অস্কারে সেরা বিদেশি ভাষার ছবির জন্য এ বছর ভারত থেকে যে ছবিটি পাঠানো হচ্ছে, সেটি কোনো হিন্দি সিনেমা নয়। ভারতের অস্কার কমিটি ২৭টি ছবিকে ‘শর্ট লিস্টেড’ করে কয়েক দফায় আলোচনা, পর্যালোচনা ও ভোটাভুটি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মালয়ালম ভাষার ‘জাল্লিকাট্টি’কে ভারত থেকে অফিশিয়ালি অস্কারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নারী পাইলটের ওপর বায়োপিক ‘গুঞ্জন সাক্সেনা’, অ্যাসিডে আক্রান্ত নারীর জীবনের ওপর নির্মিত ‘ছপাক’, ম্যাথ জিনিয়াসের বায়োপিক ‘শকুন্তলা দেবী’, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত আরেকটি বায়োপিক ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’, বৃদ্ধ নারীর জীবনের ভিন্ন গল্প ‘গুলাবো সিতাবো’, ‘চেক পোস্ট’, ‘সিরিয়াস ম্যান’, ‘ভোঁসলে’, ‘দ্য ডিসাইপল’র মতো প্রশংসিত ছবিকে পেছনে ফেলে অস্কার মনোনয়নের দৌড়ে জিতল ‘জাল্লিকাট্টি’। ষাঁড়ের লড়াইয়ের ওপর লেখক এস হরিশের লেখা ছোটগল্প ‘মাওইস্ট’র ওপর ভিত্তি করেই এটি নির্মাণ করেছেন লিজো জোস পেল্লিসারি। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যান্টনি ভার্গিজ, চেম্বন বিনোদ জোস, সবুমন আবদুসামাদ এবং শান্তি বলচন্দ্রন। ফিল্ম ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া জুরি বোর্ডের পক্ষ থেকে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জাল্লিকাট্টি’ আঞ্চলিক ভাষার ছবি, ছোট্ট গ্রামের গল্প। কিন্তু গল্পটা যে কোনো দেশের, যে কোনো ভাষার, যে কোনো বর্ণের, ধর্মের। সবচেয়ে বড় কথা, যে কোনো সময়ের মানুষের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক, একই অর্থ নিয়ে উপস্থিত। বার্তাটা অত্যন্ত আদিম আর মৌলিক। সিনেমার এই আন্তর্জাতিকতা আর তা উপস্থাপনায় পরিচালকের মুন্সিয়ানা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কেননা, এটা মানুষের আত্মবিধ্বংসী অধঃপতনের গল্প। এ ছাড়াও অস্কারের মনোনয়ন পেতে লড়ছে সায়নী গুপ্ত অভিনীত শর্ট ফিল্ম ‘শেমলেস’।

২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘জাল্লিকাট্টি’ ছবিটি টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়। ২৪তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয় ছবিটি। ৫০তম ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান এই ছবির পরিচালক। ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবরে ভারতের কেরালায় মুক্তি পায় ছবিটি। ৯২তম অস্কারে ভারত থেকে এর আগে জোয়া আখতার পরিচালিত ‘গাল্লিবয়’ ছবিটি পাঠানো হয়েছিল। ভারত থেকে এখন পর্যন্ত কেবল ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), ‘সালাম বোম্বাই!’ (১৯৮৮) আর ‘লগান’ (২০০১), এই তিন ছবি অস্কারের মনোনয়নের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিল।

অস্কারে ছবি পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানা হয়। ‘ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান ফিল্ম’-বিদেশি ভাষার ছবির ক্ষেত্রে এ নীতিই মেনে চলে একাডেমি অব মোশন পিকচার্স আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের যে কোনো দেশ থেকে প্রতি বছর কেবল একটি ছবিই পাঠানো যাবে অস্কার মনোনয়নের জন্য। কিন্তু এমন তো নয় যে একটি দেশে বছরে একটিই ভালো ছবি হয়! একাধিকও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনটিকে নির্বাচন করা হবে? এ প্রশ্নটি মাথায় রেখেই পৃথিবীর অনেক দেশে সিলেকশন কমিটির উদ্ভব।

এর আগে ৯২তম অস্কারে বাংলাদেশ থেকে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘আলফা’ পাঠানো হয়। ২০০৩ সালে তারেক মাসুদ পরিচালিত মাটির ময়না ছবিটি সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারে পাঠানো হয়েছিল। এরপর দুই বছর কোনো বাংলাদেশি ছবি অস্কারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে একটি চলচ্চিত্র অস্কারের জন্য পাঠানো হচ্ছে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অস্কারে পাঠানো সিনেমা তিনটি হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, আবু সাইয়িদের ‘নিরন্তর’ এবং গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের ‘স্বপ্নডানায়’। ২০১১ সালে ফারুকীর ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এবং ২০১৪ সালে ‘টেলিভিশন’ সিনেমা অস্কারে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে অস্কারে পাঠানো হয় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ চলচিত্রটি।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩১ সালে অস্কার নামটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রের কলাম লেখক সিডনি স্কলস্কির দাবি যে, তিনি অস্কার নাম প্রদানকারী। ২০০১-২০১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হলিউডের কোডাক থিয়েটারে এটির আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের নকিয়া থিয়েটারে অস্কার প্রদান অনুষ্ঠিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। জানা যায়, ৯৩তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস হবে তারকাদের উপস্থিতিতে, ভার্চুয়াল নয়। ২৫ এপ্রিল সুন্দর পোশাকে সেজে লস অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে উপস্থিত হবেন আন্তর্জাতিক তারকারা। এমির কভিডের প্রকোপে ভার্চুয়াল পথ অবলম্বন করেছিল। কিন্তু অস্কার কর্তৃপক্ষের ভার্চুয়াল সেলিব্রেশনে মত নেই। সাধারণত তারকাখচিত ডলবি থিয়েটারে সোনালি পুতুল হাতে নিয়ে শিশুর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন হলিউড তারকারা। তবে এবারের পরিস্থিতি হবে একেবারে ভিন্ন। জানা গেছে, এরই মধ্যে ডলবি থিয়েটার পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন একাডেমির কর্মকর্তারা। সুরক্ষাবিধি মেনেও কীভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়, সেটার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ৯২তম অস্কারে ‘প্যারাসাইট’-এর মহাবিজয়ের পর দুনিয়াজুড়ে দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্রের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বং জুন-হোর এই ছবিটির সাফল্যের পর অনেকেই আশাবাদী যে, অস্কার লড়াইয়ে এশিয়ান ছবিগুলোই এগিয়ে থাকবে; ঘরে তুলবে  সোনালি পুতুল!

সর্বশেষ খবর