মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কী করছে নাটকের ১৪ সংগঠন

কী করছে নাটকের ১৪ সংগঠন

টেলিভিশন শিল্পী-কলাকুশলীদের জন্য সরকারি কল্যাণ তহবিলের দাবিতে অভিনয়শিল্পী সংঘের সংবাদ সম্মেলন

কয়েক বছর ধরেই টিভি নাটক নিয়ে বিস্তর অভিযোগ! মানহীন নাটক, শুটিংয়ে বিশৃঙ্খলা, স্ক্রিপ্ট ছাড়া নাটক তৈরি, ঠিকমতো শুটিং সেটে অভিনয়শিল্পীর উপস্থিত না হওয়া, সময়মতো ও ঠিকঠাক পারিশ্রমিক না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠে এসেছে বারবার। নাটকের সংগঠনগুলো এসব সমস্যা নিয়ে অল্পবিস্তর কাজ করেছে, কিছু কাজ রয়েছে দোলাচলে। এর মধ্যে গতকাল অভিনয়শিল্পী সংগঠনের উদ্যোগে টিভি ইন্ডাস্ট্রির সব শিল্পী-কলাকুশলী ঐক্যবদ্ধভাবে কল্যাণ তহবিল গঠনসহ বিভিন্ন রকম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানায়। সবমিলিয়ে কী করছে সংগঠনগুলো, সেসব নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

টিভি ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে ১৪টি সংগঠন। নতুন কমিটি গঠনের প্রায় ২ বছর হতে চলেছে। তবে যতখানি সংগঠনভিত্তিক কাজ হওয়ার কথা সেটা তেমন করে হচ্ছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে। শোনা যায়, ‘টেলিভিশনে এখন আর কেউ নাটক দেখে না।’ দর্শক চলে গেছে ইউটিউবে। গত কয়েক বছর যে নাটকগুলো আলোচিত হয়েছে, তাও ফেসবুক ও ইউটিউবের কারণে। বেশির ভাগ নাটকের গল্প দর্শকদের টানছে না। নির্মাণের মানও সেকেলে। পরিচালকরা দোষ চাপাচ্ছেন প্রযোজকদের ঘাড়ে। বাজেট স্বল্পতার কারণেই নাকি মানসম্মত নাটক বানানো যাচ্ছে না। তবে, নাটকের মান যে কমেছে, তা উপলব্ধিও করছে নাট্য সংগঠনগুলো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নাটকের মানোন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগও নিয়েছেন তাঁরা। তবে পরিস্থিতির কারণে অনেক কাজই করা যায়নি বলে তাঁরা দাবি করছেন। আর যেসব কাজ হয়েছে, সেগুলোও প্রত্যাশার তুলনায় অনেক। সংগঠনগুলোর দাবি, নাটকে বিশৃঙ্খলা ও নিয়মে আনতে কাজ করেছে তারা। নতুন নাট্যকার তৈরি করতে কর্মশালা হয়েছে নিয়মিত, করোনাকালীনে স্ব স্ব সংগঠন উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন স্বল্প আয়ের নাটক সংশ্লিষ্ট সদস্যদের দেওয়া হয়েছে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা ও উপহার, সব সংগঠন করোনাকালীনে জুম মিটিং করে নাটকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আলোচনাও করেছে, ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম-শৃঙ্খলা ফেরাতে অনাপত্তিপত্রসহ আরও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেÑ এসব নানামুখী কাজ করেছে বলে সংগঠনগুলোর দাবি।

এদিকে গতকাল বেলা ১১টায় অভিনয়শিল্পী সংঘের উদ্যোগে অভিনয়শিল্পী সংঘের গুলশান নিকেতনস্থ কার্যালয়ে আয়োজন করা হয় এক সংবাদ সম্মেলন। সেখানে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির সব শিল্পী-কলাকুশলী ঐক্যবদ্ধভাবে কল্যাণ তহবিল গঠনসহ বিভিন্ন রকম প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানায়। এ বিষয়ে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য আলাদা আলাদা কল্যাণ তহবিল গঠন করাসহ বিভিন্ন রকম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য এখনো পর্যন্ত আলাদা কোনো ঘোষণা আসেনি। অথচ দেশের টেলিভিশন মাধ্যম আজ একটি বৃহৎ শ্রেণি-পেশায় পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পের মতো আমাদের দাবি ছিল টিভি ইন্ডাস্ট্রিকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়ার; পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার। পাঁচ হাজারের মতো শিল্পী-কলাকুশলীর দাবি তো অস্বীকার করা যাবে না! সব মাধ্যমের সঙ্গে বা আলাদাভাবে শিল্পীদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আমরা টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির সব শিল্পী ও কলাকুশলী ঐক্যবদ্ধভাবে উক্ত কল্যাণ তহবিল গঠনের জন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছি এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে।’ বিগত দুই বছর ডিরেক্টরস গিল্ড কি কি কাজ করেছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক বলেন, ‘সংগঠনের কাজই হলো সবার জন্য সুন্দর কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা, তার জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। মাঝে করোনা এলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাই। কভিডের সময় কিন্তু আমরা সব সংগঠন মিলে স্ব স্ব সংগঠনের সদস্যদের একাধিকবার সহযোগিতা করেছি। আর কভিডের প্রভাব কমে গেলে পরবর্তী ধাক্কা কীভাবে সামলানো যাবে সে বিষয়েও কিন্তু সবাই বসেছি। চলচ্চিত্র শিল্পের মতো আমরাও সরকারের কাছে টিভি শিল্পী-কলাকুশলীদের জন্য প্রণোদনা ও কল্যাণ তহবিল দাবি করেছি। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীও তা বাস্তবায়নে আশ্বাস দিয়েছিলেন। অন্যদিকে আমরা ওটিটি প্ল্যাটফরম নিয়ে সরকারের কাছে নীতিমালারও দাবি জানিয়েছি।’ টেলিভিশন নাট্যকার সংঘের সভাপতি মাসুম রেজা বলেন, ‘আমরা কাজ তো কিছু হলেও করেছি। করোনার মধ্যে সংকটে পড়া শিল্পী-কলাকুশলীদের সহযোগিতা করেছি। করোনার কারণে কিছুটা পিছিয়ে গেছি, কিন্তু কাজ চলছে। অনেক সেমিনার কর্মশালা করেছি। হ্যাঁ, মানহীন নাটক হচ্ছে এটা সত্য। তবে আমরা চেষ্টা করেছি এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার। শিল্প-সংস্কৃতি কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বেশিদিন চলে না। নাটকের বাজেট কমে গেছে, স্ক্রিপ্টের জন্য তেমন করে বাজেট নেই। তবে এ বিষয়ে কিন্তু সংগঠনের লোকরা দায়ী নন। কে মান নির্ধারণ করবে, তা একটা বিষয়। আমরা চাই শিল্প হিসেবে পেশার স্বীকৃতি। আর আমাদের অনুমোদিত চিত্রনাট্য দিয়ে যেন নাটক বানানো হয়, সে চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম-শৃঙ্খলা ফেরাতে অনাপত্তিপত্রসহ আরও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছি আমরা।’ টিভি সংগঠনের বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে ইতিবাচক নাট্যজন আবুল হায়াত। তিনি বলেন, ‘করোনা আতঙ্কেও কিন্তু অনেক কাজ করেছে সংগঠনগুলো। আর্থিক সমস্যায় যারা পড়েছিল তাদেরও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে তারা। টিভি ইন্ডাস্ট্রিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নীতিমালা গঠনসহ নানামুখী পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে সংগঠনগুলো। কাজ করছে না, এটা ভুল! ভিতরে ভিতরে কিন্তু অনেক কাজ হয়েছে। তবে অনেক শিল্পীই খারাপ অবস্থায় রয়েছে, প্রণোদনা পায়নি এখনো। তার জন্য চেষ্টাও করছে সংগঠনগুলো।’

ইতিমধ্যে ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম-শৃঙ্খলা ফেরাতে অনাপত্তিপত্রসহ আরও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে নাটকের ১৪টি সংগঠন। অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম বলেন, কেবল বাজেট বাড়ালেই টিভি নাটকের অন্তত পাঁচটি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। পে-চ্যানেল বাস্তবায়ন করতে পারলে নির্মাতারা ভালো কাজের প্রতিযোগিতা শুরু করবেন। তখন এমনিতেই নাটকের মানের উন্নতি হবে। দর্শক সম্পৃক্ততা বাড়াতে হলে গল্পের পরিধি বাড়াতে হবে। তিন বা চারজন শিল্পী দিয়ে নাটক করলে সে নাটক মানুষকে টানবে না। পারিবারিক ও সামাজিক চরিত্রগুলোকে নাটকে তুলে ধরতে হবে।’

চ্যানেলগুলোকে নাটকের বাজেট বাড়ানো, শিল্পী বাছাইয়ের স্বাধীনতা দেওয়া, শক্তিশালী প্রিভিউ কমিটি গঠন, মানসম্পন্ন নাটক প্রচারসহ নানা পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসির বলেন, ‘অর্থ থাকলেই এখন যে কেউ প্রযোজক হয়ে যান। তাই আমাদের সংগঠনের সদস্য ছাড়া, অনাপত্তিপত্র ছাড়া যেন কোনো নাটক কিংবা অনুষ্ঠান প্রচার করা না হয় সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’ অভিনয়শিল্পী সংঘ, ডিরেক্টরস গিল্ড,  টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, নাট্যকার সংঘসহ টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে জড়িত আরও সংগঠন রয়েছে। তারাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছে বলে জানা যায়। এদের মধ্যে ক্যামেরাম্যান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সহকারী পরিচালক সমিতি, টেকনিক্যাল হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, মেকআপম্যান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, লাইট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ বাকি সংগঠনগুলো কিছুটা হলেও নাটক ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে কাজ করে চলেছে।

করোনার আগে চুক্তি সই করে কাজ করার উদ্যোগ নেয় ১৪টি সংগঠন। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলা টিভি নাটকে হযবরল অবস্থা এসব উদ্যোগ গ্রহণে কতখানি কাটবে, তা প্রশ্নাতীত! আরও রয়েছে অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও প্রযোজকদের মধ্যে নানা সমস্যা। যদিও সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে টিভি নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। অন্যদিকে স্ক্রিপ্ট নেই, শুধু গল্পেই নির্মিত হচ্ছে নাটক! ইদানীং স্ক্রিপ্ট ছাড়াই শুধু গল্প দিয়ে নাটক বানানোর ট্রেন্ড চালু হয়েছে। এ কারণে নাটকে কোনো বৈচিত্র্যতা চোখে পড়ছে না বলে দর্শকরা মনে করছেন। অন্যদিকে ভালো নাট্যকারের সংখ্যাও কম। তাই দেদার মানহীন নাটক নির্মিত হচ্ছে। এটা সত্যি যে, এই সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাজেট আর ভিউ নিয়ে মাতামাতি। এটা ভবিষ্যৎ নাটক ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুবই অশনি-সংকেত। এ নিয়েও ভাবতে হবে সংগঠনগুলোকে। ভিউয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে নাটকের মানের দিকে কেউ খেয়াল করছে না। শিল্পীদেরও রয়েছে প্রস্তুতির অভাব। ইন্ডাস্ট্রি মেধাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছে না। সুযোগ করে দিচ্ছে না নতুন প্রতিভাদের। সব মিলিয়ে ইন্ডাস্ট্রি লাভের পেছনে দৌড়াচ্ছে।

এদিকে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এরই মধ্যে চলছে নাটকের শুটিং। নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলী ঝুঁকি নিয়েই এখন শুটিং করছেন। এ বিষয়েও সংগঠনগুলোর নজর দেওয়া উচিত। আর বিশেষ ব্যবস্থায় নাটক নির্মাণসহ নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলী যাদের অনেক পাওনা টাকা বকেয়া রয়েছে, সেগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে অনেকের দাবি। শুটিং ব্যস্ততা কম থাকায় শুটিং হাউসের মালিকরা বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন; শুটিংবাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবাই স্বীকার করছেন যে, পেশাদারিত্ব সংকট রয়েছে এই মাধ্যমে। টিভি নাটকের করুণ পরিস্থিতির জন্য অনেকেই দায়ী করছেন-ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ নেই, সময়মতো শুটিংয়ে না আসা, ঠিকমতো নিয়ম মেনে শুটিং না করা, শিল্পী সম্মানীর অসামঞ্জস্যতা, স্ক্রিপ্ট ছাড়া শুটিং, পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে অভাব, পে-চ্যানেল বাস্তবায়ন না করা, বাজেট স্বল্পতা, শিল্পী নির্বাচনে নির্মাতাদের স্বাধীনতাহীনতাই দায়ী। তাই এসব সংকট মিটলেই পেশাদারিত্বসহ সব সংকট কেটে যাবে বলে নাট্যসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর