শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

স্যালারি গ্র্যান্ড চালুর দাবি নাট্যকর্মীদের

মোস্তফা মতিহার

স্যালারি গ্র্যান্ড চালুর দাবি নাট্যকর্মীদের

টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও গানের শিল্পীরা তাঁদের অভিনয় ও গায়কির মূল্য হিসেবে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। কিন্তু অভিনয়ের পাঠশালা বলে খ্যাত মঞ্চশিল্পীরা কোনো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। প্রতিটি নাটকের প্রযোজনায় নিজেদের অর্থ, ঘাম ও শ্রমের মূল্য পাচ্ছেন না বলে জীবন ও জীবিকার তাগিদে মঞ্চশিল্পীরা এখন টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। আর টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সুযোগ পাওয়া শিল্পীদের সংখ্যাও নগণ্য। এ পরিস্থিতিতে দিন দিন অবহেলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অভিনয়ের পাঠশালা বলে খ্যাত থিয়েটার অঙ্গন। যাপিত জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে মঞ্চশিল্পীদের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ পারিশ্রমিকের দাবি জানিয়ে আসছেন থিয়েটার কর্মীরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মঞ্চশিল্পীদের মূল্যায়ন ও তাঁদের জীবনের প্রয়োজনে স্যালারি গ্র্যান্ড চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে চরম মনোকষ্টে আছেন মঞ্চের শিল্পীরা। এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে দেশের প্রতিটি থিয়েটারের কর্মীদের মাঝে। মঞ্চ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দেশের বিশিষ্ট নাট্যজনরাও দীর্ঘদিন যাবৎ মঞ্চের শিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ডের দাবি জানিয়ে আসছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে। তবে কোনো অদৃশ্য কারণে এখন পর্যন্ত মঞ্চশিল্পীরা তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। এ নিয়ে হতাশা কাজ করছে বিভিন্ন নাট্যদলের নাট্যকর্মীদের মাঝে। নিজেদের টাকায় চাঁদা তুলে বেশি দিন সংস্কৃতি চর্চা করা যায় না এমনটিও বললেন নাট্যকর্মীরা। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক নাট্যদল কর্মী হারাচ্ছে এমন প্রসঙ্গ তুলে রাজধানীর বেশ কয়েকটি নাট্যদলের প্রধানরা বলেন, আমরা যদি তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে পারতাম তাহলে মঞ্চগুলো আলো ঝলমলে থাকত। আর তাঁরাও দীর্ঘদিনের ভালো লাগা ও ভালোবাসার মঞ্চ ছেড়ে অন্য কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত হতেন না। এখন তাঁরা অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে মঞ্চ তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। তবে স্যালারি গ্র্যান্ড চালু হলে মঞ্চশিল্পীরা তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন পাবেন বলেই মনে করছেন নাট্যবোদ্ধারা।

 

আতাউর রহমান

প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্যালারি গ্র্যান্ড চালু থাকাতে সেখানকার মঞ্চশিল্পীদের অন্য কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে হচ্ছে না। এতে তাঁদের অভিনয়ের বিস্তৃতি ঘটছে অনেক বেশি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকলে যে কোনো কাজ ভালোভাবে করা যায়। তাঁরা সচ্ছল বলে নাট্যচর্চাটা ভালোভাবে করতে পারছেন। আমাদের এখানে তো ভালোবাসার বিনিময়েই সবকিছু বিচার করা হয়। দিনের পর দিন একজন মঞ্চশিল্পী শুধু দিয়েই যাবেন বিনিময়ে কিছু পাবেন না তা তো হতে পারে না। বিনিময় না পেলে কাজের প্রতিও আগ্রহ কমে যায়। মানসম্পন্ন দলগুলো বেছে নিয়ে সরকারের উচিত তাদের স্যালারি গ্র্যান্ড দেওয়া। এটা শিল্পীদের যৌক্তিক দাবি। একজন শিল্পী টিভিতে কাজ করলে প্রতিদিন ৫-১০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু মঞ্চে কোনো টাকা পান না বলে মঞ্চের প্রতি তাঁদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কলকাতার মতো আমাদের দেশে যদি স্যালারি গ্র্যান্ড চালু হয় তাহলে আমাদের নাট্যাঙ্গন আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।

 

মামুনুর রশীদ

স্যালারি গ্র্যান্ডের জন্য ১০ বছর ধরে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। প্রতিটি নাটকে প্রত্যেক শিল্পীকে ১০ হাজার টাকা ও নির্দেশককে নাটকপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ব্যবস্থ্ াচালু করা উচিত। এতে মঞ্চের প্রতি শিল্পীদের আগ্রহ তৈরি হবে। টাকা দিতে পারছি না বলেই আমরা শিল্পীদের ধরে রাখতে পারছি না। জীবিকার তাগিদেই তাঁরা অন্য পেশার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। ভারতের মতো যদি আমাদের দেশে স্যালারি গ্র্যান্ড চালু হয় তাহলে আমাদের শিল্পীদের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হবে বলে মনে করি। সরকার যদি এ বিষয়ে আন্তরিক না হয় তাহলে নাট্যচর্চা দিন দিন হারিয়ে যাবে।

 

লাকী ইনাম

স্যালারি গ্র্যান্ড চালুর বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর পাইনি। দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে ও মানবিক মানুষ গঠনে মঞ্চকর্মীরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আর এসব কিছু তাঁরা নিজের অর্থে, ত্যাগে ও শ্রমে করে থাকেন। অর্থ ছাড়া জীবনটাই তো অনর্থক। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র মতো শিল্পীরা শুধু পরিশ্রমই করে যাচ্ছেন কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছেন না। এভাবে চলতে থাকলে বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না বলেই আমার ধারণা।

 

মোহাম্মদ বারী

মঞ্চশিল্পীরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। কিন্তু সেটা আর কতদিন? এখন জীবন-জীবিকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। শিল্পীরা তো রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পীদের নিয়মিত স্যালারির আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অনেক দিন ধরেই নাট্যকর্মীরা দাবি জানাচ্ছেন, কিন্তু এটা না হওয়ায় আমি হতাশ। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অনুদান দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার যদি প্রজেক্ট আকারে নাটকের নির্দেশকদের কাছ থেকে আইডিয়া আহ্বান করে এবং সেই আইডিয়া বাস্তবায়নের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি অনুদান দেয়, সে অনুদানের মধ্যে শিল্পী, কলাকুশলী সবাই যেন পেশাদারভাবে কাজটি করতে পারেন, তার ব্যবস্থা থাকে এবং সরকার থেকে সেই কাজটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে জবাবদিহিতার জায়গাটি নিশ্চিত করা হয়, তবে ফলপ্রসূ হবে।

 

মোমেনা চৌধুরী

মঞ্চের শিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ড আমাদের অনেক দিনের প্রত্যাশা। সারা বিশ্বের মঞ্চশিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ড চালু রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশেই এখনো তা চালু হয়নি। মঞ্চশিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ড চালু হলে নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্ব তৈরি হবে এবং নাট্যচর্চার পথ অনেক বেশি সুগম হবে।

 

খন্দকার শাহ আলম

মঞ্চশিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ড চালু করাটা আমাদের শিল্পীদের প্রাণের দাবি। প্রত্যেক সেক্টরেই কাজের বিনিময়ে অর্থ প্রদান করা হয়ে থাকে, শুধু মঞ্চশিল্পীরাই এর ব্যতিক্রম। নিজের টাকায় বেশি দিন শিল্পচর্চা করা যায় না। তাই আমি মনে করি থিয়েটারচর্চাকে সুগম রাখতে হলে মঞ্চশিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্র্যান্ড চালু হওয়া দরকার। এতে শিল্পীরা মঞ্চের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী হবেন আর শিল্পীদের মাঝে পেশাদারিত্ব তৈরি হবে।

 

পাভেল রহমান (সম্পাদক, থিয়েটার পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’)

থিয়েটার তো পার্টটাইম করার কাজ নয়, এটা ফুলটাইম কাজ। কিন্তু আমাদের দেশের নাট্যকর্মীরা জীবিকার জন্য নানা জায়গায় পরিশ্রম করার পর সন্ধ্যায় এসে থিয়েটার করেন। এতে থিয়েটারে মেধার পুরোটা তাঁরা দিতে পারেন না। অনেক দক্ষ নাট্যকর্মী শুধু জীবিকার জন্য থিয়েটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। থিয়েটারকর্মীরা তো সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করেন। তাই রাষ্ট্রের উচিত নাট্যকর্মীদের জীবিকার ব্যবস্থা করা। নাট্যকর্মীরা যেন মিনিমাম জীবন নির্বাহের খরচটা থিয়েটার থেকে নিতে পারেন, তার জন্য সরকার থেকে স্যালারি দেওয়ার দাবি তো অনেক দিনের।  এটা চালু করা উচিত।

সর্বশেষ খবর